“আমি কোনো নির্মাতা ছিলাম না, ছিলাম না কোনো ভাস্কর। আমি কখনো রাজমিস্ত্রিদের কোনো সরঞ্জাম হাতে তুলে দেখিনি। বাটালি ছিলো পুরো অপরিচিত একটি যন্ত্র আমার কাছে। স্থাপত্যকলার মতো বিষয়ে আমি ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ। হে ভ্রমণকারী! এখানে যা দেখছো সবই একজন কৃষকের নিজ হাতে তৈরি, যে শুধু নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ প্রদান করতে বিশ্বের এই রানীকে তৈরি করেছে।”: ফার্দিনান্দ শেভাল
ফৈয়াজ আহমেদ : ‘দ্য প্যালেইস আইডিয়াল’ (The Palais Idéal), যার অর্থ হলো আদর্শ প্রাসাদ। পুরোটাই পাথরে তৈরি এই অবকাঠামোটি ফ্রান্সের হটেরাইভসে অবস্থিত।
এটি হলো এমন একটি প্রাসাদ যা মাত্র একজন ব্যক্তি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। যার ছিলো না স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কে কোনো প্রকারের জ্ঞান বা পূর্ব অভিজ্ঞতাও। তিনি ছিলেন সাধারণ একজন ডাকপিয়ন। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো, তিনি পথে কুড়িয়ে পাওয়া সব পাথর জোগাড় করে তার এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। স্বভাবতই তার একা এই প্রাসাদটি তৈরি করতে লেগে গিয়েছিলো পুরো ৩৩টি বছর! অসাধারণ এই ব্যক্তির নাম ফার্দিনান্দ শেভাল।
ফার্দিনান্দ শেভাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৩৬ সালের ১৯ এপ্রিল, দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের অন্তর্গত চার্মস স্যর ল’হারবাসসে-তে। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, ২০ বছর বয়সে তিনি কাজ করতেন একটি রুটি কারখানায় শিক্ষানবিস হিসেবে। এরপরের বছরগুলোয় তার জীবনের কর্মকাণ্ডগুলোর ব্যাপারেও সেভাবে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে জানা যায় যে, ১৮৬৭ সালে তার ৩১ বছর বয়সে তিনি ডাকপিয়নের চাকরি পান। এর কিছুদিন পর গ্রাম্য ডাকপিয়ন হিসেবে তাকে বদলি করা হয় হটেরাইভসের একটি ডাকঘরে। যেখান থেকে তাকে টারসেন অঞ্চল পর্যন্ত চিঠি বিলির কাজ করা লাগতো। সে হিসেবে তাকে প্রত্যেকদিন মোট ১৮ মাইল ভ্রমণ করা লাগতো।
এর এক বছর পরেই ঘটে যায় এক চমকপ্রদ ঘটনা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও শেভাল চিঠি বিলির কাজে নেমে পড়েছিলেন। যে পথ দিয়ে প্রত্যেকদিন তিনি যাতায়াত করতেন সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই একটি পাথরের সাথে তার পায়ে আঘাত লাগে। শেভাল কৌতূহলবশত পাথরটি হাতে তুলে নেন। পাথরটি অন্যান্য পাথরগুলোর তুলনায় ছিলো কিছুটা ভিন্ন আকৃতির। তাই তিনি সেটি পকেটে ভরে নেন। আর এই পাথরটিই তাকে প্যালেইস আইডিয়াল তৈরি করার অনুপ্রেরণা যোগায়।
তাই তার ৪৩ বছর বয়সে শেভাল এমন একটি স্থাপনা তৈরির কাজে হাত দেন যেখানে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যয় হয়ে যায়। পাথরটি পাওয়ার পর তার মনোভাব সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে শেভাল বলেছিলেন,
“পাথরটির আকৃতি এতটাই অদ্ভুত ছিলো যে আমি আপনাআপনিই সেটি আমার পকেটে ঢুকিয়ে রাখি। আমি তখন ভাবলাম প্রকৃতি হয়তো নিজে চায় এমন পাথর দিয়ে কোনো ভাস্কর্য বানাতে! তাই আমি ভাবলাম প্রকৃতির হয়ে আমি নিজে রাজমিস্ত্রির কাজ করবো এবং এরকম পাথর দিয়ে স্থাপনা বানাবো।”
পাথরের ভাণ্ডার যেভাবে সুন্দর প্রাসাদে পরিণত হলো
শেভাল এরপর যতবারই সে এলাকা দিয়ে গিয়েছেন তিনি প্রত্যেকবারই এরকম অদ্ভুত আকৃতির পাথর পেয়েছেন। এবং প্রতিবারই তিনি সেগুলো পকেটে তুলে নিয়ে জমা করছিলেন। যত দিন যাচ্ছিলো, পাথর জমানোর পরিমাণও বেড়ে চলছিলো। এতে করে তিনি একটি ব্যাগ সাথে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এমনকি ব্যাগও যখন পাথরে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো এবং তা বহন করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, শেভাল তখন সিদ্ধান্ত নিলেনসাথে করে একটি ঠেলাগাড়ি রাখার।
একজন ডাকপিয়ন চিঠি বিলির সময় ঠেলাগাড়ি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন ব্যাপারটা আশেপাশের মানুষজনদের কাছে অদ্ভুত ও হাস্যকর ঠেকেছিলো। তবে শেভাল এসবে ভ্রুক্ষেপ করেননি। বরং তিনি প্রতিদিনকার মতো চিঠি বিলির কাজ করে চলেছিলেন এবং পাথর জোগাড় করে যাচ্ছিলেন। চিঠি বিলির কাজে যাওয়ার সময় তিনি অদ্ভুত আকৃতির পাথরগুলো চিহ্নিত করে রেখে যেতেন এবং কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে পাথরগুলো তুলে ঘরে নিয়ে আসতেন। তিনি দিনের বেলা তার ডাকপিয়নের কাজ এবং পাথর কুড়ানোর কাজ করতেন এবং রাতে একা একা নিজের প্রাসাদ তৈরির কাজে হাত দিতেন। প্রাসাদ তৈরির ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতি, পোস্টকার্ডের ছবি এবং অন্যান্য ছবিওয়ালা সাময়িক পত্রিকা যেগুলো মূলত তিনি বিলি করতেন সেগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন।
দ্য প্যালেইস আইডিয়ালের কাজ শেষ হয় ১৯১২ সালে। ফার্দিনান্দ শেভালের বয়স তখন ৭৬ বছর। প্রাসাদটি সর্বোচ্চ ২৬ মিটার লম্বা হয়েছিলো, যার একপ্রান্তের শেষভাগটার উচ্চতা ছিলো ১২ মিটার এবং অন্যপ্রান্তের উচ্চতা ১৪ মিটার। স্থানটির স্থাপত্যকলায় প্রাধান্য পেয়েছে বিভিন্ন যুগের নির্মাণশৈলী। তাই প্যালেইস আইডিয়ালের গঠনে দেখা যায় হিন্দু মন্দির, আরব্য মসজিদ এবং মধ্যযুগীয় দুর্গ বা কেল্লার অবয়বও। সেই সাথে প্রাসাদটিতে দেখতে পাওয়া যায় অনেক কিছুর ভাস্কর্য। যেমন- ভালুক, পাখি ও হাতির মতো পশুপাখি।
শেভাল মুলত তার বিলি করা পোস্টকার্ডে দেখা সব পশুপাখিদের নিজের স্মরণে রেখেছিলেন এবং তার প্রাসাদে সেগুলোর স্থান দিয়েছিলেন। তাই তার প্রাসাদের প্রতিটি ক্ষুদ্রক্ষুদ্র অংশে দেখতে পাওয়া যায় নাম জানা-অজানা প্রচুর পশুপাখি। সেখানে ভ্রমণকারীরা নিজেদের বাচ্চাদের প্রায়ই ‘কে সর্বোচ্চ কতগুলো পশুপাখির ভাস্কর্য বের করতে পারে’ এমন খেলায় অংশ নেয়ান। এছাড়াও পৌরাণিক সকল জীবজন্তুর ভাস্কর্যের পাশাপাশি প্যালেইস আইডিয়ালে আরো রয়েছে জুলিয়াস সিজার, ভারসিনগেটোরিক্স এবং আর্কিমিডিসের ভাস্কর্যও!
শেভাল চেয়েছিলেন তার সমাধি হবে নিজের হাতে তৈরি করা এই অসাধারণ প্যালেইস আইডিয়ালেই। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। কারণ ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ থেকে এ ধরনের অনুমোদন পাননি তিনি। তিনি এতে মোটেই দমে যাননি। স্থাপনার মোহে ছিলেন তিনি। তাই নিজের জন্য একটি সমাধিমন্দিরই তৈরি করে ফেলেছিলেন সেখানকার স্থানীয় সমাধিক্ষেত্রে, যা তার প্রাসাদ থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই।
‘দ্য টম্ব অফ সাইলেন্স অ্যান্ড এন্ডলেস রেস্ট’ সমাধিটি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। তখন শেভালের বয়স হয়েছিলো ৭৮ বছর। তার ঠিক ৮ বছর পর ১৯২২ সালে সমাধিমন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তার দুই বছর পর ফার্দিনান্দ শেভাল মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে তার নিজের তৈরি এই সমাধিমন্দিরেই দাফন করা হয়।
জনপ্রিয়তা
দ্য প্যালেইস আইডিয়াল যুগ যুগ ধরে প্রচুর দর্শণার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনকি প্রাসাদটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই এর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছিলো। প্রাসাদটিতে মাঝেমধ্যেই বিখ্যাত সব গায়কেরা তাদের কনসার্টের আয়োজন করতেন। ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তখন পর্যন্ত স্মৃতিস্তম্ভটিতে পুরো বিশ্বের প্রায় ১,৫১,০০০ মানুষ ভ্রমণ করেছে। ১৯৬৯ সালে প্রাসাদটিকে ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। প্রাসাদটি ভ্রমণে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৬.৫০ ইউরো এবং ৬-১৬ বছর বয়সীদের জন্য ৫ ইউরো করে খরচ পড়ে। তবে শেভালের নিজের তৈরি সমাধিক্ষেত্র সকলের জন্য উন্মুক্ত।
প্যালেইস আইডিয়াল ঘুরতে ঘুরতে মাঝেমাঝেই এটির দেয়ালে শেভালের লিখে যাওয়া অনেক লিপি পাওয়া যায়। এরকম একটি হলো, “দ্য ড্রিম অফ ওয়ান ম্যান”।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct