বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন সুপেয় জলের বেশিরভাগই রয়েছে মাটির একেবারে নীচে। অতীত কাল থেকেই মানুষ এমন সব অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছে যেখানে মাটির উপরের ভাগেই সুপেয় জল পাওয়া যায়। বর্তমানে পৃথিবীর ৯০% লোক এমন এলাকায় বাস করে যার কমপক্ষে ১০ কিমির মধ্যে সুপেয় জলের ব্যবস্থা বর্তমান। উত্তরোত্তর সংখ্যা বাড়ছে মানুষের। খুব স্বাভাবিক কারণেই জলের চাহিদা মেটাতে তাই মাটির নীচ থেকে জল উত্তোলন করা হচ্ছে। এভাবে জলস্তর নেমে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে লিখেছেন সেখ সেতাবুদ্দিন। আজ শেষ কিস্তি।
নযোগ্য জলের জোগান
কমে যাওয়ার আরেক কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। এ কারণে অনেক এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে শুষ্ক মৌসুম।
একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় - বর্তমানে পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের সাতজনের বাড়িতেই জলের লাইনের সংযোগ আছে। ফলে জলপ্রাপ্তি ‘জলবৎ তরলং’! এত সহজে জল পাওয়ার ফলে আমরা ভুলেই গেছি ট্যাপ চালিয়ে খুবই সহজসাধ্য উপায়ে জল পাওয়ার জন্য মানব সমাজকে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার হাজার বছর।
অতীতের সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল জলের উৎসকে কেন্দ্র করে। অতীত এবং বর্তমানের বহুবসতি বিলীনও হয়ে গেছে শুধু জলের অভাবে। এই জলের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও তৈরি হয়েছে। সুদানের দারফুরে যুদ্ধ লাগার অন্যতম কারণ ছিল জল। যুদ্ধ গবেষণা বলছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও ২০০৬ সালের খরার অনেক প্রভাব ছিল। তথ্যলব্ধ বিষয় থেকে অনুমান করা হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পানযোগ্য জল থাকবে না।
বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক গোল্ডম্যান স্যাকস ভবিষ্যৎবাণী করেছে একবিংশ শতাব্দীতেই জল পেট্রোলিয়ামের চেয়ে মহার্ঘ্য হয়ে উঠবে। ইন্টারনেট বলছে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন থেকেই বিপুল পরিমাণ জল মজুদ করতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে অধিক দামে বিক্রির আশায়!
পৃথিবীর বৃহৎ বৃহৎ শহরগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে জল ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ২০১৮ সালের ৯ জুলাইয়ের পর শহরটিতে চিরতরে জল সরবরাহ বন্ধ হবার কথা ছিল! জল শেষ যাওয়ার ওই দিনটিকে বলা হচ্ছিল ডে জিরো। কিন্তু বিষয়টি আলোচনায় আসে ডে জিরো-র আরম্ভ হওয়ার মাত্র ৯২ দিন আগে। তারপর থেকে কেপটাউনের প্রত্যেকেই মাত্রাতিরিক্ত সচেতনভাবে জল খরচ করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কেপটাউনের বাসিন্দারা তাদের জলের ব্যবহার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
শুধু এই লগ্নে কেপটাউন নয়তো নিজেদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিলো। আর বাকিরা কি নিশ্চিন্তে ঘুমোবে? লন্ডন, টোকিও, ইস্তাম্বুল মেলবোর্ন, সাও পাওলো, বার্সেলোনা, ঢাকা জাকার্তা, বেইজিং, মেক্সিকো সিটির মতো বহু শহরে অচিরেই জল-সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।
জলের এই চলমান সংকট যদি এখানেই শেষ হতো তাতেও হয়তো সমস্যা নিরুপণে কিছু সমাধানের উপায় খোঁজার চেষ্টা চলতো। কিন্তু আসল সমস্যা হলো আমরা পৃথিবীর মাত্র একভাগ জল কিভাবে ব্যবহার করছি সে বিষয়ে জোরদার ধারণা না থাকা।
প্রতিদিন ৪ লিটার জল পান করা উচিত একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের। এ পরামর্শ ডাক্তার বাবুদের। এছাড়া দাঁত পরিষ্কার, স্নান করা, হাত ধোয়া (কোভিডকালে যা চরম হারে, সঙ্গত কারণেই, বেড়েছে), খাবার রান্না করা, বাসন পরিষ্কার সহ নানাবিধ দৈনন্দিন কাজে জনপ্রতি আরো ৫০ লিটারের বেশি জল খরচ হয়!
সমীক্ষায় প্রকাশ একবার টয়লেট ফ্ল্যাশ করলে ৫ থেকে ৮ লিটার জল ‘বয়ে’ যায়।
আরেকটি হিসেব খেয়াল করার মতো।
পৃথিবীর মানুষের বাৎসরিক জলের ব্যবহারের মধ্যে দৈনন্দিন কাজে খরচ হয় মাত্র ৮ শতাংশ।
সর্বমোট জলের বেশির ভাগ জল ব্যবহার হয় কৃষি এবং শিল্প কারখানায়। সেচ কাজ করতে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ এবং শিল্প কারখানায় ২২ শতাংশ জল ব্যবহৃত হয়।
মুশকিল হচ্ছে বিভিন্ন দেশ তাদের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলে এমন সব কৃষিপণ্য চাষ করে যেগুলোতে জলের চাহিদা অনেক বেশি দরকার। এছাড়া বিশ্বের বেশিরভাগ কৃষি জমিতেই সেচ কাজ করা হয় খুবই অদক্ষ উপায়ে। জলের লাইন চালু করে খেত জলে তলিয়ে দেওয়া হয়। জলের প্রকৃত মূল্য যদি আমরা দিতে জানতাম তাহলে এভাবে অপচয় করা থেকে বিরত থাকতাম।
তারপর আমরা যদি দেখি শিল্প কারখানার দিকে তাহলে সেখানেও দেখবো জল নিয়ে কী মাত্রায় না অনাচার আর অপচয় চলছে! মাত্র ৬০০ মিলিলিটার কোকাকোলা তৈরি করতে বিভিন্ন ধাপে ২৮ লিটার পরিস্রুত সুপেয় জল খরচ হয়! (খেয়াল করুন ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডার রিসেন্ট প্রেস ব্রিফিং-এর দৃশ্যটা এমনি এমনি হয় নি!) আর এর বোতল তৈরি করতে লাগে ৭ লিটার জল। এখান একটা অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করা দরকার। অনেকেই যখন ক্যাপিটালিজমের আঁতুড় ঘরে তৈরি হওয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতায় এসব কোমল পানীয়ের বিরোধিতা করেন তখনও অনেকে উন্নাসিকতা দেখান। কিন্তু জল খরচের এই ‘নান্দনিক’ তথ্যে সম্বিৎ না ফিরলে বোঝা যায় আপনি তাদেরই দোসর নন তো? আবার আরেকটি তথ্য জানান দিচ্ছে ১কাপ কফি বানাতে জল লাগে ১৩০ লিটার! না, অন্ধকে কলকাতা হাইকোর্ট দেখাচ্ছি না! আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এক কাপ কফি বানাতে তো এক কাপই জল লাগে।
(সমাপ্ত...)
(লেখক প্রাবন্ধিক ও স্কুল শিক্ষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct