ফৈয়াজ আহমেদ : লাল গ্রহ মঙ্গলে মরু ভেদ করে হন্যে হয়ে ঘুরছে রোভার। রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করছে প্রাণ অন্বেষণে। সেসব মুহূর্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি কিলোমিটার দূরে পৃথিবীতে বসে উপভোগ করছি। ঘর থেকে বের না হয়েও সড়কে যানজটের ধারণা পাচ্ছি; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত ভিজুয়ালি সফর করছি বাড়িতে থেকে। এর সবই সম্ভব হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথে পরিভ্রমণরত স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে। শুধু কি তাই! পৃথিবীর কোথায় মানুষকে আটকে রেখে শ্রমদাসে পরিণত করা হয়েছে; কোথায় বৃক্ষ নিধন করে প্রকৃতি উজাড় করা হচ্ছে; সবই জানাতে পারছে এই কিউবস্যাট। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রায় আমাদের গ্রহকে বদলে দিতে নীরবেই ভূমিকা রাখছে যন্ত্রগুলো। এর মধ্যে কিছু আছে জুতার বাক্সের মতো ছোট, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকৃতির কারণে এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে কিউবস্যাট। বর্তমানে সহস্রাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।
মহাশূন্যে অনুসন্ধান, ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস, নজরদারি, গুপ্তচরবৃত্তিতে সহায়তা করে সভ্যতার পরিবর্তনে অবদান রাখছে উপগ্রহগুলো। এর মধ্যে ছয়টি কিউবস্যাট পৃথিবীকে বদলে দিতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করছে, যার অন্যতম যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটির দ্য রাইটস ল্যাবের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অংশ হিসেবে আধুনিক বিশ্বের দাস প্রথার চিত্র তুলে ধরতে খুদে স্যাটেলাইটের ছবি ব্যবহার করে আসছে দ্য রাইটস ল্যাব। সংস্থাটি গোপনে বিশ্বের কোথায় কোথায় বল প্রয়োগে মানুষকে বিনা পারিশ্রমিক বা পেটে-ভাতের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তার তথ্যও প্রকাশ করে থাকে।
সম্প্রতি সংস্থাটি গ্রিসের একটি অস্থায়ী শিবিরের ছবি সংগ্রহ করেছে কিউবস্যাটের মাধ্যমে। যে শিবিরে এক দল বাংলাদেশিকে বাগানে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করার কাজে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের বসতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বদলে যায়, তা দেখতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয় বলে জানান প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক ডোরিন বয়েড। তিনি বলেন, ওই শিবিরের প্রকৃত চিত্র জানতে স্থানীয় একটি এনজিওর সহায়তা নেওয়া হয়, যারা বাংলাদেশিদের বসতি ঘুরে দেখেছে এবং সেখানকার মানবেতর জীবনযাপন পরখ করেছে। তারা সেখানে অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে শুধু থাকতে দেওয়ার শর্তে তাদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে, তার বিশদ জানতে পেরেছে। ওই এলাকায় এ ধরনের অন্তত ৫০টি শিবির আছে।
বৃক্ষনিধন রোধ: কিউবস্যাট ব্যবহারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হলো প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা কর্মসূচি। নরওয়ে সরকার বিশ্বে বৃক্ষনিধন রোধে ‘প্ল্যানেট’ নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে। কোম্পানিটি পৃথিবীর কক্ষপক্ষে দুইশর মতো স্যাটেলাইট বসিয়েছে। এগুলো উচ্চক্ষমতার ক্যামেরা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাদের গ্রহের ছবি তুলছে। এর মধ্যে ৬০টি দেশের প্রাণ-প্রকৃতির ওপর নজর রাখার জন্য নরওয়ে সরকার অর্থ দেয় বলে জানিয়েছেন প্ল্যানেটের সিইও উইল মারশাল। তিনি বলেন, ক্রান্তীয় অঞ্চলের এসব দেশের বন মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত সতর্ক করা হয় কোথায় কোথায় বৃক্ষনিধন হচ্ছে। বন উজাড় করার ওপর কৃত্রিম উপগ্রহের সংগ্রহ করা তথ্য ও সংশ্নিষ্ট দেশগুলোর বৃক্ষনিধন রোধে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করে নরওয়ে সরকার পদক্ষেপ নেয় তাদের অর্থ সহায়তা দেবে কি দেবে না।
বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর ওপর নজরদারি: বন্যপ্রাণী প্রাণ-প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও বন উজাড়, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ নানা কারণে অনেক প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার পথে। এগুলোর বংশ রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে ইতালি ও কেনিয়ার এক দল শিক্ষার্থী। তারা ওয়াইল্ডট্র্যাককিউব-সিমবা নামে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। কিউবস্যাটটির মাধ্যমে কেনিয়ার ন্যাশনাল পার্কের পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর নজর রাখা হয়। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের নানা দিক দিয়ে দ্বন্দ্ব আছে এবং এগুলো খুবই বাস্তবসম্মত বলে মন্তব্য করেছেন নাইরোবির শিক্ষার্থী প্রকৌশলী ডেনিয়েল কিয়ারিয়ে।
তিনি বলেন, হাতি বনের আশপাশের কৃষকদের ফসল নষ্ট করে, সম্পত্তির ক্ষতি করে; এমনকি মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এতে হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বন্যপ্রাণীদের চলাফেরার ওপর নজর রেখে তাদের গতির ব্যাপারে আশপাশের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে গ্রামবাসী সতর্ক হতে পারে। আগামী বছর বন্যপ্রাণীর অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে রেডিও ট্যাগ ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে প্রাণীর শারীরিক অবস্থা এবং হত্যা করা হলে সেই তথ্যও পাওয়া যাবে।
মহাশূন্যের আবর্জনা অপসারণ: কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠানো হয় সভ্যতার কল্যাণের জন্য। কিন্তু এগুলো এক সময় বিপর্যয়ের কারণও হচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এতে কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহের সহস্রাধিক টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকম হাজারো আবর্জনার টুকরো শনাক্ত করা গেছে। আকারে ছোট টুকরোগুলোও একটি স্যাটেলাইট ও নভোচারীবাহী মহাকাশযানকে ঝুঁকিতে ফেলার জন্য যথেষ্ট। সমস্যাটি সমাধানে অনেক দূর এগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
উইন্ড টারবাইন মেরামত: বিশেষ ধরনের ইন্টারনেট সেবা দিতে আমাদের মাথার ওপর স্যাটেলাইটের বহর সাজানো আছে। এগুলো ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্দিষ্ট বস্তুর সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উইন্ড টারবাইন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সহজলভ্য এই পদ্ধতিতে বায়ুশক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তর করা হয়। কিন্তু টারবাইনগুলো বসানো হয় দুর্গম এলাকায়, যা নষ্ট হয়ে গেলে জানার উপায় থাকে না, আবার নিয়মিত তদারকিও সম্ভব নয়। তাই পিং সার্ভিস নামে কোম্পানি একটি সেন্সর তৈরি করেছে। এটি টারবাইনের শব্দ পর্যবেক্ষণ করে। ব্লেডের কোনো ক্ষতি হলে বা শব্দে পরিবর্তন এলে তাৎক্ষণিক তা টারবাইনের পরিচালককে জানিয়ে দেয়। এখানে মধ্যস্থতা করে একটি কিউবস্যাট।
মহাশূন্যের গভীরে অনুসন্ধান: কিউবস্যাট শুধু কক্ষপথ থেকে নিচের দিকে পৃথিবীর খবরই রাখে না বরং তাকিয়ে আছে নক্ষত্ররাজির দিকে। অনুসন্ধান চালাচ্ছে মহাশূন্যের গভীর থেকে গভীরে। তথ্য দিচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি থেকে শুরু করে অজানা গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ প্রভৃতি মহাজাগতিক সৃষ্টি সম্পর্কে। সংযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে ভিনগ্রহে অনুসন্ধানরত রোভারের সঙ্গেও। এ ধরনের কিউবস্যাট প্রথম ২০১৮ সালে মহাশূন্যে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। সংস্থাটি আগামী বছর আরও ১০টি কিউবস্যাট কক্ষপথে পাঠাবে, যা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রাণ ও পানির মজুদ নিয়ে অনুসন্ধান চালাবে। আর এ সবকিছুই হলো একটি প্রকল্পের অংশ, যা মানুষকে চাঁদসহ ভিনগ্রহ-উপগ্রহে এক দিন বসতি গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।
শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ১৯৯৯ সালে প্রথম খুদে স্যাটেলাইট আবিস্কার করেন বব টুইগস।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct