সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১০ কিস্তি ৩
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
শুনতে শুনতে একটু হাসলেন ভজহরি চক্রবর্তী। পিংপং যে খুব ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি, সে পরিচয় তিনি আগেও পেয়েছেন। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে জগৎ শেঠকে সামনে আনলে যে শ্রী বসুর উদ্দেশ্য সাধনের পথে বড়ো বাঁধা হয়ে উঠতে পারে, তা বেশ বুঝতে পারলেন।
এদিক ওদিক একবার দেখে নিয়ে ভজহরির কানের পাশে মুখ রেখে পিংপং ফিসফিস শব্দে বুঝিয়ে দিলেন, রফিককে কাছে টানা কেন এত বেশি প্রয়োজন। তাকে গাইড করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ভজহরির উপরে ছেড়ে দিয়ে বললেন, এই টাকাটাধরুন, এক লাখ আছে। দ্বিতীয় লটে আরও পাবেন। রফিকের জন্যেও একই অফার রয়েছে। ফ্যানটাসটিকস চললে টাকার অভাব হবে না, না চললে অনেক সমস্যা।
ভজহরি আবার একটু হাসলেন। বললেন, নিশ্চিত থাকুন, এ কাজ আমি সেরে ফেলতে পারব। কতটা সময় লাগবে জানি না।
পিংপং বসুও বুঝে গেলেন, ঘুর পথে ফ্যানটাসটিকসকে বাঁচাতে লোক পছন্দ করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভুল হয় নি। একমাত্র ভজহরির পক্ষে এ কঠিন দায়িত্ব পালন করা সম্ভব।
পশ্চিমের সূর্য সবুজ মাঠের বুকে শুয়ে পড়েছে। ছাদের উপরে উঠেসীমাহীন আকাশের দিকে চেয়ে থাকলেন। মিঠে কিরণের আমেজে তার নতুন স্বপ্নে অভিনব ছোঁয়া জাগছে। আরেকটা ভিন্ন কারণে তার ভিতরে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। জিৎ তাঁকে কথা দিয়েছিল, আজ সন্ধের আগে যে কোনো মূল্যে রফিককে নিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হবে। সূর্য ডুবতে চলল, এখনও জিৎ-এর দেখা নেই। তাহলে কী সে রফিককে গ্রিপে আনতে পারে নি? একা ভজহরির পক্ষে যে নতুন এ স্কিম বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না, তা তিনি ভালো করেই জানেন। চুম্বক লোহার মতো দুজনকে দুদিক থেকে একই মুখোশী রোল করতে হবে। লোহা থাকল, চুম্বক নেই, মানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকল না। আবার লোহা খাঁটি কিনা তা জানার জন্যে চুম্বকের খুব প্রয়োজন। কিংবা চুম্বক থাকল, লোহা নেই, তাহলে চুম্বকের কার্যকারিতা জানার উপায় থাকে না।
একটু আগে সূর্য ডুবে গেছে সবুজ ঘাসের বুকে। ছাদ থেকে নেমে এসে ঘরের ভিতরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখলেন পিংপং বসু। মনের গভীরে নতুন অস্থিরতা। তাহলে কী শেষ পর্যন্ত রফিক রাজী হল না? এমনও হতে পারে, পল্লব দাশের সাথে কথা বলে নি বলে সম্মতি দিতে পারে নি। রফিক রাজী না হলে ভজহরির সাথে ফাইনালে চুক্তি যে সম্পূর্ণ অর্থহীন, তা ভেবে কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুচোখ বাইরের আকাশের দিকে। কলিং বেলের শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, জিৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। রফিককে সাথে নিয়ে এসেছে। সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ভিতরে এস জিৎ।
পিংপং বসুর মুখে মিষ্টি হাসি। বললেন, তোমার নাম রফিক? রফিক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
জিৎ-এর মুখে শুনেছি, তুমি বোনের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমার হাতে একটা ছেলে আছে। সম্মতি দিলে বলে দেখতে পারি। মাসে মাসে লিগ্যালি হাজার দশেক পায়। এছাড়া এদিক ওদিক করে আরও হাজার তিনেক। I mean, সব মিলিয়ে তেরো-চোদ্দ হেসে খেলে হয়। ছেলেটি বেশ স্মার্ট, সুঠাম দেহী। একেবারে আমার গ্রিপের মধ্যেই আছে। বললে না বলতে পারবে না।
রফিক আগে কোনোদিন পিংপং বসুকে দেখে নি। যেটুকু শুনেছিল, সবই জিৎ-এর মুখ থেকে। সামনাসামনি হয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বুঝল, জিৎ তাকে নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছিল, সেগুলো বেশ মিলে যাচ্ছে। আসিফের উপর ভীষণ রাগ হল। যত সব মিথ্যে কথা শুনিয়েছিল তাকে। যার ব্যবহার এত ভালো, তিনি কখনোএত নিম্ন প্রকৃতির হতে পারেন না।
রফিক মনে মনে ভেবে নিল, হি ইজ রিয়েলি এ জেন্টেলম্যান।
দুঠোঁটের ফাঁকে চাপা হাসি ফুটিয়ে মিস্টার বসু আবার বললেন, কোনো জটিল বিষয় নিয়ে কখনো একা ভাবতে নেই রফিক। শেয়ার করো। দেখবে জটিল ভাবনা অনায়াসে সরল হয়ে গেছে।
রফিকের তাৎক্ষণিক মানসিক মূল্যায়ন আরও ভারী হয়ে উঠল। নিজেকে হাল্কা করে নিতে চেষ্টা করল বার বার। সে যেন একটা বড়ো সুযোগ পাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে। রাতের অন্ধকারে আলোর দিশা মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। পিংপং বসুর কথায় রফিকের ভিতরের স্বপ্নও ধীরে ধীরে সজীব হয়ে উঠল।
পিংপং গম্ভীর মুখে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘরের ভিতরে আলোর মেলা থাকলেও বাইরের চত্বরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের ছবি তার দুচোখের সামনে ভাসছে। রফিককে শুনিয়ে বলতে শুরু করলেন, জিৎ-এর মুখে সব কিছু শুনে ফেলেছি। বাবা নেই বলেই বোনের বিয়ে নিয়ে তোমাকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। দাদা হয়ে বাবার ভূমিকা পালন করা যে কত বড়ো দায়িত্ব, তা কেউ না বুঝলেও আমি মর্মে মর্মে বুঝতে পারি।এ অনেক বড়োদায়ভার। সেটাই তোমাকে করে দেখাতে হবে। সারা জীবনের বন্ধন। এ নিয়ে তো শুধু শুধু নাটক করা চলে না।
রফিক জীবনের তলানিতে নেমে তাৎক্ষণিক প্রসঙ্গ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হল। মিস্টার বসু ঠিক কথাই বলেছেন। তাকে যে কোনো মূল্যে এ সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেই হবে। দাদা হয়ে বোনের বিয়ে নিয়ে যে এভাবেই ভাবা যায়, তার জন্যে সে বদ্ধপরিকর। বেশ অবাক হল এই ভেবে যে পিংপং বসু জিৎ-এর মুখে শুনে তার ভিতরের ভাবনাকে ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। এ শুধু পারা নয়, মানবিক সহমর্মিতা না থাকলে এভাবে ভাবা সম্ভব নয়।
মিস্টার বসু আবার থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন, বেশ বুঝতে পারছি, তোমার জীবন সংগ্রাম দুর্গম পথে এগিয়ে চলেছে। বেকার হয়েও তোমাকে বোনের বিয়ের জন্যে সব আর্থিক দায়ভার বহণ করতে হবে। মানুষকে মাঝে মাঝে এমনিকরে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে জিতে যাওয়ার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়।
রফিক আবেগতাড়িত হয়ে চেয়ে থাকল মিস্টার বসুর দিকে। পিংপং আর কথা বাড়ালেন না। রফিকের অন্ধকার জীবনে নীল আকাশ হওয়ার ব্যাকুলতা তার বুকের গভীরে। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। রফিককে দেখে তার বার বার মনে হতে থাকল, শিকড়হীন এক খণ্ড মেঘ আকাশের বুক বেয়ে ভেসে চলেছে সামনে। মৃদু হাওয়ার গতি মূল চালিকাশক্তি হয়ে তা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তাকেও এমনি করে রফিকের জীবনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে হবে। জিৎ এসে দাঁড়াল পিংপং বসুর পাশে। একটা ছোট্ট অনুরোধ করব?
পিংপং মুখ তুলে তাকালেন জিৎ এর দিকে। বলো, কী বলতে চাও?
রফিক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নাটকনিয়ে দুজনের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবুও আমি ওকে বিপদে ফেলতে পারিনা। বাবা নেই। বোনের বিয়ে মাথার উপরে। মস্ত ভারী বোঝা। কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে ও। রাতদিন ভাবছে কিন্তু কুলকিনারা পাচ্ছে না। তাই বলছি যদি একটা কিছু ব্যবস্থা....।
মিস্টার বসু মাথা নীচু করে ঘরের ভিতরে পায়চারী করতে শুরু করলেন। একবার জানালার পাশে, একবার ঘরের মাঝে, একবার দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন।
জিৎ এর মধ্যে নতুন কৌতূহল জাগল। মনের গতিতে বাঁধা পেয়ে কী এভাবে বার বার থমকে যাচ্ছেন। পিংপং তখন খাটি পরার্থপরতার গভীরে ডুবে থেকে পায়চারীতে ব্যস্ত। রফিকের জন্যে তাকে একটা কিছু করতেই হবে।
চাপা কথোপকথন শুরু করল জিৎ। রফিককে শুনিয়ে বলল, আমার কথা শুনে রাখ, বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন রে। মনে হচ্ছে, তোর জন্যে একটা ব্যবস্থা না করে ছাড়বেন না। এত বড়ো পদে আছেন। এটুকু করা ওঁর পক্ষে সহজে সম্ভব।
পিংপং নিজের হাতে চেয়ার টেনে নিয়ে রফিকের সামনে চলে এলেন। থেমে থেমে বললেন, জিৎ এর কথা কিছুতেই ফেলতে পারব না রফিক। কালই বালিগঞ্জ শাখায় জয়েন করো। আজ রাতে এ্যাপোয়েন্টমেন্ট রেডি করছি। ঠিক সময়ে জিৎ তা নিয়ে যাবে। আপাতত মাসে মাসে সাত হাজার পাবে। ছ’মাসের মধ্যে ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ করতে হবে। তারপর প্রতি মাসে পনেরো হাজার।।
একটুসরে গিয়ে আলমারীর সামনে দাঁড়ালেন পিংপং বসু, লক খুলে আনমনে টাকা গুণতে লাগলেন। সরে এসে রফিকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, গুণে নাও ভাই। বোনের বিয়ের জন্যে একটা উপহার তুলে দিলাম তোমার হাতে। আনন্দিত হচ্ছি কোম্পানির পক্ষ থেকে তোমার বোনের বিয়েতে অংশগ্রহণ করার জন্যে। একটা অনুরোধ করব, বালিগঞ্জের মতো বড়ো শাখায় তোমার চাকরী, বেশ দায়িত্বপূর্ণ কাজ। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে তা পালন করতে হবে। কোম্পানির বিরুদ্ধে নতুন কোনো সমস্যা দেখা দিলে সহজে মাথা গরম করবে না। আমার সাথে একটুকনসাল্ট করলে বুঝতে পারবে, সহজে এসব সমাধান করা যায়।
রফিক এত আপ্লুত হয়ে গেল যে ভিতরের কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না। জিৎও মনের আনন্দে উদ্বেলিত। দুজনের আবেগতাড়িত দুর্বলতা শ্রাবণের বৃষ্টিহয়ে ঝরে পড়তে লাগল মনের আকাশ থেকে। পারেন বটে লোকটা। জীবনের চাকা কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে হয়, তা ভালো করেই জানেন। জীবনবোধ গভীর বলেই কখন কী করতে হবে, তা যেন লোকটিরমুখস্থ হয়ে আছে। একটা চাপা খেদ রফিককে ভীষণভাবে তাড়া করতে লাগল। এতদিন আসিফের কথা শুনে না চললে তার ভাগ্য দিব্যি খুলেযেতে পারত। একবার ফুসে উঠল ভিতরে ভিতরে। পল্লবকে নিয়েও তার ভিতরে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়ে গিয়েছে। নাটকের দল গড়ে আদর্শের কথা বলে বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখাতে পারলেও বাস্তব রূপ দেওয়ার ক্ষমতা পল্লব দাশের নেই। কিন্তু পিংপং বসু নিজের ভাবনা রূপায়ণ করে দেখাতে পারেন। পল্লব আকাশচারী, আসিফ তার প্রিয় ছায়াসঙ্গী, পিংপং বসু কঠোর বাস্তববাদী, জিৎ তার প্রিয় অনুগামী। কেবল সেই কারণেই তার পক্ষে এত বড়ো সুযোগ পাওয়া সম্ভব হল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct