ধূসর শহরে অস্ফুট কুঁড়ি
নন্দিনী আরজু
________________
সকাল থেকে সূর্যের দেখা নাই আকাশে মেঘ। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পৃথা ফজরের নামাজ পড়ে মোনাজাত শেষ করে রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। কাজে মন দিতে পারছে না, অহেতুক নানা চিন্তা মাথায় ঘুরছে মন বিষণ্ন হয়ে আছে।
উফফ্ সাতসকালে বাজার যেতে হবে, সব্জি আনাজপাতি ফুরিয়ে গেছে। বৃষ্টিতে রাস্তার যা অবস্থা বাইরে বেরুতেই ইচ্ছে করে না। কিন্তু যেতে হবেই।
ফয়সাল এখন ঘুমাচ্ছে,প্রায়ই কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। সারাদিন ব্যস্ত থাকে ব্যবসার কাজে। তাদের দুই মেয়ে, চম্পা আর টুম্পা।
চম্পা ঘুমুচ্ছে স্কুল-টিউশান করোনার জন্য বন্ধ। কবে সব কিছু স্বাভাবিক হবে, কে জানে!
ছোট মেয়ে টুম্পার ঘুম ভেঙেছে সকালে। মোবাইল হাতে বসে ইচ্ছে মতো টাচস্ক্রীনে আঙ্গুল ছুঁইয়ে পছন্দের কার্টুন দেখছে।
মোবাইল হাতে থাকলে কোনো বিরক্ত করে না।ছোট থেকে খাওয়া ঘুম খেলা সব কিছুতেই মোবাইল। এখন তো রীতিমতো কান্নাকাটি করে হাতে মোবাইল না দিলে। এখন চুপচাপ কার্টুন দেখায় ব্যস্ত।
পৃথা বাজারের ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। রাস্তায় কাদা-পানি জমে আছে। ঢাকা শহরে বৃষ্টি নামলেই এক হাঁটু পানি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।অবশ্য কাছেই সব্জি বাজার।পথ টুকু আসতেই কাদা-পানিতে কাপড় ভিজে একশা। তার উপর রিকশা প্রাইভেটকার থেকে ছিটকে আসছে নোংরাপানি। আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এক প্রস্ত বিরক্তি নিয়ে কেনাকাটা শেষ করলো সে।
ঢাকা শহরে ফয়সালের নিজের ফ্ল্যাট। ছয়তলা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় থাকে ওরা। অন্য বাসার বাসিন্দাদের সাথে মেলামেশা তেমন নাই। সবাই নিজেদের মতো।
পৃথার বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি ঢাকার বাইরে গ্রামে। ঢাকা শহরে ব্যবসার প্রয়োজনে থাকছে ওরা মাঝে মাঝে বাবা-মা আসেন। প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।সংসারের যাবতীয় কেনাকাটা নিজেই করে। মেয়েরা এমনই সব কিছুতে অনায়াসে অভ্যস্ত হয়ে যায়।অনেক গুলো বছর ঢাকা শহরে, সব তার চেনাজানা।
হাতে ব্যাগ ভর্তি সব্জি, ছাতা মাথায় তবুও ভিজে একাকার। হাত ব্যথা করছে,কোনমতো সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা বাসায় উঠে এলো। রান্না ঘরে ব্যাগ রেখে, ফয়সালকে ডাকলো। নিজে ওয়াস রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ফয়সাল নাস্তা করে কাজে বেরিয়ে গেলো। সেই থেকে টুম্পা বসে আছে মোবাইল হাতে।
বাচ্চাদের ব্যস্ত হাতে খাইয়ে, বড় মেয়েকে হোমওয়ার্ক করাতে বসলো। অনলাইন ক্লাস আছে চম্পার।
পৃথার একক পরিবার সব কিছু নিজেকে সামলাতে হয়। ফয়সাল মোটেও সময় দিতে পারে না। বড় মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ছে,ছোটর বয়স চার । কিছু দিন থেকে দুশ্চিন্তা কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। ভীষণ অসহায় লাগছে, স্বামীকে বলেছে কয়েকবার সমস্যার কথা, সে আমলই নেয়নি। বড় মেয়ে হাসিখুশি চঞ্চল প্রচুর কথা বলে,টুম্পা চুপচাপ হাসে নানা শব্দ করে কিন্তু স্পষ্ট কথা বলে না। যদিও বলে, দুর্বোধ্য কিছু শব্দ।
ইদানীং পৃথা লক্ষ্য করেছে,টুম্পা বাংলা উচ্চারণে কথা বলে না। মোবাইলে কার্টুন ইংরেজি স্প্যনিস ভার্সান যেমন ঠিক তেমন মুখে কিছু শব্দ করে। দুর্বোধ্য বোঝা যায় না।
খেয়াল করেছে মেয়েটার সমস্যা। জটিল কিছু ভাবেনি সে।
আজ বিকেলে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ-এর এ্যপয়েটমেন্ট নিয়ে রেখেছে।
অনেকক্ষণ আগেই এসেছে কিন্তু প্রচন্ড ভিড়, শিশুদের যে কত রকম সমস্যা না দেখলে বোঝার উপায় নাই। বেশ কিছু শিশুর বাক প্রতিবন্ধকতা-অটিজম সমস্যা।
পৃথা ডাঃ এমএইচ রহমানের প্রাইভেট চেম্বারে টুম্পাকে নিয়ে বসে আছে। ডাঃ রহমান টুম্পার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলেন, সে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চুপিসারে ডাঃ-এর দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছে।
টুম্পা কী করে সারাদিন। জানতে চাইলেন ডাঃ।
মোবাইলে কার্টুন দেখে দিনের অধিকাংশ সময় , বললো পৃথা।
ডাঃ বললেন, “এই অভ্যাস ওর ব্রেইনের উপর এফেক্ট বিস্তার করেছে। ও স্বাভাবিক কথা বার্তা নিতে পারছে না।
আপনাদের উচিৎ ছিলো,ওকে সময় দেওয়া কথা বলার অভ্যাস করানো। যৌথ পরিবার গুলোতে বাচ্চারা বড়দের থেকে কথা আচার আচরণ দেখে শুনে শেখে। টুম্পার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।”
ডাঃ রহমান পরীক্ষা করে আরো বললেন, “আপনার মেয়ে অটিজমে আক্রান্ত নয়, সে স্বাভাবিক শিশু।
ওকে সময় দিতে হবে কথা বলতে হবে। মোবাইল নয় নিজেদের সাথে বিভিন্ন আচরণে অভ্যস্ত করে তুললে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে,ইনশাআল্লাহ।
কাজের সুবিধার জন্য বাচ্চাকে মোবাইলে অভ্যস্ত করা মোটেও উচিৎ নয়।”
এখন জীবন হয়ে উঠেছে একক পরিবার কেন্দ্রীক। ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব মানুষের উপর ভালো মন্দ দুইভাবেই প্রভাব বিস্তার করছে।
ডাঃ বললেন,”মেয়ের হাতে মোবাইল দেবেন না। নিজেদের সাথে সময় কাটানোর অভ্যাস করুন। বর্তমান সময়ে মোবাইল আসক্তি জীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাচ্চাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ছোট বড় সকলের সময় কাটানোর অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে মুঠোফোন। আত্মকেন্দ্রীক অন্তর্মুখী বিনোদন, মানুষকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এখন এর অপকারিতা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।”
ডাঃ দেখিয়ে আসার পর থেকে পৃথার ভীষণ মন খারাপ। সারারাত ঘুমায়নি কেঁদেছে শুধু, ফয়সাল সব জেনেছে তারও মন খুব খারাপ। দু’জনেই দুশ্চিন্তায় বিমর্ষ কোন শান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছে না।
সকালে উঠে পৃথা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে অনেক কান্না করেছে। সে জানালা খুলে দিলো, বাহিরে ঠাণ্ডা ফেকাশে ভোর। ঢাকা শহরে উঁচু কংক্রিটের বহুতল ভবনের ফাঁকে একচিলতে আকাশ। সেখানে জল ভরা মেঘের আনাগোণা। সারা শহরটাকে ধূসর বিবর্ণ লাগছে। তার বুকটা হুহু করে উঠলো, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো পর্দা দৃষ্টি ঝাপসা করে দিলো।
মনে সংশয় মেয়েটা কথা বলতে পারবে তো!
অনাগত আগামী নষ্ট হয়ে যাবে না তো! নিজের ভুল অনুশোচনা তাকে দগ্ধ করছিলো।
সকালে উঠে টুম্পা অভ্যাসমত মোবাইল নিয়ে বসেছে। কার্টুনের বিচিত্র শব্দে পৃথার সংবিত ফিরে এলো....
মেয়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে, জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেললো নিচের রাস্তায়। ছিটকে পড়ে ভেঙে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো।
পৃথা বিস্ময়ে চমকে গেলো
টুম্পার কান্না আর দুর্বোধ্য চিৎকারের মধ্যে “মা আ... “ উচ্চারণ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct