সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৯ কিস্তি ২
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
আসিফের কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদের ঝড়। মানছি টাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাই বলে নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দিতে তো পারি না। একটা বিদেশী মদ কোম্পানির কাছে অত্যন্ত সস্তায় নিজেদেরকে বিক্রি করতে পারি না। কোনো মূল্যে পিংপং বসুকেও সমর্থন করা চলে না।
দেবু অসহনীয় হয়ে তেড়ে গেল আসিফের দিকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোর? অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে তালিমারা বিদ্যে নিয়ে পিংপং বসুর মতোলোককে আক্রমণ করতে চাচ্ছিস? ওই লোকটার পায়ের যোগ্যতা তোর নেই রে। দেখি, আজ তোকে কে রক্ষা করে?
জয়া এসে আসিফের সামনে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁতে রেখে ডান হাত উপরে তুলে নাড়তে নাড়তে বলল, কী ভাবছ দেবুদা? পিংপং বসুর কালো টাকার জোরে আসিফের কণ্ঠস্বর এভাবে থামিয়ে দেবে? গণতান্ত্রিক অধিকার আছে বলেই আসিফও পারে নির্ভয়ে নিজের মতামত জানাতে। তোমরা ক’জন এসেছ কী সেই অধিকার কেড়ে নিতে? ভালো করে জেনে রাখো, স্রেফ টাকার জন্যে তোমরা পিংপং বসুর কাছে নিজেদেরকে বিক্রি করতে পারো কিন্তু দেশপ্রেম ভুলে আমরা কোনো অবস্থাতেই সোপানের আদর্শ ত্যাগ করে নিজেদেরকে বিদেশী বসুর কাছে পণ্যবস্তু হতে দিতে পারি না।।
পল্লব উঠে দাঁড়াল সকলকে শান্ত করতে। হাত উঁচিয়ে চাপা স্বরে বলল, এটা পর্যালোচনার আসর। যত মতপার্থক্য থাকুক, খাঁটি মনন রক্ষা করার জন্যে আমরা কিছুতেই নিজেদের শালীনতা বিসর্জন দিতে পারি না। আলোচনার আসরে জীবনের দর্শন যত বড়ো হয়ে ওঠে, সমাজের বুকে আমরা তত বেশি সমুন্নতি লাভ করতে পারি। দেহের বিস্তার দিয়ে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। আসিফের উচিত হয় নি এভাবে কথা বলা।
আরও কী সব বলতে চাচ্ছিল পল্লব, তা থামিয়ে দিয়ে আসিফ বলল, বিশ্বাস করো পল্লবদা, আমি জিৎকে অপমান করতে চাই নি। ওর সাথে আমার কোনো ব্যক্তি বিরোধ নেই। আমিও ভীষণ টাকার অভাব অনুভব করি। তুমি মাকে দেখতে গিয়ে তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলে।
আবেগে অবরুদ্ধ হয়ে গেল আসিফ। আর কথা বলতে পারল না। নীরবতায় নিজেকে প্রকাশ করতে থাকল। কিন্তু সময় গেল সেভাবে। ভাবালুতা কমলে আবার বলতে শুরু করল, মানছি, একটা তথ্য চেপে গিয়ে আমি ভীষণ ভুল করেছি। মসলমপুরের প্রতিযোগিতায় ভালো অভিনয় না করার জন্যে সকলে আমাকে দোষ দিয়েছে। আমি চুপ করে থেকেছি কিন্তু সেদিন ইচ্ছে থাকলেও ভালো অভিনয় করতে পারতুম না। শো শুরুর তিন ঘন্টা আগে মায়ের ওষুধ কেনার জন্যে আমাকে রক্ত বিক্রি করতে হয়েছিল।
একই কারণে দেবুর কাছে হাত পেতে টাকা ধার নিতে হয়েছে। আজ সকালে অনেক কষ্টে তা শোধ দিয়েছি, তাও আবার রক্ত বিক্রি করে। তুমিই আমাকে বেশ কয়েকবার আর্থিক সাহায্য করেছ। তা আজও শোধ করতে পারি নি বলে মাকে নিয়ে নানা অসুবিধা থাকলেও নতুন করে তোমার কাছে হাত পাততে পারি নি। তার পরেও বলব, আমি যেমন অসুস্থ মাকে ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি এই সংগঠনকে। এর মাধ্যমেই দেশকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে শিখেছি। এই সংগঠন আমাকে হাত ধরে দেশপ্রেম শিখিয়েছে। তুমি বই পত্র পড়ার সুযোগ দিয়ে আমার সেই ইচ্ছে পূরণে যথেষ্ট সাহায্য করেছ।
দীপ বিরক্ত হয়ে বলল, এসব কী হচ্ছে পল্লবদা? আমরা এখানে আসি নিআসিফের নাটুকেপনা শুনতে। তোমার কোনো কথা থাকলে তা আমাদের বলতে পারো। নতুনা বলে দাও, আসিফ যা বলছে, সেটা তোমারও কথা। শুধু আদর্শবাদী হলে জীবন চলে না। সেই আদর্শকে বাস্তবে রুপ দিতে গেলে টাকার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা শুধু সেটুকু বলতে চেয়েছি।
আসিফতালি দিতে দিতে আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, তাহলে নাটক করে এতদিন আমরা কী শিখলাম? টাকার প্রয়োজন আছে বলেই জুলিয়াস ফুসিককে বাদ দিয়ে নিশ্চয় পিংপং বসুকে গ্রহণ করতে পারি না। পিংপং বসুর ফাঁদে পড়ে আমরা ভুলে যেতে পারি না বিবেক দেবনাথের মূল্যবান আদর্শকে।
দীপ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, পল্লবদা, আসিফ আবার ভুল বকতে শুরু করেছে। তুমি কী চুপ করে থেকে ওর ভুলবকা সমর্থন করতে চাচ্ছ? নাকি ওর ভয়ে আমাদের সাথে মন খুলে মতামত বিনিময় করতে পারছ না? যা ভাবছ, সোজাসাপটা বলে দিতে পারো, কিছু মনে করব না।
পল্লব গম্ভীর হয়ে বলল, আসিফ ভুল বকছে, না ঠিক বলছে, তা সময় বলে দেবে। তোমাদের আরও কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।
সকলে বুঝল, পল্লব নিজের স্ট্যান্ডের উপর দাঁড়িয়েছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় সকলে জানে, নিজের উপলব্ধি নির্দিষ্ট হয়ে গেলে পল্লব দাশ কিছুতেই তা থেকে এতটুকু সরে আসতে চায় না।
সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। একে অপরের দিকে চোখাচোখি করে নিল। পল্লব দাশকে যে নতুন করে বোঝানো সম্ভব নয়, তা জিৎ বেশ বুঝতে পারল। সোপান যেমন চলছে, তেমনি চলবে, নাকি নতুন পথে চালাতে হবে, তা নিয়ে পল্লব দাশ যেন চরম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। সকলের তাৎক্ষণিক নীরবতা সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও নিবিড় করে তুলল। পল্লব আবার ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, কে কে গ্রুপ ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছ বলো? তার আগে সকলে শুনে নাও, পিংপং বসুর পাল্লায় পড়ে সোপান কখনও মূল নাট্য বিপ্লবের সোপান থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।
সুমন দীপ দেবু জিৎ বেশ কিছু সময় থমকে থাকল। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপ প্রথমে মুখ খুলল, সোপান ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই পল্লবদা। খুব কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে তুমি আমাকে হাত ধরে অভিনয়টা শিখিয়েছিলে। সেই ঋণ কোনোদিন ভুলতে পারব না।এতদিন নাটক করে অনেক সুনাম পেয়েছি। তা সম্ভব হয়েছে তোমার জন্যে। অভিনয় শেখার সময় অনেক দিন ধমকে দিয়েছ। সেগুলো আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে। একদিন বকে দিয়ে বলেছিলে, এই ছেলেটা, অভিনয়ে আর কবে সাবালক হবি বল্ তো? দীপের গলা বুজে এল। আর কথা বলতে পারল না।
পল্লবের মধ্যে নতুন উপলব্ধি দেখা দিল কিন্তু তা প্রকাশ করল না। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কীভাবে নিজেকে পাহাড়ের মতো উঁচু করে ধরে রাখতে হয়, তা শিখে ফেলেছিল গুরু রহমানের জীবন থেকে। জয়া দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল পল্লবের দিকে। সেদিন প্রথম সে নতুন এক পল্লব দাশকে আবিষ্কার করতে পারল। আসিফ অবাক হল পল্লবের মানসিক দৃঢ়তা দেখে। তবুও ভাঙনের নতুন খেলায় নিজেকে জোর করে ধরে রাখতে পারল না। তার মনের তলানিতে বিচ্ছেদের রাগিনী বাজছে। পল্লবের মাথায় তখন অন্য আরেকটা প্রসঙ্গ ঢুকে পড়েছে। নিজের হাতে গড়া সোপানকে কেন্দ্র করে যে ঐক্যের ভাবনা তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল, তা যেন এক ঝলকের ধাক্কায় ভেঙে যেতে বসেছে।
একটা সাদা রঙের মারুতি এসে দাঁড়াল রিয়ার্সরুমের সামনে। ভিতরে পিংপং বসু বসে আছেন। ভীষণ গম্ভীর মুখে। রিয়ার্স রুম থেকে প্রথম বের হয়ে গেল জিৎ। পিছনে পিছনে সুমন, দীপ, দেবু ও অন্য কয়েকজন। দেবু মুখ ঘুরিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল, কাল সংগঠনের হিসেবটা বুঝিয়ে দিয়ে যাব পল্লবদা। দীপ পিছন থেকে টিপ্পনি কাটল, পরের দিন থেকে সব সুযোগ সুবিধা জয়া আর আসিফের জন্যে রয়ে গেল। মনের কীর্তন জমবে বেশ।।
মাথা গরম করে কী বলতে চাচ্ছিল আসিফ কিন্তু সেই সুযোগ পেল না। মারুতি ভেঁ করে বের হয়ে গেল। পিংপং বসু মনে মনে বেজায় খুশি। অভিনব জয়ের ছোঁয়া তারমুখে। জিৎও খুশি ভিতরে ভিতরে। মিস্টার বসুকে শুনিয়ে বলল, আমিও পারি পল্লব দাশকে টপকে যেতে। পারি চয়েসের গণচেতনার উপর ভিত্তি করে একটা নতুন নাটক লিখতে।
গাড়ি ছুটে চলেছে সামনে। হেড লাইটের দৃপ্ত আলো রাস্তার উপর জমে থাকা অন্ধকারকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। পিংপং বসু আপন মনে একটু হাসলেন। জিৎ এর মধ্যে নতুন প্রত্যাশা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আগামী দিনে তাকে জিৎ থেকে জিতেশ্বর হয়ে উঠত হবে। পল্লবের মনে ভাঙনের অন্ধকার জমে উঠেছে। পায়ে পায়ে ঘরের ভিতর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। প্রকৃতির বুকে জমে ওঠা আঁধারের বুকে নিজের মনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। আসিফ এসে দাঁড়াল পল্লবের পাশে। একটু পরে জয়া ঘর থেকে বের হয়ে এল। পল্লব থেমে থেমে বলল, বিবেক দেবনাথ বেঁচে থাকলে আজ খুব দুঃখ পেতেন। তবে এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। রাত দিনের দ্বন্দ্ব নিয়েই মানুষের জীবন। ধনকুবেরের সাথে নন্দিনী বিশুর যে দ্বন্দ্ব, তা চিরদিনের। মানুষের সমাজে তা চলতেই থাকে। আমাদের মূল কাজ হল, সার্বিক চেষ্টায় নন্দিনীর ইচ্ছেকে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। নতুন করে প্রমাণ করতেহবে, ধনকুবেরদের অন্যায় আর্থিক বল থাকলেও যুগে যুগে তাদেরকে পরাজিত হতে হবে নন্দিনী বিশুদের কাছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct