সাজেদুল হক: এক বহুমুখী প্রতিভার সংগ্রামমুখী ছিন্নভিন্ন জীবনের নাম সৈয়দ আসরার আহমেদ। গত ৮ ডিসেম্বরে ইন্তেকাল। আসরার আহমেদের জন্ম বীরভূমের বিখ্যাত মাড়গ্রামে। এই গ্রামে জন্মেছেন দুই বাংলার বিখ্যাত কুদরত-ই-খুদা ও আরো অনেক চিরস্মরণীয় মনীষী। গাছগাছালিতে ভরা এই গ্রামে আছে বড় দিঘী সহ ছোট বড় জলাশয়। গ্রামের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে চলে গেছে ছোট নদী আঁকা বাঁকা হয়ে। আছে বিখ্যাত মাজার সহ কিছু দেবালয়।পঞ্চাশ বছর পূর্বে দেখা আসরার আহমেদ রুমীর এই গ্রাম । জন্মভূমির রাঙামাটির লাল রঙ তার বুকের মধ্যে ছিল সারা জীবন। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে নতুন করে গড়ার প্রয়াস ছিল আজীবন । নিজের জীবন ও বারবার ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে চেয়েছে। তাই সারা জীবনব্যাপী ছিল শান্তহীন ,শান্তিহীন। বারংবার বিনির্মাণ চলেছে তার জীবনের তলদেশে, তার ঢেউ তাকেই স্থির হতে দেয়নি কোনদিন। রাজনীতি-সমাজ সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মজীবন , কোথাও একান্ত আশ্রয় খুঁজে পায় নি। মহৎ সৃষ্টিশীল মানুষের মত তাঁর নিভৃত হৃদয়ে ছিল সতত অতৃপ্তি। একনিষ্ঠতার অভাবে একটি অতীব সম্ভাবনাময় প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটেছে,জীবনাবসানের পর তাঁর জীবন জরিপে এটাই শুধু বেদনা ।
সৈয়দ আসরার আহমেদ বহুমুখী প্রতিভার জীবনের বিন্যাসে ছিল তাই স্বাভাবিকভাবে বহুমুখীনতা , কর্মজীবনে ছিল অনিবার্য উত্থান-পতনের বিব্রত রূপরেখা। ইংরেজি ও বাংলা লেখনীতে ছিল তুখোড় , ইংরেজি বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতায় ছিল অসামান্য সাবলীল ও সমান পারদর্শী ।
আমার হারিয়ে যাওয়া অতীতে এখনও স্পষ্ট, ১৯৬৭ সালে মৌলানা আজাদ কলেজের প্রাঙ্গণে নবাগত এক ছাত্র আগমার্কা বামপন্থী ছাত্রদল ডিএসও-র ছাত্র নেতা, সৈয়দ আসরাস আহমেদ আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিচ্ছে। এই বাগ্মী ছাত্র নেতার বক্তৃতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না । কে এই ছাত্রনেতা? কলকাতার বিখ্যাত আলিয়া মাদ্রাসা স্কুল থেকে পাশ করা আমারই সতীর্থ এক বছরের সিনিয়র ,বাংলা অনার্সের ভালো ছাত্র সৈয়দ আসরার আহমেদ । শৃঙ্খলাবদ্ধ এই ছাত্রদলের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের জেরে দল থেকে সরে আসা। উল্লেখ্য, ঐ সময়ে কিংবা একটু পরে এস ইউ সি পার্টির তরুণ নেতা প্রাবন্ধিক আব্দুর রউফ (বর্তমানে আব্দুর রাউফ ) দলীয় দৃষ্টিকোণে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করছেন সমাজ বদলের অভীপ্সায় , অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে পর্বান্তর ঘটিয়ে ‘রাস্তা ‘ নামে একটি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করে মহসীন স্কোয়ারের পূব দিকে একটা তিন তলা বাড়ির ওপরে নিয়মিত সাহিত্যের আসর ও নাটকের মহড়ায় চলছে সংখ্যালঘু সমাজের সাহিত্য সংস্কৃতি প্রগতির প্রয়াস। তরুণদের কাছে আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর । এই মেসবাড়ির ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছিল সাহিত্য ও নাট্য অভিনয়ের সূতিকাঘর । কিন্তু এই বিবিধ উদ্দেশ্য পূর্তির পূর্বেই। আসরার আহমেদের পিতৃবিয়োগ ঘটে। সদ্য বাংলা অনার্স পাশ করে বাবার চাকরী ‘ইনকাম ট্যাক্স ‘বিভাগে চাকুরি নিতে বাধ্য হয় । অতঃপর বিবাহিত হয়ে নিস্তরঙ্গ সুখীগৃহী জীবনের বদলে অশনিসংকেত, চাকুরিতে অনীহা । আবার রাজনীতিতে আগ্রহ, নকশাল আন্দোলনে প্রভাবিত । এই দিনগুলোতে বেকার হোস্টেলে থাকার সময়ে নকশালদের কোপে আমি পড়ায় সে আমাকে বাঁচাতে তাঁর সৈয়দ ইমদাদ আলি লেনের মেস বাড়ি আশ্রয় দেয় এবং নকশালদের সাথে আপোষের ব্যবস্থা করায় বেকার হোস্টেলে ফিরতে পারি। এইভাবে জীবন শেষ দশ বছর বাদে আজীবন অম্লমধুর বন্ধুত্ব ।
এই আসরার আহমেদ একদিন হঠাৎ চাকুরি ছেড়ে বিদেশের একটি মিডিয়ায় অনুবাদকের কাজ নেয়। তর তর করে কর্মবিভাগে শীর্ষে ওঠে। ঠিক তার পরেই দেশের জন্য মন টানায় ওদেশের চাকরি ছেড়ে ফিরে এসে কলকাতায় কিছুদিন দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে শেষে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা ইংরেজি সিনেমা হলের (যমুনা) টিকিট মাস্টার হয়। কিন্তু সিনেমা হলের সাধারণ কর্মীদের আর্থিক দুরবস্থার জন্য মন কাঁদে, তাই একদিন নিজের ভালো বেতন,স্বচ্ছল জীবন সত্ত্বেও সিনেমার কম মাইনের কর্মীদের স্বার্থে মালিকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।পরিণতিতে চাকরিতে ছাঁটাই ।আবার অনিশ্চিত জীবন । এবার আরো কঠিন জীবন ।
সৈয়দ আসরার আহমেদ জীবনে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে বাস্তবের মাটির ওপর।আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছে বহমান কালস্রোতের ওপর। নিঃস্বতার কাছে কোনদিন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে নি। এর মধ্যে আবার কিছুদিন আমার সম্পাদনায় ও আমার সাথে যৌথ মালিকানায় লাভে চলা ‘সাপ্তাহিক সভ্যতা পত্রিকা’ র কর্মীদের দুগুণ বেতন বাড়িয়ে পত্রিকার মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করায়। এই দুর্দিনের দিনগুলোতে কখনও এনজিওর কাজ নিয়ে পরিশ্রমের তুলনায় অত্যন্ত কম পয়সায় বাঁচতে হয়েছে। কখনবা ‘দৈনিক আকর্ষণ’ ‘সাপ্তাহিক কলম ‘ বা ‘সাপ্তাহিক নতুন গতি’ পত্রিকা কিংবা কদাচিৎ ‘আপনজন’ পত্রিকায় লিখে সংসার চালাতে হয়েছে। কখনও বা ইংরেজি মেডিকেল জার্নালে ইংরেজিতে সাংবাদিকতার চাকরি, কখনোবা কলকাতা থেকে দূরবর্তী গ্রামে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের প্রতিষ্ঠা করে, কখনোবা কলকাতার উপকন্ঠে স্কুলে সামান্য অর্থে শিক্ষকতা করে জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে । এই সময় সাংবাদিকতার বিষয়ে তার লেখা অসাধারণ একটি বই প্রকাশ, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের কাছে এই গ্রন্থ আজো অত্যন্ত মূল্যবান ।
সৈয়দ আসরার আহমেদের শেষ দিনগুলো ইংরেজির শিক্ষক জ্যেষ্ঠ পুত্রের আশ্রয়ে শান্ত, সৌম্য, সংযত , সৃজনশীল হয়ে উঠছিল ; পুনর্বার সাহিত্য সংস্কৃতির অভিমুখে যাত্রা অভিলাষে বারংবার দিকভ্রান্ত নাবিকের যেন সঠিক দিশায় পুনর্জন্মলাভ ঘটছিল। ইতিপূর্বে দুটো বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ায় মুখের একদিকে অপারেশনে বাদ দিয়ে কৃত্রিম চোঙাল সংযোজিত করতে হয়। স্বাভাবিক বাকচারিতায় বিঘ্নিত হয় বাকপটু আসরার আহমেদের । দ্বিতীয়ত, স্ত্রী বিয়োগে একাকীত্ব হয়ে পড়া।
একটা কথা, আমার ব্যক্তিগত জীবনে ও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কিত সৃজনে আসরার আহমেদের একটা উৎসাহ বিশেষত আমার কবিতা রচনায় সত্তর দশকের সময় থেকে ছিল। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে ‘দেশ ‘পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশ হচ্ছিল, বিদেশে থেকেও তা পাঠ করেছিল, অভিনন্দন জানিয়েছিল। আমার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ছিল। এমন কি প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ ‘আমার নীল কন্ঠ অরণ্যে মৃগয়া’র শুধু প্রশংসা করে ক্ষান্ত হয়নি, প্রায় এক দশক আগে কাব্যের ইংরেজি অনুবাদে হাত দিয়েছিল। একান্ত ব্যক্তিগত কারণে বহু বছর তার সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখিনি। মাস চারেক আগে ফোনে আমার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে ফোনে কথাবার্তা বলে খোঁজ খবর নিয়েছিল।সম্প্রতি সোনারপুরের এক সাহিত্য সম্মেলনে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিল,ওর সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। করোনার জন্য বছর দুয়েক প্রায় ঘরবন্দী,তাই বাইরে যেতে অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলাম। আসরার আহমেদ আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল বাড়িতে এসে। বলেছিল, করোনার বেড়া পার হয়ে, আমি যদি আসতে পারি তোমার এত ভয় কেন? তবুও আমি ‘না’ করেছিলাম। কারণ,ওর আবেগের কাছে আমার সব বাঁধ ভেঙে যায়, আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। অতীতে হয়েছে বারবার,এখন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না । তাই আমি ‘না’ করেছিলাম । তার চিরকালের মত চলে যাওয়ার পরে আমার এখন একটাই খেদ, আমার বাড়িতে তার সাম্প্রতিক আসার আগ্রহে আমি কেন দাঁড়ি টেনে দিলাম । তখন আমি স্বপ্নে ও ভাবতে পারি নি, ওর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না!
লেখক প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
সুন্দরবন হাজী দেশারত কলেজ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct