দিলীপ মজুমদার: বিজ্ঞান নানা বিষয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে দেয়। এই যেমন যোগাযোগ। এক সেকেণ্ডে পৃথিবীর একপ্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অশেষ কৃপা বিজ্ঞানের । সে কৃপায় এখন পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করে, বন্ধ্যা জননীর সন্তান হয়, প্রান্তিক মানুষ এসে পড়ে খ্যাতির আলোয়। এই যেমন রানাঘাটের রানু মণ্ডল। ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে তিনি ভিক্ষা করতেন। একটু অন্য রকম ভিক্ষা অবশ্য। গান করতে করতে ভিক্ষা। সেই গান শুনে এক যুবক সেটি রেকর্ড করে ছেড়ে দিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্যাস। লাগ ভেলকি লাগ। লতাকণ্ঠির গান শুনে মানুষের দিল তো পাগল হ্যায়। তারপরে হতদরিদ্র রানু চরকির মতো ঘুরতে লাগলেন রানাঘাট থেকে মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, কেরালা, কুয়েত ; তাঁর উপর ঝলসাতে লাগল ক্যামেরার আলো। এক লহমায় সেলিব্রিটি।
রানু মণ্ডলের পরে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেলিব্রিটি হয়ে গেলেন ভুবন বাদ্যকর। দুবরাজপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ গ্রাম পঞ্চায়েতের কুড়ালজুড়ি গ্রামের মানুষ। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে, এক বালিকা পুত্রবধূ। কিন্তু রোজগার করেন তিনি একা। মেয়েদের চুল, তাদের পায়ের তোড়া বালা, মোবাইল ভাঙা নিয়ে নিজের লেখা গান করতে করতে তিনি বিক্রি করেন কাঁচা বাদাম। সেটিও একটু ব্যতিক্রমী। ভাজা নয়, কাঁচা বাদাম। তাঁর সেই মেঠোসুরের গান সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিলেন এক যুবক। ব্যস। মুহুর্তে ভাইরাল।
কিন্তু রানু যেখানে পৌঁছাতে পারেননি, সেখানে পৌঁছে গেলেন ভুবন। রাজনীতির অঙ্গনে। এ যুগে চৌযট্টি কলার এক কলা হল রাজনীতি। কি ছিল বিধাতার মনে, রাজনীতির জালে ধরা পড়লেন সরল-তরল ভুবন বাদ্যকর। তাঁর হৃদয়ে ধরা দেবার ইচ্ছে ছিল কি না আমরা জানি না। কলকাতার পুরভোটে দেখা গেল ভুবনকে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ড দিয়ে শুরু হল যাত্রা। তৃণমূল নেতা অমল চক্রবর্তীর হয়ে প্রচার করছেন ভুবন । আর এক তৃণমূল নেতা, কালারফুল মদন মিত্র দুহাত বাড়িয়ে আছেন ভুবনের দিকে। কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছেন ভুবনকে। বলে দিয়েছেন পুরভোটের ফল প্রকাশের দিন ১৪৪ কেজি কাঁচাবাদাম আনতে হবে ভুবনকে। কাঁচাবাদামের হরির লুট হবে হয়তো। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বলে দেওয়া যায় পুরভোটের ফল কি হবে।
হয়তো এরপরে আমরা ভুবন বাদ্যকরকে দেখতে পাব কলকাতার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। শুরু করবেন কাঁচাবাদাম দিয়ে। ভোটের উত্তাপে কাঁচাবাদাম পাকবে। ভুবনও হয়তো রাজনীতির কলায় পেকে উঠবেন। তাহলেই হল। কিন্তু ভুবনবাবু ভাই, মনে রাখবেন রাজনীতিতে ঢুকলে ক্যাসাবিয়াঙ্কা হতে হবে । কোন প্রশ্ন করা চলবে না, চলবে না সমালোচনা। মেনে নিতে হবে। বুঝতে হবে দল যস্য বল তস্য । নেতার নাম জপ করতে হবে মনে মনে। নেতা ধর্ম নেতা স্বর্গ। নেতাই তো তপস্যার বস্তু। পারবেন তো ? কাঁচাবাদাম তো বেশিদিন চলবে না ভাই। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গান বাঁধতে হবে। ফরমায়েশি গান। আপনি যদি কখনও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলেন, তখন কিন্তু শেষ। সে যে দলেই যান না কেন !
আপনি যদি সবকিছু মেনে নেন, তাহলে সোনায় সোহাগা। আর তারপরে আপনাকে একবার রানাঘাটে যেতে অনুরোধ করি। হ্যাঁ, রানু মণ্ডলের কাছে। এই পরামর্শটা তাঁকেও দিন। লোকসভার নির্বাচন আসছে । তখন যেন রানু ভিড়ে পড়েন রাজনীতিতে। ‘তেরে মেরে প্যায়ার’ গানটা গাইতে থাকেন সভায় সভায়। তোমার আমার প্রেম। মানে, বিশেষ একটি দলের সঙ্গে আমার প্রেম। কৃষ্ণপ্রেমের চেয়েও মহার্ঘ। তাহলে জীর্ণ বাড়ি মেরামত হয়ে যাবে, রোজ কিচেনে চিকেন রান্না করতে পারবেন, বলিউড না হোক টলিউডে একটা জায়গা পেয়ে যাবেন। ভুবনভাই, রানু মণ্ডল একটু মুডি মানুষ, যদ্দুর মনে হয় তাঁর মানসিক ভারসাম্যেরও অভাব আছে, তাই কথাটা পাড়বেন শান্তভাবে । তিনি বিতিকিচ্ছিরি কথা বললেও ধৈর্য হারাবেন না।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী গান ভালোবাসেন আপনাদের দুজনকে দুপাশে পেলে বড় আনন্দ হবে তাঁর। শুধু আনন্দ নয়, অনুপ্রেরণাও পাবেন।
তারপরে ?
আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct