আজিজুল হক,নেতড়া,আপনজন: বয়স হয়েছিল বছর ৮১ । সমগ্র জীবনটাই কেটেছে কবিতা চর্চার মধ্য দিয়ে। আপাদমস্তক ছিল কবিতা ভাবনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিতা রচনায় ছিলেন ব্যস্ত। অবশেষে আপন রবের ডাকে শনিবার গভীর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তিনি হলেন-‘নকীব’ ও ‘আরব বাগের ফুল’গ্রন্থ প্রণেতা কবি এম এম আশরাফ। লিখতেন চাচা মুখার্জি ছদ্মনামে।
ওইদিন উস্তি থানার কারবালা কোরআনিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। অংশ নেন বিভিন্ন এলাকার গুনি মানুষজন। অতঃপর তাদের পৈত্রিক কবরস্থানে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা ছায়া তলে সমাহিত করা হয়।
তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন প্রবীণ সাহিত্যিক আলহাজ্ব এম মনিরুজ্জামান, কবি আবুল বাসার হালদার, জাহাঙ্গীর দেওয়ান, বাংলার রেনেসাঁ প্রকাশিকা সাবানা খাতুন মিস্ত্রি, মগরাহাট পশ্চিম তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আক্তার হোসেন খোকন প্রমূখ।
এক স্মৃতিচারণায় ‘উপমহাদেশের মুসলমান’ গ্রন্থ রচয়িতা আলহাজ্ব এম মনিরুজ্জামান জানান, তাঁকে দীর্ঘদিন চিনতাম। তাঁর লেখা কবিতা ছড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দীর্ঘদিন দেখে এসেছি। তাঁর কবিতা ,ছড়া , গজল সরল ও কাব্যিক ছিল। তাঁর লেখনীর মধ্যে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হত। তার প্রতি আন্তরিক দুঃখ ও সমবেদনা রইলো। কবিতার প্রতি ছিল তাঁর দরদ। রাগ বসতো পরিবারের সদস্যদের কেউ চুলোতে তাঁর লেখা কবিতার পান্ডুলিপি ফেলে দেওয়ায় প্রতিবাদ নয়, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন কবি।
পরবর্তীতে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসে এ বিষয়ে ব্যক্ত করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন বছর ৮১ বছর বয়সের কবি এম এম আশরাফ। তিনি স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর প্রতি দয়া করেছেন। গত বছর আম্ফান ঝড় বিধ্বস্ততার সময় তিনি ছিলেন এতেকাফে। বাড়িতে এসে দেখেন ঝড় বিধ্বস্ততায় বাড়িঘর ওলটপালট হলেও তার সাধের বইপত্র ও পান্ডুলিপি ঠিক ছিল।দুর্ভাগ্য বেহুঁশ মানুষের আচরণে। শারীরিক অসুস্থতার থেকে তাঁকে বিশেষ ভাবে পীড়া দেয় তাঁর সৃষ্টিশীল গ্রন্থাবলীর পান্ডুলিপি যখন বাড়ির সদস্যরাই বেকার জিনিস মনে করে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে। অনেক সময় অনাহারে দিন কেটেছে তবু তার আক্ষেপ নেই। বুক ফাটা একরাশ যন্ত্রনা আরাম-আয়েশকে তুড়ি মেরে কত রজনী জেগে রচনা নানান লেখনি র পান্ডুলিপি তার অগোচরে পুড়িয়ে দেওয়ায়।
অনেকদিন পর এসেই তিনি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার রেনেসাঁর জন্য সাম্প্রতিক ভাবনায় রচিত কয়েকটি ছড়া কবিতা। চা আপ্যায়নের পাশাপাশি তার হাতে তুলে দিলাম আমার রচিত দুটি গ্রন্থ ও সদ্য প্রকাশিত বাংলার রেনেসাঁর রসূলুল্লাহ স সংখ্যা। আমার লেখনীর সৃষ্টি অব্যাহত দেখে তিনি হলেন খুশি।
আবেগাপ্লুত হয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আমার উদ্দেশ্য বললেন-তোমার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ বছর তিরিশ আগে। সেদিনই বুঝেছি আমার ঘরের উঠেনর ফুল গাছে দেখছি একটি পাখি। এ পাখি ডানা মেলে অনেক দূরে যাবে। এ কথা অনেক আগে লিখেছি আমার লেখনিতে।
এম এম আশরাফ ওরফে চাচা মুখার্জি এক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। কেবল কবি ও ছড়াকার হিসেবে ছড়া কবিতা রচনায় নয় ;গল্প ,উপন্যাস, রম্য রচনা, জীবনী সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর পদাচারণ। তিনখানা বই প্রকাশ পেলেও লিখেছেন অজস্র পত্রপত্রিকায়। তাঁর তিন গ্রন্থ-শিরিন , নকীব ও আরব বাগের ফুল গ্রন্থাবলী জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
দারিদ্রতা তাঁর জীবন সঙ্গী। ৮০ বছর বয়সে লিখে চলেছেন বিনা চশমায়। শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত এপার বাংলা ওপার বাংলা পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মজীবনে ছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ছিলেন জনপ্রিয় স্বর্ণ শিল্পী। বঙ্গীয় স্বর্ণ শিল্পী সমিতির শিবপুর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়া তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন বানেশ্বরপুর গ্রামীণ হাসপাতাল এর স্বাস্থ্য সহায়ক সমিতি সি এন জি র প্রেসিডেন্ট। ছিলেন কারবালা বিদ্রোহী সংঘের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট। বাম জমানায় তিনি পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য পদে থেকে সাব কমিটির সদস্য হন পূর্ত দপ্তরের।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct