সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১০ কিস্তি ২
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
জিৎ হাসল বাধ্য হয়ে। বুঝতে পারল, তলিয়ে যেতে যেতে মিস্টার বসু কত সহজে না জিতে যেতে পারেন। আর এতটুকু সময় নষ্ট করল না। সিড়ি পথে দ্রুত পায়ে গ্রাউন্ডফ্লোরে নেমে এল। ল্যাম্প পোষ্টের আলো জমে উঠেছে। জিৎ জোরে জোরে পা চালিয়ে সামনে হেঁটে চলল। নতুন একটা প্রত্যাশা তার হৃদয়-সমুদ্রে ডলফিন মাছের মতো লাফ দিচ্ছে। বাড়িতে ফিরে এলেও মনের স্বস্তিতে স্থির হয়ে থাকতে পারল না। পর পর প্রহরগুলো বুকের গভীরে নতুন আশা সঞ্চার করে চলেছে। পরের দিন সকালে একটু বেলাতে ঘুম ভাঙল। সূর্য তখন বাঁশগাছের পরে উঠে গেছে। সবুজ মাঠের বুকে আলোর ছড়াছড়ি। জিৎ হাত মুখ ধুয়ে টিফিন খেয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল। ভদ্রলোক কোথাও বের হয়ে পড়েন নি তো? বাড়িতে ঢুকে দেখল, ভজহরি ভীষণ অগ্নিশর্মা হয়ে একমাত্র ছেলেকে ধমকে চলেছেন, শুধু টিভির সামনে বইস্যা বইস্যা লোকসান করুম না। পইর্যা পইর্যা নিজের গ্রেড ধইর্যা সবাইকে পরাভুত কইর্যা দে।
রেগে গেলে ভদ্রলোক এমনি করে পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলেন। জিৎনমস্কার জানিয়ে বলল, আপনার কাছে এসেছি।
কিছু কইবার থাকে তো কইয়্যা দ্যান্।
পিংপং বসু আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
ভজহরি বাক্যবান থামিয়ে জিৎকে একটু দেখে নিলেন। মুখের বলিরেখায় সন্দেহের গভীর ছাপ। প্রত্যেকবার পিংপং তপনকে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে। আজ আবার নতুন করে এই ছেলেটি কেন? ভিতরে কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো? ভজহরির মনের তলানিতে সেই সন্দেহ মন্দগতির বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলল।
জিৎ আবার বলল, আজ দুপুরের মধ্যে পিংপং বসু আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আপনার সাথে কথা বলতে চান।
বুঝতে পারতাছি।
সেজন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন।
ভজু ছেলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন, শুনতাছিস, আমাকে কে ডাইকাছেন? আমি উহাকে ফ্যানটাসটিক্স মানুষ কইয়া থাকি। কাছে যাইলে মজা পাইবা মনে। পৃথিবীটাকে হাতের তালুতে ধইর্যা রাইখ্যাছেন।
একমাত্র ছেলে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে বাবার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিলছিল। জিৎ আবার জিজ্ঞাসা করল, তাহলে যাচ্ছেন তো?
কী কইতাছেন হে ছোকরা? কেন যাইবু না? বসুকে দেইখ্যা আমার প্রার জুইর্যা যায়।
তাহলে এখন আসছি কাকু।
চা বিস্কুট খাইব্যা না?
একটু আগে খেয়েছি। আবার কেন?
ঠিক কথা কইত্যাছ ছোকরা। লিভারটাকে ঠিকঠাক রাইখ্যা চইল্যা যাও, টিইয়্যা যাইবা।
জিৎ সদর্থক মাথা নেড়ে পিছনে হাঁটতে শুরু করল। তাকে রফিকের সাথে দেখা করতেই হবে। সেটাও খুব জরুরী। পিংপং বসু জোর দিয়ে বলেছেন, যে কোনো মূল্যে তার সাথে রফিককে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে হবে। পায়ে পায়ে গেটের বাইরে এসে শুনতে পেল, ভজু ছেলের উদ্দেশ্যে বলছেন, এমনি যন্তর মন্তর কথা কইয়্যা ঝামেলা চ্যুইকা দাও, ট্যাঁকে টিইক্যা যাইবা।
জিৎ হাসতে বাধ্য হল। ভারি মজাদার মানুষ। কী ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। ঠিক সময়ে নিজেকে অনেক বড়ো বলে ভাবতে পারেন। অন্যেরা তাতে কতটা লজ্জা পেল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। এভাবে ভাবলে যে নিজের গ্রেড ধরে রাখা সম্ভব নয়, তা ভজহরির চেয়ে কেউ বেশি জানেন না।
বারান্দায় বসে ভজ সেই ভাবনায় ডুবে থাকলেন। চিন্তার গ্রাফ নানান সূত্রে ভেসে উঠেছে। পিংপং বসু নিশ্চয় তাকে কোনো অর্থকরী দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন। আগের অনেক দৃষ্টান্তে একই বাস্তবতা দেখা গেছে। এতদিনের সফলতার কারণগুলো পর পর ভেসে উঠতে লাগল তার মনের ইজেলে। কেবল ভাবছেন, নতুন অবস্থার সুযোগটুকু তাকে গ্রহণ করতেই হবে। ব্যস্ত হয়ে ডাকতে শুরু করলেন, কই গো, গেলে কোথায়?
আমি রান্নাঘরে, কী বলছ বলো?
আমাকে এক্ষুণি বের হতে হবে।
এত তাড়া কেন? কোথায় যাবে?
পিংপং বসু ডেকে পাঠিয়েছেন।
খেয়ে যাবে না?
সেকথাই ভাবছি।
তাহলে আধঘন্টার মধ্যে রান্নার কাজ সেরে ফেলছি। তুমি ততক্ষণ স্নান সেরে নাও।।
ভজহরি একটু হাসলেন। অন্য আরেকটা গর্বে তার বুক ভরে উঠল। ভালো মেয়েমানুষ জুটেছে তার কপালে। কোনো কথায় না নেই। ভালো তাল ঠুকতে জানে। স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখে নিলেন। জামা প্যান্ট পরলেন। বাইরে গেলেই ভজকে কড়কড়ে ইস্তিরি জামা প্যান্ট পরতে হয়। আবার তাড়া দিলেন, আর বাকী কত?
কটায় বের হবে?
দশটার দিকে।
তাহলে এত তাড়া কেন? সবে তো সাড়ে আটটা।
ভজহরি নিজের উপর একটু বিরক্ত না হয়ে পারলেন না। দেওয়াল ঘড়িতে চোখ না রেখে অকারণে মলিনাকে একটু বেশি তাড়া দিয়ে ফেলেছেন। রাগ দেখিয়ে দেওয়াল ঘড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখতাছি, এ ঘড়ি ঘুমের তালে চলতাছে। পিংপং বসুর সাথে দেখা করার জন্যে ভজুর ভিতরে বৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে।এত বড়ো সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দ্রুতপায়ে চলতে চলতে আনমনে গান ধরলেন—
মন ভজ রে লইয়া যাও বিদেশে
গ্রেড পাইমু, রাজা হইমু হামাগো দেশে।
সূর্যের তেজ বাড়ছে তর তর করে। ভজহরির ভিতরের শক্তিও বাড়ছে। বিদেশী সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাকেও সূর্য হয়ে উঠতে হবে। পিংপং ডেকেছেন যখন, তখন নিশ্চয় পকেটে নতুন পাওনা ঢোকার সুযোগ রয়েছে। প্রাপ্তির মোহ দুর্বার হয়ে উঠল তার ভিতরে। বাসে মিনিট কুড়ি যাওয়ার পরে নির্দিষ্টস্টপেজে নেমে আরেকটু হেঁটে রঙিন বাড়িটারসিঁড়ি পথে উপরে উঠতে লাগলেন। বেডরুমের সামনে গিয়ে দেখলেন, সামনের দরজা হাট করে খোলা। তবুও কলিং বেল টিপে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিলেন। মিস্টার বসু সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, প্লিজ, ভিতরে আসুন।
সূর্যের মতো উজ্জ্বল মুখ নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন ভজু। জিৎ-এর মুখে শুনে চলে এলাম।
ঠিক শুনেছেন। ওই চেয়ারে বসুন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আপনার সাথে। একটু জটিল প্রসঙ্গ। জানি, আপনি পারবেন।
পিংপং বসুর আন্তরিকতায় ভজহরি গলে জল হয়ে গেলেন। লোকটা এমনিই। আচরণের মাধুর্যে যে কোনোলোককে একান্ত আপন করে নিতে পারেন। এই গুণটুকু আছে বলেই ভজহরিকে বার বার দুর্বল হয়ে পড়তে হয়।
পিংপং বসু চেয়ার সরিয়ে এনে ভজহরির পাশে বসলেন। একেবারে গা ঘেঁসে। —একটা অসাধ্য সাধন করতে হবে আপনাকে।
দায়িত্ব দিলে শেষ চেষ্টা করে দেখব।
রফিককে সাথে নিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে দুটো ভাগে ভাগ করে দিতে হবে। মানে বুঝতে পারছেন তো? I mean, ফ্যানটাসটিকসকে আশু বিপদ থেকে বাঁচাতে গেলে....।
বেশ বুঝতে পারতাছি।
আপনি তো রেগে গেলেই তবে এভাবে কথা বলেন। আজ থেকে মনে খুশি জাগলে এভাবে কইম্যু।
পিংপং বসু হোহো শব্দে হেসে উঠলেন। তাহলে শুনুন, কদিন পরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হচ্ছে। সেই সুযোগটুকু পাখির চোখ করে তুলতে হবে।
ভজহরি কিছু সময়ের জন্যে নিজের ভাবনায় থমকে থাকলেন। অর্পিতদায়িত্বটা পালন করা যে বেশ কঠিন কাজ, তা ভালোভাবেই বুঝে গেলেন। চেয়ে থাকলেন পিংপং বসুর দিকে। ভদ্রলোক নতুন নতুন ফন্দি আঁটায় পোক্ত মানুষ।
মিস্টার বসু আবার মুখ খুললেন। আমি কী আপনাকে মূল উদ্দেশ্যটা ঠিকমতোবোঝাতে পেরেছি?
ভজহরি মাথা নেড়ে নিজের উপলব্ধির কথা জানিয়ে দিলেন।
আমি জানি, আপনি অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারেন। প্রথম দিন থেকে গ্রামে গ্রামে প্রচারে শুরু দিন এই বলে যে মুসলিম মহল্লাগুলোতে যুবকরা দল বেঁধে টিভির সামনে বসে পড়েছে পাকিস্তানকে জেতাতে। তাতেই বারো আনা কাজ হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবেন, প্রচারের মাত্রা ভয়ানক চড়া না হলে এ টনিক সহজে মানুষকে গেলানো যাবে না। তেড়েফুঁড়ে প্রশ্ন তুলুন, এদেশে থেকে কেন ওরা বিদেশকে সমর্থন করবে? এক দেশের খাবে, আর অন্য দেশকে সমর্থন করবে কেন? এ মনোভাব কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। দেখবেন, চুম্বকীয় আকর্ষণে ঠিক ঠোকাঠুকি লেগে গেছে। আরেকটা প্রসঙ্গ সামনে আনতে পারলে সাতে সত্তর হয়ে যেতে পারে। অনেক বেশি সংখ্যায় একটা হ্যাণ্ডবিল হাটে বাজারে বিলি করে দিন যাতে অবশ্যই থাকবে মির্জাফরের সাথে মুসলিমদের তুলনা করে চোখা চোখা বাক্যবান। তবে সাবধান, জগৎ শেঠের প্রসঙ্গ ওই হ্যাণ্ডবিলে ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করবেন না। ক্ষমতা লাভ করার জন্যে মির্জাফর ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, তা আমরা সকলে জানি কিন্তু জগৎ শেঠের রক্তে ছিল বিশ্বাসঘাতকতার আদিম যোগসূত্র। নবাবের দরবারেমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই এদেশের সোনামণি মুক্তো ইংল্যাণ্ডে চোরাচালান করার জন্যে ইংরেজদের সাথে তার গোপন যোগসূত্র ছিল। গোলাপবাগের মধ্যে যে সুড়ঙ্গপথের নমুনা আজও রয়েছে, নবাব সিরাজের আমলে সেই সুড়ঙ্গ গঙ্গার সাতে যুক্ত হয়েছিল। মাঝপথে ছিল জগৎ শেঠের বাড়ি। ওই বাড়ির ভিতরে থেকে একটা গোপন রাস্তা ভিতরের সুড়ঙ্গের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। ভারতকে দূর্বল করে দেওয়ার জন্যে জগৎ শেঠের এ সুড়ঙ্গ ইতিহাস প্রসিদ্ধ একটা ঘটনা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct