সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১০ কিস্তি ১
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
দিনরাতের পালাবদলে মানুষের নিজস্ব জীবনদর্শন লুকিয়ে থাকে। দিনের শেষে রাতের যাত্রা শুরু। রাত শেষ হলে পূবের আকাশে নতুন সূর্য জানিয়ে দেয়, আরেকটা শুভ দিনের যাত্রা আরম্ভ হল। মানুষের জীবনে সুখ দুঃখের পালা ঠিক এভাবেই আসে। দুই বিপরীত ঋতুচক্রে আবর্তিত হতে হতে এক সময় জীবনের সমাপ্তি ঘটে অন্ধকার রূপকে সাথে নিয়ে। মাত্র ছ’’মাস যেতে না যেতেই সবার আগে পিংপং বসু সেই ঋতুচক্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। যিনি নিজের যোগ্যতা বলে জিৎকে ধরে সোপানের বুকে বিভেদের শেল ছুঁড়ে মারতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনিই ফ্যানটাসটিকস কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেলেন। পূর্বাঞ্চল শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে একবারও ভাবতে পারেননি যে এত বড়ো ঝড়ো বিপদ তার উপর এভাবে নেমে আসতে পারে। কিন্তু যা ভাবতে পারেন নি, তা কঠোর বাস্তবে ঘটে গেল।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে সমস্ত ড্রিঙ্কস এর উপর ল্যাবটেস্ট করানোর জন্যে বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই ল্যাবটেস্টে ফ্যানটাসটিকস কোল্ড ড্রিঙ্কস-এ কীটনাশক জীবাণুর সূত্র ধরা পড়েছে। এ খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছড়িয়ে পড়ার পরে একটা প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হল সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অঙ্ক কষে নেমে পড়েছে নিজেদের সমর্থন বাড়াতে। ইতিমধ্যে বিক্ষোভ দেখানোর পর্বও শুরু হয়েছে। রাজনীতির খেলা এভাবেই এঁকেবেঁকে চলে। এতদিন বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ে মানুষের মনে যে নানা চাপা ক্ষোভ জমা হয়েছিল, তা যেন বিস্ফোরণ হয়ে বের হয়ে আসছে ফ্যানটাসটিকস কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমনিই যে দেরীতে নামার জন্যে দুঃখ থাকলেও এই সুযোগে সুদে আসলে পুষিয়ে নিতে চায় তারা। জোয়ারের প্রবল স্রোতের মতো তাদের বিরুদ্ধ মতিগতি ক্রমে দুর্বার হয়ে উঠতে লাগল।
পিংপং বসু অফিসের মধ্যে বসে গম্ভীর হয়ে ভাবছেন। একটা নতুন সূত্র তাঁকে বের করতেই হবে কিন্তু কোনো পথ পাচ্ছেন না। মাথার ভিতরে ফ্যানটাসটিকস এর দ্রুত উন্নতি নিয়ে তার মধ্যে অনেক হিসেব ছিল, সে সব মুছে যেতে বসেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পর পর ফোন আসছে। কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। প্রতিটা সাবসেন্টার থেকে একটাই অনুরোধ ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে, প্লিজ, নতুন করে পানীয়ের গাড়ি পাঠাবেন না। যে মাল স্টকে আছে, তা বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছেনা। পরিস্থিতিক্রমে খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। উগ্র জনতার রোষে যেখানে সেখানে ফ্যানটাসটিকসকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর শুরু হয়েছে। তাদের দাবী, কিছুতেই এ ড্রিঙ্কস বিক্রি করা চলবে না।
ইতিমধ্যে হুগলিতেবিশেষ রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে একটা বড়ো আকারের বিক্ষোভ সমাবেশ শেষ হয়েছে। পিংপং বসু তা জেনে ফেলেছেন। সমাবেশে নাকি হাজার দশেক লোক হয়েছিল। সেখানে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কথা না থাকলেও ফ্যানটাসটিকসকে কেন্দ্র করে মানুষকে কাছে টানার নেশার মধ্যে ছিল পরোক্ষ রাজনীতির ছায়া। পিংপং বসুর কাছে সেটাই সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ হয়ে উঠল। আরও জানতে পেরেছেন যে এতদিন দলটার সমর্থন একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল, কোম্পানির বিপদকে কাজে লাগিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বসে নেই। তারাও কম বেশি লেগে পড়েছে। অঙ্ক কষে মিস্টার বসু বুঝতে পেরেছেন, আরও কয়েকদিন গেলে ফ্যানটাসটিকস এর বিক্রি নব্বই-শতাংশ কমে যাবে। বিক্রিবাটা না হলে কোম্পানির ভাঁড়ারে টান পড়বেই। সরল অঙ্ক হল, তার লাইফ স্টাইলকেও কেটে ছেঁটে ছোটো করে ফেলা হবে। শুধু তাই নয়, এভাবে চলতে থাকলে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলে থাকা মানুষজনের উপর কোম্পানির প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারে তলানিতে ঠেকে যাবে। সোপান নিয়ে নিজে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাও বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন না।
সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ভাবনার গভীরতায় ডুবে পিংপং ভুলে গিয়েছিলেন ঘরের সুইচ অন করে দিতে। ভিতরের আবছা অন্ধকার তার মনের দুর্ভাবনার সাথে তাল ঠুকছে। জিৎ ঘরে ঢুকে বলল, একি, এখনও আলো জ্বালান নি?ফ্যান বন্ধ রেখেছেন কেন?
পিংপং বসুর মুখে কোনো উত্তর নেই। জানালার রড ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবছেন একমনে। বিকলতার গভীরতা তার চিন্তার মধ্যে। পশ্চিমের মাঠে কিছুক্ষণ আগে সূর্য ডুবে গেছে। এত বছর মনের সব নির্যাস নিয়ে সূর্য ডোবার রক্তিম আভা উপভোগ করেছেন। সেদিন কিন্তু সেই মনোভাবে ঢুকে পড়তে পারলেন না। পুরনো কোনো হিসেব ঠিকমতো মিলছে না। বরং চলতি সময়ের বিড়ম্বনা সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছেন। জিৎ আবার বলল, সুইচ অন করে দেব? কোনো উত্তর না পেয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে পিংপং বসুর পাশে দাঁড়াল। তাৎক্ষণিক বিপদ তাকেও কম স্পর্শ করে নি। মনে মনে দুলতে লাগল কিন্তু কিছুই করার নেই বলে চুপ করে থাকতে বাধ্য হল। সেও খুব করে চাচ্ছে, ফ্যানটাসটিকস কোল্ড ড্রিঙ্কস কোম্পানি দ্রুত রাহুমুক্ত হোক। জানে এভাবে বেশি দিন চললে বাড়তি সুখ স্বাচ্ছন্দ পাওয়ার যে প্রত্যাশা তার মধ্যে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠেছিল, তা মুখ থুবড়ে পড়বে। পিংপং বসু মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললেন, একটা সত্যি কথা জেনে নাও জিৎ, সব বাধা টপকে যাওয়ার ক্ষমতা ফ্যানটা কোম্পানির আছে। কেবল সেজন্যেই নাম দেওয়া হয়েছে ফ্যানটাসটিকস।
জিৎ অবাক হল পিংপং বসুর মানসিক দৃঢ়তা দেখে। কী এমন নতুন সূত্র খুঁজে পেলেন যে এত বেশি উদ্বুদ্ধ হতে পারলেন? কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। পাছে পিংপং বসু খারাপ ভাবেন সেই ভয়ে চুপ করে থাকল। আবার একটু ভাবল। শেষ পর্যন্ত ভিতরের কৌতূহল চাপতে না পেরে নরম স্বরে বলল, মেঘ কেটে যাওয়ার নতুন কোনো সূত্র পেলেন নাকি?
জেনে নাও জিৎ, ফ্যানটাসটিকস এর শিকড় অনেক গভীরে। মুখ ঘুরিয়ে থাকা সাধারণ মানুষকে নিয়ে কীভাবে নতুন খেলা শুরু করতে হয়, সেটাই কয়েক দিনের মধ্যে দেখতে পাবে। আবার নতুন সকাল আসবে, আবার নতুন করে সূর্য উঠবে।।
জিৎ অবাক না হয়ে পারল না। লোকটার সাহস আছে বটে। চরম বিপদ মুহূর্তে এতটুকু ভেঙে পড়তে জানেন না বরং মাথা ঠাণ্ডা রেখে কীভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়, সেই কঠোর বাস্তবতা মর্মে মর্মে শিখে ফেলেছেন। স্মিত হেসে জিৎ বলল, কী ভাবছেন যদি একটু শেয়ার করেন।
আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো জিৎ?
কী করতে হবে বলুন।
সোপানের নাট্যকর্মী রফিককে আমাদের পক্ষে টেনে আনতে পারবে?
ভয়ানক কঠিন কাজ। ছেলেটা পল্লবদার ট্যাবলেট গিলে এত কুঁদ হয়ে আছে। যে কারুর কথা কানে তুলতে চায় না। তবুও বলছেন যখন, একটা চেষ্টা নিয়ে দেখতে পারি। রফিককে যেজন্যে চাচ্ছেন, তা কী অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় না?
তা হয় না জিৎ। রফিককেই দরকার। যে জাল বুনতে চলেছি, তাতে রফিক একটা বড়ো ভূমিকা নিতে পারে। ওর বিকল্প হিসেবে কাউকে ভাবার সময় এখনো আসেনি। যতদূর শুনেছি, ছেলেটাভীষণ আর্থিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। দুই বিপরীত ভাবনা বুকে জড়িয়ে দোটানায় দিন কাটছে তার। কিছুতেই পল্লবের নাট্যভাবনাকে ছাড়তে পারছে না, আবার কীভাবে নিজের আর্থিক সমস্যা দূর করা যায়, সেই পথেও দুলছে। দ্বিতীয় পথে এগোলে বোধ হয় আমরা রফিককে জয় করতে পারি।
জিৎ এর মুখে অক্ষমতার বলিরেখা। ভেবে পাচ্ছে না, কীভাবে রফিককে ফ্যানটার পক্ষে টেনে আনা যায়। মনের ভিতরে না পারার যন্ত্রণা তীব্রতর হয়ে উঠল।
অত ভেব না জিৎ। রফিককে একবার আমার সাথে মিট করিয়ে দাও। তারপর যা করার আমিই করব।
ও এখন বোনের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত।
পিংপং বসু হোহো শব্দে হেসে উঠলেন। জিৎ আগে কখনো তাকে এভাবে হাসতে দেখে নি। কোনো প্রতিযোগিতায় জিতে গেলে মানুষ যেভাবে হাসে, পিংপং বসু ঠিক সেভাবেই হাসলেন। তাহলে কী অন্য সূত্র খুঁজে পেয়েছেন? জিৎ দুচোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল তার দিকে। অদ্ভুত জীবনীশক্তি নিয়ে মানুষটা রোজ রোজ পথ চলতে জানেন।
ভজহরি চক্রবর্তীকে চেনো জিৎ?
বিলক্ষণ চিনি। পল্লবদা ওকে ভজকাকু বলে ডাকে।।
তাহলে তো তুমি ওর সম্পর্কে কম বেশি জানো। এক কাজ করো, এখনিই ওর বাড়িতে যাও।
কী বলতে হবে বলুন?
ভেরি সিম্পল। শুধু বিনয়ের সঙ্গে বলবে, কাল দুপুরের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাতেই কাজ হবে।
কিন্তু রফিককে পক্ষে টানার কোনো প্ল্যান তো বলে দিতে পারলেন না।
শুধু বলো, আমি ওর বোনের জন্যে একটা ভালো ছেলে দেখেছি। চাকরি করে। তাই নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। আমি বললে ছেলেটা না বলতে পারবে না, তাও শুনিয়ে দিও।
বিমর্ষ জিৎ নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। ফ্যানটাসটিকস কেন যে তাকে এত বড়ো পদে বসিয়েছে, তা ভালো করেই অনুভব করতে পারল। বিস্ময় চোখে চেয়ে থাকল পিংপং বসুর দিকে।
পিংপং আবার মুখ খুললেন, একটা কথা মনে রেখো জিৎ, বুদ্ধিমানের ডিকসনারিতে পরাজয় বলে কিছু নেই। বুকে সাহস থাকলে তুমিও পারবে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct