কাশ্মীর মানে ভূস্বর্গ। কাশ্মীর মানে এক উদাস স্বপ্নে ভেসে আনন্দে বিভোর হওয়া। কাশ্মীর মানে সাদা বরফের ঢাকা প্রান্তর, সবুজ ঢাকা অথবা উলঙ্গ উচ্চ পাহাড়। এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যভরা স্বর্গ কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর মানে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীবাদীদের হামলা-মৃত্যু অথবা সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে মৃত্যু। সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের-অনুপ্রবেশকারীদের হামলা, কত শত মায়ের পুত্র, কত স্ত্রীর স্বামী, কত পুত্রকন্যার পিতার রক্তাক্ত দেহ অথবা সেনাবাহিনীর এ কে ৪৭-এর গুলির শব্দ। কাশ্মীরের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি পাহাড় পর্বত উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমনই আতঙ্ক। সম্প্রতি কাশ্মীর উপত্যকা ঘুরে এসে নিজের সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এস এম শামসুদ্দিন। আজ চতুর্থ পর্ব।
কাশ্মীর আহ ! কাশ্মীর ! তুমি তোমার সৌন্দর্যে মহীয়ান ,তুমি সৃষ্টির সেরা, মর্তে স্বর্গের প্রতিরূপ ,তুমি আপন মহিমায় চির ভাষ্মর - চির উন্নত শির।
পর্বতের শরীর বয়ে লামান ,ভাগ্নে সাহিল ও বোনের জামাই ডাক্তার মেহবুব উঠে গেল বেশ উচ্চতায় বরফের বুকে ,বরফ নিয়ে খেলতে ওরা মত্ত। নীচে দেখার সময় নেই ,যখন দেখলো তখন আর উপরে ওঠার সাহস পেলো না। নিচের দিকে দেখতেই ওরা বুঝলো কতটা উঠেছে। বরফ গলে জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের শরীর বেয়ে।
সাবধানে ওরা নেমে এলো নীচে হাতে বরফ নিয়ে। কি যে আনন্দ ! আচেনার আনন্দ সীমা পর করেছে।
বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা শুরু করলাম ফেরা। এবার উৎরাই থেকে নিচে। বরফ গলা জল আপন নিয়মে বয়ে চলেছে নীচে। আমরা নামতে নামতে এক সময় আমাদের গাড়ি পার্কিংয়ের কাছাকছি। । কিছু মিলিটারি এসে আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিল। ড্রাইভারকে বলল গাড়ি সাঈড করতে। হাতে রাইফেল নয় এ কে ৪৭ .
“ জান হাতেলি পে” অবস্থা। প্রান করে ধুকুর ফুকুর , ড্রাইভার বলল ডারিয়ে মাত।
জো পুচ রাহা হ্যায় বলিয়ে।
নাম কিয়া হ্যায়।
শামসুদ্দিন
কাঁহা সে আয়া।
বেঙ্গল সে।
ওহ,আপ সব দিদিকা আদমি হ্যায়।
ইয়ে ড্রাইভার আপসে কিৎনা পয়সা লিয়া।
আমিতো বেশ ধন্দে পড়লাম। বেশি বলব না কম বলব। একবার ড্রাইভারের দিকে দেখছি আর একবার সেনার দিকে।
কথায় আছে সত্যের মার নেই। সত্যমে জয়তে। সত্যেরই জয় চিরকালের।
জি ৪০০০/- হাজার।
ঠিক বলরাহে হ্যায়।
জরুর।
ওকে- যাও।
আরে ড্রাইভার ভাই আপ পেহলে বল দিজিয়ে হামকো।
নেহি সাব কোয়ি - কোয়ি ড্রাইভার জিয়াদা লে লেতে হ্যায়। ঘুমনে ওয়ালোক কিসি তারাহ কি তাকলিফ না হো ইস লিয়ে পুচ লেতে হ্যায় ওহ।
আমরা কিছুক্ষনের মধ্যে এসে গেলাম শোনমার্গের সেই সমতল হোটেলে। আমাদের কেউ কেউ আগেই পৌঁছে গেছে কেউবা এখনও ফেরেনি। আবার কেউবা ৯০০ টাকায় চুক্তি করে ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা যাওয়ার পর ভয়ে নেমে পড়ে সব টাকা গুনে মন মেজাজ খারাপ করে বিষণমনে বসে আছে।
যাঁরা বেশি টাকায় চুক্তি করে ভেবেছিল দান মেরে দিয়েছি , তাঁরা কিছুটা মাত্র গিয়ে নেমে। চুক্তি মতো টাকা গচ্চা দিয়ে হতাশ হয়ে বসে।
আমরা এসে হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলাম। নদীর পাশে হোটেলের সামনে রাস্তার পাশে টেবিল ফেলে দুপুরের খাওয়ার ৩.৩০ খেতে বসলাম। ঠান্ডা ভাত সহ মাছের কারী ডাল সবজী দিয়ে খাওয়া সারলাম। সন্ধ্যা প্রায় গড়িয়ে আসছে। ঠান্ডার প্রকোপ সূর্য রশ্মির তাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে।
একে একে সকলে ফিরছে ,বিরল অভিজ্ঞতা সম্বল করে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে, পাহাড়ের আড়ালে সূর্য লুকিয়েছে, তার তীব্রতা হারিয়ে ফেকাসে লালা আলোর ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চিমাকাশে। আর নয় আমাদের রওয়ানা হতেই হবে এবার। বাস ছেড়ে দিল হোটেলের উদ্দেশ্যে। প্রথমে সদ্য ফেলে আসা অভিজ্ঞতার কথা তারপর কিছুক্ষণ হাসি তামাশা আনন্দ। রাহুল ব্যানার্জী ড্রাইভারের সামনে বসে পুরানো ক্লাসিক গানের চালিয়ে দিলো বাসের স্টিরিয় বক্সে। পিছন থেকে আওয়াজ এলো গান চেঞ্জ করো। আগত্যায় বেচারা রাহুল আধুনিক হিন্দি গান ,বাজনার ধুন বেশি কথা কম এমন গান চালিয়ে দিল ,হু হা হা ডুডুম অদ্ভুত বাজনার সঙ্গে গান চালিয়ে দিল সে।
আমরা এক সময়ে ফিরে এলাম হোটেলে। তখন রাত্রি ৯টা।
ক্লান্ত অথচ সৌন্দর্য উপভোগে তরতাজা প্রাণমনে যে যাঁর রুমে ফ্রেস হলাম।
হোটেল ভিক্টরিয়ায় তৃতীয় দিন সকালে উঠে আমরা নির্দেশমতো যে যাঁর লাগেজ গুছিয়ে সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় কাপড় হ্যান্ড ব্যাগে নিয়ে বের হলাম ডাল লেকের উদ্দেশ্যে। ডাল লেকের ভাসমান বোটে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। লেকের টির ধরে অসংখ্য ঘাট। ঘটে বাঁধা শিকারা নৌকা। ৪ জন বসার ব্যবস্থা শিকারায় । আমরা ৬নম্বর ,ঘাটে গিয়ে দাঁড়াতেই ভাসমান বোটের শিকারা আমাদের নিয়ে চললো বোটের দিকে। অসংখ্য শিকারা নৌকায় কাশ্মিরী নাবিকরা নিয়ে যাওয়া আসা করছে।
আমাদের ভাসমান শিকারা বেশ অনেকটা যাওয়ার পর গিয়ে এক বোটের সামনে থামিয়ে দিলো। লেকের জলের সঙ্গে মিশে আছে সিঁড়ি ,উঠে গেছে হাউস বোটের বারান্দায়। আমরা এক এক করে উঠে গেলাম হাউস বোটে। কাঠের তৈরি নৌকার উপর বারান্দা , বসার ডাইনিং হল। টিভি রাখা। সোফা চেয়ার ভিতরে পর পর তিনটি ঘর ,সঙ্গে যুক্ত বাথরুম , বেশতো। নীচে জল ,ভাসমান বোটের উপর রাত্রি যাপন ,বেশ লোমহর্ষক ব্যাপার। কাশ্মীরের বেশ আকর্ষক এই হাউসবোট। আমরা। ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে উঠে গেলাম হাউস বোর্ডে। শিকারা নিয়ে জামা কাপড়, নানান দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে বিক্রি করতে আসছে। আমরা বারান্দায় বসে দেখছি। পাশেই ভাসমান এক দোকান। ঠান্ডা পানীয় থেকে নানান সামগ্রীর দোকান।
একটু পরেই আমরা চললাম জুম্মার নামাজ পড়তে। এক শিকারাকে ডেকে উঠে বসলাম তীরে পৌঁছে জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়ার। আজ শুক্রবার। এখানে বেলা দুটায় জামাত। আমরা কয়জন আটো ধরে ২০-২৫ মিনিট দূরত্বে হজরত বাল মসজিদে গেলাম। ডাল লেকের পাশেই এই মসজিদ। একটু এগিয়ে গেলেই ডাল লেকের তীরে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লার বাঁধান কবর। পাশেই ফুলের বাগান। শাহী কবর বলে কিছু হয়না তবুও। যাঁদের হাতে ক্ষমতা তাঁরা তো আর আমি নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার বা ক্ষমতাবলে হয়ে ওঠে এম থেকে খাস।
আর সেই জন্যই তাঁদের খাস ব্যবস্থাপনা। বেঁচে থাকতে বটেই এমনকি মরার পরেও।
মসজিদে আজান হয়েছে আগেই। মাথায় টুপি পরে জামাতে যোগ দিতে লাইন দিয়ে এগিয়ে চলেছে নামাজী মুসলমানরা। আমরা বেশ কিছুটা দূরে আউট আমাদের নামিয়ে দিল। আমরা হেঁটে এগিয়ে গেলাম মূল মসজিদের দিকে। মূল গেটের পাশে ওযু খানায় ওযু করে মসজিদের একেবারে ইমামের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। দোতলায় ওঠা ছাড়া বসার স্থান নেই। পায়ে পায়ে দ তলায় উঠে ইমামের সামনা সামনে একজায়গায় বসলাম। ইমাম সাহেব কাশ্মিরী ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে উর্দু বলছেন। উর্দু বুঝলেও কাশ্মিরী ভাষায় অজ্ঞানতা অবসন্নদেহ নিদ্রাচ্ছন্নতা গ্রাস করলো।
বক্তৃতার পর খুতবা পাঠ এটাই হানাফী মুসলমানদের মসজিদে হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে দেখলাম খুৎবার পরও অনেক দুআ দরুদ পড়া চলছে ,ইমাম সাহেবের সাথে নামাজিরাও সমস্বরে দরুদ শামিল হচ্ছে।
কি ব্যাপার। এমনটা কেন।
কেরালা আরব সাগর তীরে ভারতের প্রথম মসজিদ চেরামান জুম্মা মসজিদে ও “মালিক বিন দিনার “ মসজিদের কথা স্মরণে এলো। সেখানেও এমনটা দেখেছিলাম। ইসলামে চার ইমামের কথাও মনে পড়লো। হানাফী,শাফি, মালেকী,হাম্বলী।
এরা হাম্বলী ইমামের মতাবলম্বী মদিনা শরীফে পবিত্র হজে গিয়েও হাম্বলী মাজহাবের মতাবলম্বীদের নামাজের আগে ও পরে দরুদ সালাম পড়ার রীতি দেখেছি।
যাইহোক আমরা মুসাফির। জুম্মার নামাজ না পড়লেও চলে। তবুও এমন ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজ ও এখানকার রীতি সংস্কৃতি জানার প্রবল আগ্রহে নামাজে আসা। নামাজ পড়ে আমরা বের হয়ে এলাম আগেই। আটো ধরে ফিরে এলাম ৬নম্বর ঘাটে। শিকারা ধরে ফিরে চললাম হাউস বোটে। বোটের মালিক কাশ্মিরী ভদ্রলোক বেশ মিশুকে। আমাদের চা করে দিলেন ওর স্ত্রী। একরাতের হাউস বোর্ড ভাড়া ১২০০ থেকে ৫০০০-৭০০০/- হাজারও আছে। আমাদের এই বোর্ডের কত হবে ,ভদ্রলোক বললেন সিজেন অফ সিজেন হিসাবে দাম ওঠা নামা হয়। খদ্দেরের চাপ হিসাবে ,চাহিদা অনুসারে দাম হয়। মোটামুটি ১৫০০.
রাতের খাওয়া শিকারায় চড়ে প্রত্যেকটাতে পৌঁছে দিলেন আমরেশদা। কাল সকালে সকাল রেডি থাকবেন। ৬ টায় উঠে শিকারা নিয়ে ৬নম্বর গেটে পৌঁছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গেলেন।
হাউসবোটে রাত্রি যাপন এক অদ্ভুত অনুভূতি। একটু এদিক ওদিক ফিরলেই বাড়ি দুলছে। বেসিনে জল ফেললেই জল পড়ার শব্দ ,আর ও পাশ থেকে অপর হাউসবোটে একেআপরের ছুঁড়ে ছুঁড়ে কথা বেশ লাগছিলো বৈকি। ডিসেম্বর। জানুয়ারিতে তো এখানে ডাল লেক জুড়ে বরফে ঢাকা। বোট ফাঁকা। রাত্রির অন্দকারে হাউসবোট হাউসবোটে আলোর রোশনাই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর দৃশ্য। অদ্ভুত এক অনুভূতির উত্তেজনায় ঘুম বিদায় নিয়েছে। বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না। চোখ বুজে ওদের জীবন যাপন সংগ্রাম অনিশ্চিত উপার্জন নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়েছি জানিনা। সকালেই উঠে রেডি হয়ে শিকারা চড়ে এলাম তীরে। আমাদের বাস রেডি। হোটেলে রাখা লাগেজ নিয়ে আমরা চললাম গুলমার্গের পথে। গুলমার্গে পৌঁছাতে আমাদের আমাদের ১২-১টা বাজবে। ড্রাইভার ইমরান বললেন অভি চালিয়ে দেখতে রহিয়ে কাশমীরাকা নাজারা।
ক্রমশ....
পাহাড়ের উঁচু এক জায়গায় রাস্তার পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।
আপ নীচে দেখিয়াই ওহ বেতাব ভ্যালী।
বেতাব ভ্যালী কেন ,এই জায়গায় সানি দেওল ও অমৃতা সিং এর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct