কাশ্মীর মানে ভূস্বর্গ। কাশ্মীর মানে এক উদাস স্বপ্নে ভেসে আনন্দে বিভোর হওয়া। কাশ্মীর মানে সাদা বরফের ঢাকা প্রান্তর, সবুজ ঢাকা অথবা উলঙ্গ উচ্চ পাহাড়। এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যভরা স্বর্গ কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর মানে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীবাদীদের হামলা-মৃত্যু অথবা সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে মৃত্যু। সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের-অনুপ্রবেশকারীদের হামলা, কত শত মায়ের পুত্র, কত স্ত্রীর স্বামী, কত পুত্রকন্যার পিতার রক্তাক্ত দেহ অথবা সেনাবাহিনীর এ কে ৪৭-এর গুলির শব্দ। কাশ্মীরের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি পাহাড় পর্বত উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমনই আতঙ্ক। সম্প্রতি কাশ্মীর উপত্যকা ঘুরে এসে নিজের সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এস এম শামসুদ্দিন। আজ শেষ পর্ব।
কাশ্মীর নিয়ে নানান জনের নানান ভাবনা - ব্যাখ্যা ।কিন্তু কাশ্মীর আছে কাশ্মীরেই। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ মনে করে ভারত আমার দেশ। যে দেশে তাঁরা স্বাধীনভাবে বেঁচে আছে ব্যবসা বাণিজ্য ধর্মসাধনা অধিকার নিয়ে মাথা তুলে জীবন সংগ্রামে বেঁচে আছে। দোকানদার থেকে শিকারা চালক।আটো চালক ,ফেরিওয়ালা ,শালওয়ালা, শীতবস্ত্র ব্যবসা হোটেল মালিক, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যবসায়ী, ভেড়া ছাগল পালক থেকে চায়ের দোকানের মালিক। গাড়ির চালকদের সাথে কথা বলেছি তাঁদের একই কথা জীবন সংগ্রামে তাঁদের লড়াই করেই পরিশ্রম করে বাঁচতে হয় ।বিশেষ করে কাশ্মীর ভ্রমণ স্থল ।সেখানকার ব্যবসা মূলত নির্ভরকরে পর্যটকদের উপর নির্ভরকরে।পর্যটকদের উপর নির্ভর করে বাজারের নানান দ্রব্যের উঠা নামা। সে ক্ষেত্রে বহুল জনসংখ্যার দেশ ভারত । বছরের প্রায়ই সময় পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে ।আমরাও তাকিয়ে থাকি পর্যটকদের আসা যাওয়ার দিকে ।এখানকার যাঁরা এলিট শ্রেণী শাসক রাজনীতিক তাঁরা ক্ষমতা ধরে রেখে আপন আপন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত স্বর্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত থাকে ।কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সংগ্রামে শাসক পরিবর্তনে তাঁদের বীতশ্রদ্ধ মনোভাবের প্রকাশ দেখেছি।
মেহবুবা মুফতির বি জে পি র সাথে সাথে দিয়ে ক্ষমতা দখলের এই চেষ্টাকে কাশমিরবাসী ক্ষমতা দখলের ও স্বর্থসিদ্ধির উজ্বল উদাহরণ ভাবে তেমনি ফারুখ আব্দুল্লাহ ও তাঁর পুত্র ওমর আব্দুল্লাহর রাজ্য শাসনে জনহিতকর বিমুখ শাসনের উদাহরণ আনে।
ইমরান দারুচ এক কম্বল ব্যবসায়ী মনে করে আরে ভাই ইসসে পেহলে কোয়ি কাম কারনেকে লিয়ে ঘুষ নেহি ডেনেসে এক ভি কম নেহি হতাথা ,আউর আজ বেগাইর ঘুষ ডেকে কম হয় রাহা হ্যায়।
কাশ্মীর মনে ফারুক আব্দুল্লাহ বা মেহবুবা মুফতি ,গোলাম নবী আজাদের নাম উঠে আসে।
কিন্তু সাধারণ কাশ্মিরবাসীর মধ্যে থেকে উঠে আসা সাধারণ কোনও রাজনীতিক যদি উঠে আসে তাহলে সাধারণ মানুষের সমস্যা দুঃখ দুর্দশার সমাধানে সচেষ্ট হবেন বলে তাঁরা মনে করে ।কিন্তু তেমন কোনও সম্ভাবনা তাঁরা দেখছে না।
হোটেল নুরমোহলে আমরা দ্বিতীয় রাত্রি কাটিয়ে সকালেই জম্মুর কাটরা যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম ।কাটরা পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘন্টা।কাটরা মূলত হিন্দু প্রধান এলাকা ।বৈষ্ণবদেবী মন্দির দর্শনের জন্য অসংখ্য তীর্থযাত্রী যান। ববৈষ্ণব দেবী মন্দির পৌঁছাতে আর একঘন্টা সময় লাগবে।রাস্তার ধারে এক হোটেলে আমাদের বাস থেমে গেলো ।অমরেশ দা ও তাঁর সঙ্গী পাচক গণ আমাদের জন্য ভাত ও মুরগী ডাল চাটনি পরিবেশন করে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন ।বৈষ্ণব দেবী এলাকায় কোত্থাও মাছ মাংস চলে না । সম্পূর্ণ নিরামিষ এলাকা। তাই আগেই আমাদের ভূরি ভোজ করে দিলেন ।আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের জন্য বুকিং করা পাহাড়ের নীচে এক হোটেলে। পাহাড় ঘেরা এক মনোরম শহর কাটরা ।হোটেলে যে যাঁর রুমে লাগেজ রেখে আমরা হোটেলের ছাদে উঠে দেখলাম পাহাড়ের চূড়ায় বৈষ্ণব দেবীর মন্দির ।তখন সন্ধ্যা নেমেছে ।আঁকা বাঁকা ভাবে অসংখ্য আলোর লাইন চলে গেছে পাহাড়ের চূড়ায়।পাশে পটলা ডা বললেন ওই পাহাড়ের মাথায় যে লাল মতো আলো দেখছেন ওটা অর্ধেক রাস্তা আর এই আলোর সারিগুলো হলো যাওয়ার পথ ।
আমাদের সাথী সঙ্গী বাচ্চা থেকে বয়স্কা সকলেই সেই মন্দিরে দেবী দর্শনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ।শুধু আমরা ৮-৯জন যাবো না ।অনেকে রাত থেকেই যাওয়া শুরু করেছে ।পাহাড়ি পথ এক সময় যেটা ছিল দুর্গম দুস্কর সেই পথ এখন খাঁজ করা টাইলস বিছানো পথ মাথায় ছাউনি ।পাশে পাশে আছে বিশ্রামাগার ।ঠান্ডা পানীযের ব্যবস্থা ।মাঝে সাঝে ঘোড়ার চড়ে যাওয়ার জন্য ঘোড়া কচোয়ান, ছোট ছোট ঠেলে গাড়ি ও।আগে যেটা চড়াই উৎরাই পথ ছিল এখন সেটা যাত্রীদের সহজে ওঠার জন্য কম উচ্চতায় স্লোপিং করে বাঁধানো পথ ।
কেউ কেউ সন্ধ্যায় হাঁটা শুরু করে ফিরে আসছে সকালেই ।আমরা হোটেলের ছাদে উঠে রোদের উজ্বল আলোয় দেখলাম সেই পথ আর মানুষের আনাগোনা। অনেকেই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে টলে টলে শরীরের বোঝা টেনে হিঁচড়ে যেন আসছে হোটেলের দিকে ।ওহ ! এতটা পথ ,হাওড়ার পঞ্চানন তলার রাহিলের প্৬৫বছর প্রায় বয়সের বৃদ্ধা মা অথবা অমরেশ এর ভাই এস বি আই এর ম্যানেজার তাপস ধাড়া ওর স্ত্রী ও ছোট মেয়ে যখন দেখলাম এতটা পথ পার করে এলো তখন আশ্চার্য লাগলো বৈকি ।ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে কতটা গভীর আন্তরিকতা থাকলে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া যায় সেটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম ।
একশ শতাংশ মুসলমান এলাকা মক্কা মদিনা অথবা বাংলাদেশ ঘোরা ফেরার সময় কি আমার মনে কোনও খুশি ,আনন্দ অথবা উজ্জীবিত হয়েছিলাম কি স্মরণ করলাম ।না এমনটা কিন্তু উপলব্ধি হয়নি ।কিন্তু একশ শতাংশ হিন্দু ধর্মালম্বী এলাকায় বিশেষকরে ধর্মস্থানে ঘোরাফেরা করা ও রাত্রিযাপন করা নিয়ে একটা অজানা শঙ্কায় ছিলাম বৈকি ।হোটেলের ছাদ ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেড়দিন কাটলো ।আমরেশদা বলল যাঁরা ধর্মপালন করে তাঁরা সাম্প্রদায়িক হয় না ,পরোধর্মসহিষ্ণু হয় ।তা বটে সত্য ।এখানে কেন পৃথিবীর যে কোনও ধর্মস্থানে যাঁরা যান তাঁরা পবিত্র মনেই যান ,সেখানে হিংসা বিদ্বেষ থাকেনা ।থাকে উদারতা ভালোবাসা মায়া মমতা মানুষকে ভালোবাসা ও প্রেম ।নিজ আত্মা ও মনকে পুত পবিত্র করতে ধর্মসাধনালাভ করতে মগ্ন থাকে ,তা ঠিকই।কিন্তু যেভাবে একটা শ্রেণী গেরুয়া করন করে রাজনৈতিক ধর্মাচরণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে তাতে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়াটা অমূলক নয় ।কখন কি হয় অবস্থা ।যাইহোক আল্লার নাম নিয়ে বিকালে কিছু কেনাকাটা করতে বের হলাম ।বোরখা পরা মাথায় স্কার্ফ পরেই স্ত্রী ও বোন, বোনের দুই মেয়ে নুজহাত আরা জামাল। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিজিওলজিতে এম এস সি ,পি এইচ ডি করছে ,বোনের জামাই ডা মেহবুব ,বোনের একমাত্র ছেলে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এম এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছোট ছেলে লামানকে নিয়ে বের হলাম । বেশ টুকিটাকি কাপড় ,কম্বল কার্পেট কিনতে কিনতে কাটরা শহরের অনেকটাই ঘুরলাম ।ধারণা আর অমূলক ভয় জএ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় উপলব্ধি করলাম ।পরদিন সকালে হোটেল থেকে আটো ধরে আমরা গেলাম কাটরা স্টেশনে ।প্রতি ১৫-২০ মিনিট ছাড়া হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে আসছে । যাঁরা বৈষ্ণব দেবীর দর্শনের জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারবে না তাঁদের ওই চূড়ায় পৌঁছে দিতে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। অনলাইনে ওটা বুক করতে হয় ,ভাড়া দু থেকে তিন হাজার টাকা ।
কাটরা স্টেশনটি বেশ বড়ই।আমরা যথা সময়ে ট্রেন এলো।আমাদের ট্রেন রিসার্ভেশন বগিতে গিয়ে উঠলাম ।জম্মু তাওয়াই ট্রেনে এবার ফেরার পালা কলকাতা ।
রাত্রি ৯টার ঠিকঅনেক আগেই স্টেশনে এলো এক্সপ্রেস ট্রেন।আমরা যে যাঁর লাগেজ নিয়ে উঠে গেলাম যে যাঁর নির্দিষ্ট কামরায়। এতো বাজে ট্রেন আর হয় না।ভ্রমণ আমার অন্যতম নেশা ।সময় সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়েছি দেশ বিদেশে।গত পাঁচ সাত বছরে এসি টুটায়ার ও প্লেনে যাই।বহু দিন দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাওয়া হয় নি তারপর আবার এ সি হীন ।বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় গল্প অজানা মানুষ তাদের সংগ্রাম জীবন যাপন খ্যদ্যাভ্যাস জানা যায় এই দ্বিতীয় শ্রেনীতে গেলে। গাড়িতে ওঠার আগে স্টেশনে দেখেছি লুঙ্গি পরে ব্যাগ কাঁধে অথবা মাথায় বাক্স নিয়ে অসংখ্য মানুষকে। নিশ্চিত এরা বাংলার বলে মনে হলো।
ট্রেনে চড়ে দেখলাম ওদের অনেকেই আমাদের কয়েকটা সিট পরে বসে। কয়েকজনকে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি নাম বলল হামিদুর রহমান।শেখ সামীর আরো অনেকে ওদের সঙ্গে।
বাড়ি কোথায়, বললো উত্তর দিনাজপুর।
উত্তর দক্ষিণ দিনমজুর ।মালদাহ মুর্শিদাবাদ নদীয়া জেলার অসংখ্য মানুষ দিন মজুরের কাজে যায় কাশ্মীরে।আপেল বাগান।আখরোট বাগান।ধান কাটার কাজে বা যদি থেকে বালি তোলার কাজে।
উত্তর দিনাজপুরের গোয়াল পোখরের শেখ শাহনেওয়াজের কোথায় কোমসেকওম প্রায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ প্রতিবছর কাশ্মীরে আসে কাজ করতে। আমাদের পাশের এলাকায় কদিন আগে কয়েকজন বিহারের মানুষকে সেনারা গুলিকরে মেরেছে ।সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে । আমরা যাঁর অধীনে কাজে আসি তিনি বললেন এখন তোমরা দেশে ফিরে যাও অবস্থা ঠিক হলে আসবে।তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি । বছরের মাঝে সাঝে এইরকম সেনাদের হাতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে দিন মজুরের কাজে আসা মানুষেরমৃত্যু হয় সেনাদের গুলিতে । ভারত সরকারের সর্বাধিক রাষ্ট্রীয় আয় আসে ট্রেন থেকে সেই ট্রেনের যাত্রীপরিষেবা অপরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা ,টিকিট ও রিসার্ভেশন ছাড়াই দিব্বি ট্রেন চড়ার দুরাবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
দীর্ঘ পথ প্রায় ৪৬ঘন্টা পরে আমরা নামলাম কলকাতা স্টেশন তথা চিতপুর স্টেশনে প্রায় নেশাখোর মাতালের মতই। কাশ্মীর ভ্রমণ আমার ভ্রমনতালিকার এক উজ্বল স্থান দখল করে থাকবে সময় সুযোগ পেলে আবারও ফিরে যাব ওই স্বর্গীয় সুখ লাভের লোভে। পরকালীন জগতে স্বর্গলাভ করব কি না জানিনা ।কিন্তু নাগালের মধ্যে এই স্বর্গে আবার যাওয়ার তীব্র বাসন রইলো শয়নে স্বপ্নে বাস্তবে ।
(শেষ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct