পার্সোলির দিনরাত্রি
মিতালী মুখার্জী
___________________
একটা দশের শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে। একটা বেজে গেল এখনো আমার আর এক বন্ধুর পাত্তা নেই!চাপা উত্তেজনা আস্তে আস্তে রাগে পরিনত হচ্ছে। ফোনে অনবরত কথা হচ্ছে। মহাত্মাগান্ধী ক্রসিং এর জ্যামের মাহাত্য।
গাড়ি লেগে আছে তের নম্বর প্লাটফরমে। আনলাকি থারটীন। মানিনা বললেও বিপদে পড়লেই মন কূ ডাকে।সস্ত্রীক আর এক বন্ধু যাচ্ছে সাথে। তাঁর ছেলে সাম্য ও তার বান্ধবী রিয়া এতক্ষণে সব গুছিয়ে উপরের দুটো বাঙ্ক দখল করে বসে গেছে। ট্রেনে উঠতে গিয়ে বন্ধু পত্নী কেয়ার একপাটি জুতো রেললাইনের মধ্যে পড়ে গেল। কেয়া তো এই কাঁদে তো সেই কাঁদে। সমর ধমকে বলল এইজন্য ই বলে “পথে নারী বিবর্জিতা”। সাম্য বাবার দিকে একটা বক্র দৃষ্টি হেনে লাফ দিয়ে নেমে গেল এবং মন্ত্রের মতো কোন ভিখারির লাঠি চেয়ে অনেক কসরতে মায়ের জুতো উদ্ধার করে নিয়ে আসলো। কেয়ার তখন মুখে হাসি চোখে জল অবস্হা। মুড়িওয়ালার থেকে ওরা ঝালমুড়ি বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ঘড়িতে একটা নয়। সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। আমাদের গাড়ির খাবার পরোটা ,কষা মাংস আর শুকনো মিষ্টি ওর কাছে। বন্ধুর শোক না খাবার শোক জানিনা উদ্বেগ বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে।এবার ট্রেনটা হুইসল দিয়ে কেঁপে উঠলো আর আমার বুকের ভেতরটা কেমন শুন্য হয়ে গেল। আমাদের সবার টিকিট ওর কাছে! রুদ্ধশ্বাসে আমি দৌড়লাম গেটের কাছে।গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। দেখা গেল আমার বন্ধুবর গলদঘর্ম হয়ে দুহাতে লাগেজ নিয়ে দরজার সামনে সামনে দৌড়াচ্ছে।হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে গাড়িটা থেমে গেল । নিমেষে আমি নিচে নেমে বন্ধুকে টেনে তুললাম। কয়েক সেকেন্ডেই গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। আর আমার সামনে দিয়ে ঝালমুড়িয়ালা একটু হেসে মিলিয়ে গেল দূরে । সেই আমাদের সবার অবস্হা দেখে চেন টেনে গাড়ি থামিয়েছিল। দেবদূত কি এমন ই দেখতে হয় !!
বুকের উপর থেকে পাথর নেমে যাওয়া বোধ হয় একেই বলে। এবার চোখ গেল বন্ধু অতীশের দিকে। সে তখনো রিতিমতো হাপাচ্ছে।কেয়া এক বোতল জল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো - সব ভালো যার শেষ ভালো।
ততক্ষণে উপরের বার্থ দুটোতে বিছানা পেতে জমিয়ে বসে গেছে সাম্য আর রিয়া। আমি আর অতীশ মিডলের আর নীচের দুটো বার্থে বন্ধুপত্নী ও সমর। পুরো ছ’টা বার্থ ই আমাদের। এ সি তে টিকিট না পাওয়ায় আমাদের যাওয়াই হচ্ছিলনা। সাম্য আর রিয়া হৈ হৈ করে থ্রি টায়ারের টিকিট কেটে নিয়ে এল।। তাঁদের বক্তব্য থ্রি টায়ারের যাওয়ার মজা ই আলাদা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এই জন্য ই আমার ভালো লাগে। পরিস্থিতি কে চ্যালেঞ্জ করতেই ওরা ভালবাসে।
ট্রেন ছুটে চলেছে হু হু করে। খালবিল, ধান জমি , পাকা ধানের ক্ষেত, পদ্মফোটা পুকুর, সাদা কাশফুল। অতিক্রম করে সবুজ দিগন্তের বুক চিরে।জমিয়ে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া চলছে। সবার ই ঝোলার ভিতর থেকে বেড়াল বের হচ্ছে একে একে। দেখতে দেখতে বর্ধমান আসতেই সাম্য লাফ দিয়ে নেমে নিয়ে এল বর্ধমানের বিখ্যাত সীতাভোগ আর মিহিদানার প্যাকেট। বরাকর ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই দূর পাহাড়ের মধ্যে সোনার থালার মতো
সূর্য অস্ত গেল। আকাশে নিজের প্যালেটের সবটুকু রঙ মিশিয়ে দিয়ে নেমে এল অন্ধকার।
বন্দুকধারী একদল রেলপুলিশ এসে জানাল ধানবাদ ছাড়লে সব দরজা ভাল করে বন্ধ করে নিতে।আগে খুব সেন্সিটিভ এরিয়া। নকসালিস্টরা বিভিন্ন ভাবে হামলা করে। আমরা খুব পাত্তা না দিলেও কেয়ার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। যেটুকু গয়না তার কাছে ছিল কোন অদৃশ্য জায়গায় চালান করে দিল। আমাদের সামনের সাইড বার্থে ছিল এক কমবয়সী বাঙ্গালী দম্পতি।তাঁদের মুখে শুনলাম এই অঞ্চলের বিভিষীকার গল্প। দুমাস আগেই তারা এই ট্রেনেই যাচ্ছিল হাওড়া। গারোয়া রোডের পরেই একটা ছোট্ট স্টশন রাই। সেখানে ট্রেন থামতেই কতগুলো ডাকাত পিস্তল আর ছুড়ি হাতে হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠে পড়লো। ওই কামরাতেই ছিল এক মারোয়াড়ি বরযাত্রীর দল।ওরাই ছিল টার্গেট। ভয় পাওয়ানোর জন্য কামরায় ঢুকেই ব্লাঙ্ক ফায়ার করলো। যার কাছে যা ছিল চেন ঘড়ি টাকা সোনা সব বের করে দিতে লাগলো । দেরি হলেই খিস্তি আর ছুড়ি চালানোর ভয় দেখাচ্ছিল। এর ই মধ্যে বরযাত্রীদের একজন একটু কায়দা করার চেষ্টা করতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুড়ি চালিয়ে দিল। কপাল কেটে চোখ বেয়ে ঝরঝর করে রক্ত পরছে।সবাই অসহায়। ডাকাতরা উঠেই পাশের কামরার ইন্টার ওয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় পাশের কোচের কেউ ই কিছু জানতে পারল না। ডালটনগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দাড়াবার আগেই ডাকাত রা ঝপঝপ করে সব নেমে গেল। কিছু লোক ছুটলো স্টেশন মাস্টার কে খবর দিতে। আহতদের নামিয়ে পাঠানো হল রেল হাসপাতালে। পুলিস এসে সবার বয়ান নিল। কিছুক্ষণ পরে আবার চলল ট্রেন।
রুদ্ধশ্বাসে সবাই গল্প শুনছিল । রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার বিছানায় শুয়ে পরলো। সে রাতে কারো আর ভয়ে তেমন ঘুম হলনা।
সকাল বেলা চৌপন স্টশনে দাঁড়াল শক্তিপুঞ্জ। এখানে ট্রেনের ইঞ্জিন বদলানো হবে । তাই আধঘন্টা দাঁড়াবে ।গড়ম চা, গড়ম সিঙ্গারা,কচৌরি নিয়ে হকার রা হাজির। সাম্য রিয়া নেমে হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল। সকালের জলখাবার হল ডিম কচুরি, সিঙারা জিলিপি আর চা। সবাই প্রসন্ন। ট্রেন এবার উল্টো চলছে। বাঙ্গালী দম্পতি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে জানালায়। জানালো এখানে বৈষ্ণুমাতার অনুকরণে সুদৃশ্য মন্দির আছে তা ট্রেন থেকে দেখা যায়। বলতে বলতেই মন্দিরের চূড়া দেখা গেল। কৃষ্ণের পদতলে অর্জুন। আর পতিতপাবন স্মিতহাস্যে তাকে শোনাচ্ছেন গীতার বাণী। শুনলাম তিনতলা সুউচ্চ মন্দিরে সেই জঙ্গল , জঙ্গলী জানোয়ার, সুরঙ্গ এবং পর্যায় ক্রমে সব দেবদেবীর মুর্তি আছে। বৌটি কপালে হাত ঠেকিয়ে শোনাল এই মন্দির তৈরির ইতিহাস। এক মারোয়ারি শেখ নতুন গাড়ি কিনে বেনারস থেকে ফিরছিল রেনুকুট। পথে চৌপনের এই স্হানেই একটি মালবাহী ট্রাকের সাথে ভয়ঙ্কর এ্যকসিডেন্ট হয়। গাড়ি তো ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্হ হয় ই তাদের একমাত্র ছেলে যে গাড়ি চালাচ্ছিল তার জীবন হানির আশঙ্কা হয়। স্হানিয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না। ভেঙে পড়ল দম্পতি। তারা মনেপ্রাণে ডাকতে লাগলেন বৈষ্ণু মাতাকে। মানসিক করলেন মায়ের মন্দির বানাবার। ডাক্তারদের অক্লান্ত চেষ্টা এবং মায়ের আশির্বাদে ছেলেটি সেরে উঠল । তারপর ই বানান হয় এই মন্দির। দলে দলে পুণ্যার্থি এবং ভ্রমনার্থিরা আসেন এই মন্দির দর্শনে। বৌটির কথা শুনতে শুনতে কেবল ই মনে হচ্ছিল বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।
কথা বলতে বলতে ট্রেন এসে থামল সিঙ্গরৌলি স্টেশনে।নর্দান কোলফিল্ড এর ১০ টি প্রোজেক্ট এর হেগ অফিস এই সিগরৌলি সবুজ জঙ্গল আর নীল মেঘের চাদরে ঢাকা। এখানে ট্রেন পাঁচ মিনিট দাঁড়াবে। নীচে নামলাম চায়ের খোঁজে। হঠাৎই কানে এল এক মহিলার উচ্চস্বরে কান্না। সকাল প্রায় আটটা। এক বিহারি মহিলা মাথায় ঘোমটা দেওয়া প্লাটফর্মে বসে বিলাপ করে চলেছেন আর এক লুঙ্গি পরা পুরুষ মানুষ মুখ কাচুমাচু করে তাঁকে থামাবার চেষ্টা করছেন। লোকমুখে জানা গেল এরা ছেলের বিয়ের কথা বলতে জয়ন্ত প্রোজেক্ট এ যাচ্ছিলেন। সুটকেসে তাদের যাবতীয় জিনিস রেখে মাথায় দিয়ে শুয়ে পরনের প্যান্ট টিও সুটকেসে রেখে ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পরেছিলেন। সিট টা ছিল আপাৎকালীন জানলার পাশে। ভদ্রলোকের নাসিকা গর্জনে নিশ্চন্ত চোর নিজের কাজ করে চলে গেছে। এখন আক্ষরিক অর্থেই তারা কপর্দক হীন। এক কাপড়ে এই দশায় কি করে নতুন লোকের বাড়ি যাবে তাই নিয়ে তাঁরা কাতর । ট্রেন হুইসল্ দেওয়ায় পরবর্তি ঘটনা আর জানা গেল না।
দুপুর দুটো নাগাদ ট্রেন থামলো আমাদের গন্তব্য খান্না বাঞ্জারা স্টেশনে । নামটার মধ্যেই কেমন একটা অ্যডভানচারের গন্ধ।একদম খাড়া ছোট্ট স্টেশন। দুএকটা মহুয়া গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা চা এর দোকানে আমাদের গন্তব্য বলতেই লোকটা আঙুল তুলে কতগুলো গাড়ি দেখিয়ে দিল।দড়দাম করে একটা গাড়িতে উঠে পড়লাম সকলে । যেতে সময় লাগবে বলল কম বেশি দু ঘন্টা। এতক্ষণে পেট নামক বস্তু টা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেই সকালে চৌপনে খাবার পর পেটে তেমন কিছু পড়েনি। দুপুর গড়িয়ে যায়।ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ শুকিয়ে গেছে।ড্রাইভার কেমন করে যেন আমাদের মনের কথা টের পেয়ে গাড়ি এনে থামাল একটা খাবারের দোকানের সামনে। টেবিলে বসে সকালের অনুমতি নিয়ে মসলা দোসা আর দুটো করে মিষ্টির অর্ডার দিলাম। কি একটা সুগন্ধে চারিদিক ম ম করছিল। দোসা টেবিলে পৌঁছান মাত্র ই শেষ । আমরা আবার নিলাম। মিষ্টির অপূর্ব স্বাদ কলকাতার নকুরের দোকান কেও হার মানায়। সাম্য উঠে গিয়ে কিছু মিষ্টি প্রতারক করার আর প্রফেসার লস্যির অর্ডার দিল। এতক্ষণে বোঝা গেল সুগন্ধটার রহস্য । লস্যিটায় কাজু আর বাদাম পেস্তা কেশর আর মালাই ভেদ করে আসল বস্তু তে পৌঁছাতে সময় লাগলো । আহা! সে স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। প্রসংসা করতে দোকানের ছেলেটি বললো এখানের দুধের কামাল। কলকাতার সার্ফ আর ইউরিয়া মেলানো পাস্তুরাইজ দুধ খেয়ে আমরা দুধের স্বাদ ই ভুলে গেছি। ছেলেটিকে খুশি হয়ে কিছু টিপস্ দিয়ে আমরা গাড়িতে বসলাম। রিয়া আর সাম্য নিজেদের পছন্দের ফ্লেভারের এক একট আইসক্রিম নিয়ে গাড়িতে বসলো।
দেখতে দেখতে রুক্ষ জমি বদলে গেল সবুজ বনানী তে। শাল, সেগুন , মহুয়া, পলাশ, আকাশকুসুম, অর্জুন, ইউক্লাইপটাশ আরো কত যে নাম না জানা বৃক্ষরাজিতে নিজেকে সাজিয়ে প্রকৃতি যেন উন্মুখ হয়ে আমাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল। আমরা শহরের যন্ত্র মানবেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছি বনানির এই স্নিগ্ধ রূপ। হঠাৎ ই নিরবতাঢ়কাটিয়ে ড্রাইভার জানাল পাশেই একটা খুব সুন্দর গেস্ট হাউস আছে। কোন রাজার তৈরি গ্লাস প্যালেস তা এখন সরকারী গেস্ট হাউস। ন দেখনে সে পসতাইএগা, সাহাব। সুতরাং আমরা রাজী হয়ে গেলাম। দীপ এগিয়ে চললো আরো ঘন বনের মধ্যে। লোক বসতি নাম মাত্র। ক্কচিত এক আপনজন আদিবাসী নিজেদের পালিত পশু আর কাঁধে একটা কুড়ুল নিয়ে দেখা গেল। প্রকৃতির এই শ্যামল সুন্দর রূপে আমরা এতটাই মুগ্ধ ছিলাম যে সময়ের হিসাব ছিলনা কারো।
গাড়ি এসে থামলো ছবির থেকেও সুন্দর একটা প্যালেসের সামনে। তাঁর বর্ণনা দিতে গেলে গল্পের থেকেও বিস্তৃত হবে। সত্যিই প্যালেস। কোনো রাজা এই জঙ্গলের মোহিনী রূপে মুগ্ধ হয়ে এখানে এই সিস মহল তৈরি করেছিল তা গুগল বলবে। আমরা অবাক বিস্ময়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকলাম। পুরোটাই কাঁচের। ঝকঝকে ঘোরানো স্বেতমর্মরের সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। হঠাৎ রিয়ার চিৎকারে আমাদের চমকে ভাঙলো। সাম্যর নাম ধরে রিয়া চিৎকার করছে। চমকে তাকিয়ে দেখি রিয়া আমাদের মধ্যে নেই।
বুক কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। এখানে এই গভীর জঙ্গলে আমাদের লুট করে মেরে ফেললেও কেউ জানবে না। ড্রাইভার কি একটু বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিল এখানে আনবার জন্য! ওর কোন বদ মতলব নেই তো? এর মধ্যে সাম্য ও ভ্যানিস।
আমরা পাগলের মতো রিয়ার চিৎকার অনুসরণ করে।
আবার রিয়ার গলা- সামর্থ , কাকু ,এদিকে এসো।
এবার রিয়াকে খুঁজে পেলাম আর চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম সকলে। একটু দূরেই বানান নদীর জলে তখন অস্তায়মান সূর্য স্নানে ব্যস্ত জল পড়ী দের সাথে। তাঁর দুপাশের বালুকারাশি চিক্ চিক্ করছে সোনার মতো।জলের ঢেউ য়ে ঢেউয়ে হাজার আলোর ঝিলিমিলি।দুপাশে শ্বেত পাথরের বসার জায়গা আর মাঝখান থেকে সিড়ি নেমে গেছে জল অবধি। আমরা চিত্রার্পিতের মতো তাকিরয়ে রইলাম। চমক ভাঙলো সাম্য রং মুগ্ধ শব্দে What A beauty!! রিয়া কলকল করে উঠলো । আর সূর্যের সোনালী আলোর স্বপ্নীল মায়াজালে মোহাবিষ্টের মতো আমরা বসে রইলাম সেখানে। এঁকে বেঁকে ঘন বনানীর মধ্যে যেন অভিসারে গেছে সুন্দরী বানাস।
হঠাৎ ই কানের কাছে বাজখাঁই গলায় কে বলে উঠলো
----- ইস বকত বাহর মত রহিয়ে সাবজী । ডর হ্যায়।
এত সুন্দর জায়গায় কিসের ডর রে বাবা! যাইহোক, সামর্থ আমাদের শোনাল সে কিভাবে আজকের রাত টা এই প্যালেসে থাকা ম্যানেজ করেছে। একটি সরকারি অতিথির দল আজ দুপুরেই এই গেস্ট হাউস খালি করে গেছে। আবার কাল সকালে বুকিঙ। আজ রাতটা ভাগ্যক্রমে আমরা পেয়ে গেলাম। সবাই সাম্যর বুদ্ধির প্রসংশা করে ভিতরে রাবার জন্য পা বাড়ালাম। এর মধ্যেই ড্রাইভার এসে জানাল কাছেই তার বাড়ি। সে আবার কাল ভোরে পৌঁছে যাবে। যাবার আগে একটু থমকে সে বলল
-- রাত কো বাহর মত নিকলিয়েগা সাবজী।
একটু অবাক হলেও তখন আমাদের শহরী মন চা চা করছে।রিয়া আয় সামর্থ তখনো বানানের জলে পা ডুবিয়ে জল ছোড়াছুড়ি করছে। ওদের বেঁকে নিয়ে চললামবেয়ারার পিছন পিছন ডাইনিং হলে। সেখানে গিয়েই মন ভালো হয়ে গেল। রাজকীয় ব্যাপার বোধহয় একেই বলে।পুরো মেঝে লাল কার্পেটে মোরা , চকচকে শ্বেত পাথরের টেবিল আর চেয়ার ও লাল মখমলি কাপড়ে মোড়া। দেওয়ালে দেওয়ালের ঝারলন্ঠন আর মৃত জঙ্গলী জানোয়ারদের সাজানো মাথা , তাদের চকচকে চোখ পরিবেশটাকে আলো আঁধারির রহস্য মাখিয়ে রেখেছে।করি পাতার ছোক লাগান গড়ম ছোলার ডালের পকৌরা আর গড়ম চা আমাদের দুদিনের ক্লান্তির অবসান ঘটালো। চা খাওয়া হলে আমাদের ঘরে পৌঁছে দিল বেয়ারা। ঘর তো নয় যেন ছোটখাটো ফুটবল খেলার মাঠ। উঁচু কাঠের ডাবল সিলিঙ। বর্তমানের বদলে রয়েছে ফায়ার প্লেস।সব কাঠের ফার্নিচার। কেয়া , সামর্থ আর রিয়া এক ঘরে আর আমরা তিনজন এক ঘরে। মাঝখানে একটি দরজা। স্নানঘরে শ্বেত পাথরের বাথটাব। সবাই ফ্রেস হয়ে জমিয়ে গল্প করছিলাম।জানলা দিয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কূহকিনী বানাস । এই নদীতে এখন নাকি ক্রোকোডাইল প্রোজেক্ট হয়েছে।। গল্পে বাধা দিয়ে ঘরে ঢুকলো বেয়ারা। রাতের খাবার খেয়ে নিতে হবে । তাঁর পর তার বিউটি শেষ । ঠিক আটটায় সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় বাইরের । এটাই নিয়ম।
দরওয়াজা খুলা মত ছোড়িয়ে বাবুজী। ডর হ্যায়।রহস্যময় গলায় বলে গেল লোকটা।
এত তাড়াতাড়ি খাবার ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হল। কেয়া একটু বিরক্ত । অথবা ভয় পেয়েছে।
--বার বার ডর হ্যায়। ডর হ্যায়। কিসের ডর রে বাবা! জলের কুমীর কি উঠে আসবে দোতলায়?
ডাইনিঙ হলে পৌছে মন ভালো হয়ে গেল। সুন্দর ভাবে টেবিল সাজানো। বড় বড় কাঁসা র থালায় ধবধবে সাদা ভাত,বেগুন ভাজা ,হীঙ এর ফোড়ন দেওয়া বিউলির ডাল আর বন মুরগীর ঝোল।
-আপ লোগোকা নসীব আচ্ছা হ্যায় সাব। পকড় লিয়াথা এক।
বাজার এখান থেকে অনেক দূরে। মা ছিল তার সাথে লুকিয়ে ধরা বন মুরগির ঝোল উপরি পাওনা। মুখে দিলাম। অমৃত। বয়লার মুর্গি খাওয়া মুখ আহা আহা করে উঠলো।লোকটি কিন্তু ছটফট করছিল কখন খাবার শেষ হয়। খাবারের দামের সাথে ভালো বখসিস পেয়েও সে একরকম দৌড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় ও সাবধান করে দিল
-রাত মে বাহর নহি নিকলনা সাহাব। খতরা হ্যায়।
এবার কেয়া গেল রেগে । সে বললো-
তোর মাথা হ্যায়। মুন্ডু হ্যায়।
আমরা ওর হিন্দি শুনে একচোট হেসে নিলাম।
জানলার বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার।আমার দুই বন্ধু শোয়া মাত্র নরম বিছানার কাছে আত্মসমর্পন করলো। একটু পরেই তাদের নাসিকা ধ্বনি শোনা গেল।ঘুমের আর দোষ কি। দুদিনের যার্নি তে সবার শরীর ই আরাম চাইছে। ওই ঘর থেকেও রিয়া আর সাম্যর হা হা , হি হি র আওয়াজ আর কেয়ার ধমকানি ও বন্ধ। আমার কেন যে ঘুম আসছেনা! বাইরে একটানা ঝি ঝি র আওয়াজ। বিরামহীন। এ ছাড়া ও কত যে আওয়াজ। পাতার খসখস শব্দ, শেয়ালের ডাক, রাতজাগা পাখিদের ডানার ঝটপট, আরো কত যে শব্দ সেই নৈঃশব্দের মধ্যে তা বর্ণনা করা যায় না।
কখন যেন চোখ জড়িয়ে এসেছিল।হঠাৎ জেগে গেলাম । কিসের শব্দ ঘুম ভাঙলো বোঝার আগেই একটা একটানা গোঙানি আর সঙ্গে বিকট অট্টহাসি। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। শহরের জীবনে ভূত আমাদের বৃষ্টির দিনে তেলেভাজার উপকরণ । কিন্তু এই অজানা অরণ্যের নিকষ কালো অন্ধকারে আমার সব শহুরে ঠাট্টা শূন্য তে মিলিয়ে গেল। আবার আবার সেই বিদঘুটে হাসি। হাসি না কান্না সেটা বুঝে ওঠার আগেই কেউ জোরে দরজায় ধাক্কা মারলো। কেউ দরজার গায়ে আছরে পরছে। এতটাই জোরে মনে হচ্ছে এবার দরজাটা ভেঙে যাবে।আমার হৃৎপিন্ডের গতি আমার আয়ত্তের বাইরে । চেষ্টা করলাম আমার ঘুমন্ত দুই বন্ধুকে ডাকবার কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না।
এমন সময় খটাস করে দুই ঘরের মাঝখানের দরজাটা খুলে গেল।কেয়া ঝোড়ো পাতার মতো এসে সমর কে জড়িয়ে ধরলো । ওর মুখ কাগজের মতো সাদা।তাঁর মানে আমি একা নয় । কেয়া ও জেগে ছিল । ধর্মের করে উঠে বসলো সমর।।
আবার খুব জোরে দরজায় ধাক্কা। তারপর একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। একটা মরণ চিৎকার । আবার সব চুপ্। এতক্ষণে বুকে বল পেলাম । উঠে লাইট জালালাম ।হতভাগা অতীশ এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাকে ডেকে তোলা হল । দূরে হাসির শব্দটা এখন মনে হচ্ছে কোন বাচ্চা টৈনে টেনে কাঁদছে। সব শুনে উৎকর্ণ হয়ে শুনে পরম নিশ্চিন্তে বললো
- দূর, এতো ভীতু তোরা ! ওতো হায়নার ডাক আর শকুনের কান্না। ঘুম টাই নষ্ট করে দিলি।
অতীশের ঘোরার নেশা। এর আগেও ওর এইসব অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের সামনেই ও আবার শুয়ে পরলো। দেখলাম রাত সাড়ে তিনটে বাজে। নাঃ। আর ঘুম হবে না। অতিরিক্ত ভয়ের পরে কেমন একটা নিস্পৃহতা কাজ করছিল। বাইরে কে ছিল না দেখা অবধি শান্তি পাচ্ছি না। সমর কে ডেকে খিল টা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোলাম। অনেকক্ষণ কান পেতে থেকেও কোন আওয়াজ নেই । যেন পুরোটাই দুঃস্বপ্ন। সাহসে ভর করে আস্তে করে দরজাটা খুললাম। এক ঝলক জোছনা ঝাঁপিয়ে পরলো ঘরের ভিতর।চারিদিক শান্ত। জঙ্গল যেন সারারাত কোন নাটক প্লে করে এখন ঘুমিয়ে পরেছে।বাইরের জোসনা ধোঁয়া চাঁদে রং আলো আর ঠান্ডা মিষ্টি হাওয়া যেন কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সব ভয় উড়ন ছু করে নিয়ে গেল।
- অপূর্ব।
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কেয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চড়াচড়।বানান নদী যেন এক রূপবতী কন্যা। রূপোর কাঠির ছোঁয়ায় কেউ তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম। রাতের জঙ্গলের এই অপরূপ রূপ দেখা হত নাযদি না সাহস করে বাইরে আসতাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ একটা গাড়ির হর্ণ এই নৈঃশব্দকে খান খান করে দিল। ড্রাইভার তার কথামতো এসে পরেছে।ডাইনিঙ হলে তা আর গড়ম মাখন টোস্ট খেতে খেতে শুনলাম কাল রাতের রহস্য।
-- কাল রাত এক বড়া চিতা আয়াথা সাব। গেস্ট হাউস টা কুত্তা কোন উঠাকে লে গিয়া। ইসিলিয়ে আপলোগোকো মানা কিয়া থা রাত কো বাহর নিকলনে কে লিয়ে। বহত চিতা হ্যায় ইধর।
মনটা খারাপ হয়ে গেল । প্রাণি টা বাঁচার জন্য বার বার ঘরে ঢুকতে চাইছিল ।এটাই বোধহয় জঙ্গলের নিয়ম । মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
জীপে উঠে বসলাম । হঠাৎ কোন জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় সারা জঙ্গল জেগে উঠলো।হাজার পাখি একসাথে খেয়ে উঠলো জাগরনির গান।সেই অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা যায় না। জিপ ছুটে চললো দুপাশের জঙ্গল চিরে। অপেক্ষা করছে বান।ঝড় ঘরের বন্ধুরা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct