অন্য পরিচয়ে
শংকর সাহা
____________
নিখিলেষের সঙ্গে মধুছন্দার বন্ধুত্বটি প্রায় সেই স্কুল বেলা থেকেই।
পড়াশোনায় সব সময়ই নিখিলেষকে পেছনে ফেলে ক্লাসে ফাস্ট হতো মধুছন্দা।
নিখিলেষ গ্রামের মোড়লের ছেলে। বংশের এক ছেলে বলে তাকে নিয়ে তার বাবার অহংকার কম ছিলনা। ছেলেকে বড় আইনজীবি বানানোর গল্প সকলকে শোনাতেন কমলাক্ষবাবু। মধুছন্দার বাবা নেই। সেবার গ্রামে ডেঙ্গুজ্বরে মারা যায় তার বাড়ি। বিধবা মাকে নিয়ে অভাবের সংসারের দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে
মধুছন্দা। স্বপ্ন কটাই সংসারটকে বাঁচাতে হবে তো টুলেভ ক্লাস পাশ করে নিখিলেষ আইন পড়তে চলে যায় শহর কলকাতায়। গুণে গুণে পাঁচটি বছর শহরে থাকা। সেবারে বর্ষায় ঘরের চালটি ভেঙ্গে পড়ে তাদের । মাকে নিয়ে খুব কষ্টেই দিন কাটতে থাকে মধুছন্দার। ধীরে ধীরে তার মায়ের বাঁ পা
টি প্রায় অবশ হয়ে আসে। কর্মশক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি। এমন করতে করতে কেটে গেল তিন তিনটি বছর। মাকে নিয়ে দূর সম্পর্কে এক মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয় তারা। মামা প্রায় অসুস্থ। তাই সংসারের সব কাজ করতে হবে বিনিময়ে দুবেলা খাওয়া ও থাকার জায়গাটুকু মিলেছে তাদের। অরুণ সেই মামার ছেলে। পেশায় মালদহ কোর্টের উকিল। কর্মসূত্রে নিখিলেষের সাথে তার পরিচয়।
সেদিন সকালেই মধুছন্দাকে ডেকে অরুণ বলে, আজ আমার এক বন্ধু আসবে। ও আজ এখানেই দুপুরে খাবে। আমি বাজারে গিয়ে দেখি মাছ মাংস কি পাই? একাহাতে তাকে সবকিছুই করতে হয়। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে যেন নিজের মুখটিই আয়নায় দখার সময় থাকেনা তার।
ঘড়িতে তখন দুটো। নীচে হঠাতৎই ট্যাক্সির শব্দ। এই বুঝি দাদাবাবুর বন্ধু
এসেছেন রান্না ঘরে গিয়ে সব রান্নাগুলো আবারও ভালো ভাবে দেখে নেয় সে।
শহরের মস্ত বড় উকিল তিনি।
সিঁড়ি দিয়ে নিখিলেষ আর অরুণ ওঠে বৈঠকখানার ঘরে বসে। আজ মধুছন্দাও মায়ের একটি শাড়ি পড়েছে। ভালো পোষাক তাঁর প্রায় নেই বললেই চলে।
শাড়িটি পুরোনো হলেও যেন পরিপাটি করে পড়া। এবাড়িতে মধুছন্দাকে সবাই চম্পা নামেই চেনে। অরুণ ডেক বলে, চম্পা আমাদের জন্যে দকাপ চা করে নিয়ে এসো রান্নাঘর থেকে দুইকাপ চা করে বৈঠকখানা ঘরে যেতেই মধুছন্দা বিস্মিত হয়ে যায়। এ কাকে দেখছে সে। এ যে নিখিল! তার একমাত্র ছোট্টবেলার বন্ধু নিখিল।
যাকে প্রতিবার পরীক্ষায় সে হারাতো। মধুছন্দা বুঝতে পারে এখন তার পরিচয়টা গোপন রাখা খুব প্রয়োজন। কোনোভাবে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে চায়ের কাপদুটো রেখে চলে যায় সে। চায়ে চুমুক দিতেই নিখিলেষ অবাক হয়ে যায় এ স্বাদ যে তার খুব চেনা। সে অবাক ভাবে তাকিয়ে থেকে অরুণকে জিজ্ঞাসা করে ও তোদের বাড়ির কি নতুন কাজের মাসি না না , ও বাবার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ে। মা অসুস্থ ।দেখার কেউ নেই তাই এখানেই থাকে ।আমাদের রান্না করে দেই , বাবাকে দেখে। জানিস নিখিলেষ ও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো কিন্তু অর্থের অভাবে পড়তে পারলো না
বলছি অরুণ আমার সাথে একবার পরিচয় করিয়ে দিবি?
দাঁড়া, চম্পা একবার পরে এসো? নিখিলেষ একবারটি তোমায় দেখতে চায়? চোখের জলটি মুছে আস্তে আস্তে চাদরে মাথা ঢেকে খিড়কির সামনে গিয়ে বলে ,দাদা আমায় ডাকছো ? কি রে দিনের বেলায় এখন করে চাঁদর দিয়ে ঢেকে আছিস যে?
দাদাবাবু আমার খুব জ্বর এসেছে। গা কাঁপছে। তবে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমরা খাবার বেড়েই খেয়ে নেব। মধুছন্দা পেছন ফিরে নীচে নেমে আসে। নিখিলেশ বারে বারে তার মুখটি দেখার চেষ্টা করে ..
খাবারের টেবিলে নানান পদের খাবারে সাজানো। নিখিলেশের প্রিয় মোচার ঘন্টও আছে। দুই বন্ধু খেতে বসে। সাদা ভাতে মোচার ঘন্টটি মুখে দিতেই নিখিলষ
আবারও আবাক হয়ে ওঠে । এমন মোচার ঘন্ট সে একবার মধুছন্দাদের বাড়িতে গিয়ে খেয়েছিল। নিখিলেশ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
পশ্চিমের জানালা দিয়ে বসন্তের কোকিলের বিষন্ন ডাক যেন হঠাতই ভেসে এল।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে। পাশ অরুণ গায়ে হাত দিয়ে বলে, নিখিলেষ ,
কিছু ভাবছিস....!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct