কাশ্মীর মানে ভূস্বর্গ। কাশ্মীর মানে এক উদাস স্বপ্নে ভেসে আনন্দে বিভোর হওয়া। কাশ্মীর মানে সাদা বরফের ঢাকা প্রান্তর, সবুজ ঢাকা অথবা উলঙ্গ উচ্চ পাহাড়। এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যভরা স্বর্গ কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর মানে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীবাদীদের হামলা-মৃত্যু অথবা সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে মৃত্যু। সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের-অনুপ্রবেশকারীদের হামলা, কত শত মায়ের পুত্র, কত স্ত্রীর স্বামী, কত পুত্রকন্যার পিতার রক্তাক্ত দেহ অথবা সেনাবাহিনীর এ কে ৪৭-এর গুলির শব্দ। কাশ্মীরের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি পাহাড় পর্বত উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমনই আতঙ্ক। সম্প্রতি কাশ্মীর উপত্যকা ঘুরে এসে নিজের সরেজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এস এম শামসুদ্দিন। আজ তৃতীয় পর্ব।
হাওড়ার বাকসাডা আমার বর্তমান বাসস্থলের নিকটেই । অমরেশ ধাডা ওরফে অনামিকা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের তত্বাবধানে এই ১৪ দিনের ভ্রমনের ব্যবস্থাপনা ।সুষ্ঠ স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ।কাশ্মীরে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন ।
ভোর রাত থেকেই বটলা দা আর তিন সঙ্গীদের নিয়ে দুপুরের খাওয়ার আয়োজনের পূর্ব প্রস্তুতি চলছে ।মাছ ডাল আর বাঙালীর প্রিয় মাছের কারী রেডি বেড টি দেওয়ার আগেই ।সকালে জলখাওয়ার খেয়ে আমরা প্রস্তুত ।বটলা দা বললেন চিন্তা আমরাও রেডি ।আরে বলেনকি ।দুপুরের খাওয়ার রেডি ?আরে দাদা আর তো সময় পাবো না ।আমরা আজ গুলমার্গ যাবো ।সকালে গাড়ি ছাড়লো ৮ টায় ।তিনটি গাড়ি পর পর চলেছে ।ডাল লেক পাশে ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম অজানা পথে ।ক্রমশ শহর পাতলা হতে হতে ক্ষীণ হয় ।এরপর শুধুই পাহাড়ী পথ ।উঠছি তো উঠছি চড়াই পাহাড়ী পথে । পাশে গভীর খাদ আর অন্যদিকে সল্পবেশি অর্ধনগ্ন নারীর মতোই পাহাড়ের বুক ঘিরে ইতস্তত বিন্যস্ত পাইন গাছের উপস্থিতি ।এক সময় সেটাও উধাও একেবারে উলঙ্গ পর্বত আর গভীর খাদ ।আমার সঙ্গীরা চোখ বুজে দুআ দরুদ পড়ছে আর অন্যরা দেবদেবীকে স্মরণ ।
বুকটা শুকিয়ে যাওয়ার মতোই ভয়ঙ্কর পথ ।একসময় অনেকটা এই দুর্গম পথ পর হতে হতে এক সময় চোখ বুক রপ্ত করে সাহসী হয়ে উঠলাম ।ড্রাইভার ইমরান বলল অভি তো কুচ নেহি ।রাস্তা বাড়িযা হায় ।পাশাপাশি দুটো গাড়ি বেশ গতিতেই পাশ হয়ে যাচ্ছে ।আর আগে সেটাও ছিল না । এই দুর্গম পথের পাশে গভীর খাদে গাড়ি পড়ে থাকার কিছু দৃশ্য চোখে পড়লো।আমরা প্রায় ১২ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গুলমার্গে। প্রশস্ত পথের পাশে মাঝে মাঝে একেকটা হোটেল ।আর তার পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ।সেনাদের গাড়ি চলেছে বন্দুক উঁচিয়ে ।পাশেই অসংখ্য ঘোড়া দাঁড়িয়ে ।কাশ্মিরীযুবকরা ঘোড়া নিয়ে সোয়ার করাতে প্রস্তুত। আমরা বাস থেকে নেমে
একটা জায়গায় দাঁড়ালাম ।সামনেই দেখা যাচ্ছে উচ্চ পাহাডের উপর বরফ ঢাকা
।বরফ দেখব।বরফ নিয়ে খেলব ।বরফের মাঝে যাবো ।এত কাছে এসে বরফের সংস্পর্শ পাবো এ যেন মেনে নিতে কেউই রাজি নয় ।কিন্তু ওই দূরে বরফ দেখা গেলেও সেটা তো নাগালের বাইরে ।কাশ্মিরী কচোয়ান যুবকরা এসে বরফ দেখিয়ে আনতে প্রলোভন দেখাচ্ছে ।একেকজন একেকটি ঘোড়ায় ১০০০-১২০০ /-।হাঁকছে ।বাঙালীক ধুর বানানা বহুত মুশকিল বাবু -কে একজন বলল পাশ থেকে ।কিৎনা ঠিক সে বলিয়ে।৩০০-৪০০ হোগা।
ওদের আবার দালাল রয়েছে ।যা নেবে তার ভাগও রাখবে ।লোকসংখ্যা অনুপাতে ঘোড়ার সংখ্যা বিচার করে কেউ কেউ তো দান মেরে দেওয়ার মতো চালাকি করে ৮০০-৯০০-১০০০/-টাকাতে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চললো ।তাঁদের ভাব দেখে মনে হলো দান মেরে দিয়েছি আমরা ।ক্রমশ ভিড় কমছে আমরা কয়জন দাঁড়িয়ে দেখছি আর ভাবছি । একেতো ঘোড়ায় চড়ার বাদশাহী অভ্যাস নেই ।মোটামুটি দেহের পরিধি আর ওজনের হিসেব বুঝে থমকে দাঁড়িয়ে । পা পা করে এগিয়ে গেলাম সামনে আরো সামনে চড়াই পথে ।কিছুটা দূরে যাওয়ার পর কলকল রবে পাহাড়ের বরফ গলা জল বয়ে চলেছে পাহাড়ের পায়ের নিচে পাথর ভরা নদীর বুকে ।একটা কালভার্টের কাছে বসে পড়লাম।আর পারি না ।এইটুকুতেই ব্যাস,হ্যাঁ এইটুকুতেই ।বাড়ির পাশে বি গার্ডেনে রমেন বাবুর বার বার অনুরোধেও না যাওয়ার ফলে ফলছে হাতেনাতে।
আহারে সাধের শরীর মুখ বাদবে না বোঝো ঠেলা।নাহ ।ইচ্ছে থাকলে উলায় হয় ।ঘোড়া ওয়ালা একজন এসে বলল ৩০০ কারকে দেনা চালিয়ে ।বললাম ৩০০ নেহি বাবু উস্কা সাথ আউর ভি ১০০০ ডাক্তারকা দাওয়াই জোড় লিজিয়ে ।
ও তুমি বুজতে নেহি পারেগা।
কিছুক্ষণ পর এক গাড়ি ওয়ালা এল ।বলল বাবু জিরো পয়েন্ট তাক লেকে জায়েঙ্গে ।৫০০০/-
আগত্যায় আমরা ৪০০০/- টাকায় ঠিক করে উঠে বসলাম ।
সুম গাড়িতে আমরা আটজন । সঙ্গী সাথীরা সব যে যার মতো চলে গেছে আগেই । আমরা চলেছি জিরো পয়েন্টে ।একেবারে গাছ পালাহীন উলঙ্গ পাহাড় ।কালো ধূসর পাথর আর আরও ভয়ঙ্কর সরু পথ ।শূন্য পাহাড় ।দুপাশেই পাহাড় মাঝে বরফ গলা ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে আপন গতিতে । এই পথেই লাদাখ যাওয়ার পথ ।মাল ভর্তি গাড়ি লরি চলেছে – চলেছে ভ্রমনে আসা মানুষের গাড়ি ।পাহাড়ের উচ্চতা থেকে দেখা যাচ্ছে অন্যদিকে পাহাড়ের কোলে কিছু কচু ঘর বাড়ি।
আরে ভাই ইধার কোন রাহতা হ্যায়।
সাদেক ভাই ড্রাইভার । ইয়ে সব ইধার রাহতা হ্যায়।ভেড়া ছাগল এই পাহাড়ের গায়ে চরাই ।যখন যেখানে বরফ পড়ে এরা ছাগল ভেড়া নিয়ে নেমে যায় নীচে ।শহরে আত্মীয়দের কাছে গিয়ে থাকে ।বছরে তিন চারমাস এরা নীচে থাকে ।বরফ
সরে গেলে এরা আবার ফিরে আসে।
গাড়ি যাওয়ার পথেই দেখলাম পাল পাল ভেড়া ছাগল নিয়ে পাহাড়ী পথে হেঁটে চলেছে কাশ্মিরী ছাগ পালকরা । কি অদ্ভুত এদের জীবন !
যাযাবরের মতোই এতেই এরা অভ্যস্ত, সরল - স্বাভাবিক । পাহাড়ের অনেকটাই উৎরাই পথে আমরা চলে এসেছি ।মাঝে মাঝে পাহাড়ী রাস্তা চওড়া করার কাজ চলছে ।ওরই মাঝে একদিকে সরু রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে পাশ করিয়ে দিচ্ছে অন্য গাড়িকে ।বরফে ঢাকা এক পাহাড়ী উপত্যকা সামনে বেশ ফাঁকা মাঠ।দুদিকে উচ্চ পাহাড়ের বুক মাথা শরীর ঢাকা সাদা বরফে । এক পাশে পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে বরফগলে জলের ধরা বয়ে চলেছে প্রবল স্রোতের ধারা অবিরাম ।
আমাদের গাড়ি এই ফাঁকা মাঠে নামিয়ে দিতে বললাম ।আরও ভয়ঙ্কর পথ দেখছি সামনে ।ভীত সন্ত্রস্ত সাথীরা ।তাই নেমে পড়লাম নীচে ।গাড়ি থামিয়ে আমরা নেমে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণার কাছে। অসম্ভব শীতল জলের ধারা ।হাত ঠেকাতেই বোঝা গেল ঠান্ডার তীব্রতা ।আঙুলের জলস্পর্শের অংশ অসাড় প্রায়।শীতলতম জলের ছিটা বিন্দু বিন্দু এসে দেহকে জানান দিচ্ছে ।সমতলের অধিবাসী আমরা এমন জলপ্রপাত দেখে আত্মহারা হওয়ারই কথা ।ছবির পর ক্লিক করছে ছোট পুত্র লামান ভাগ্নে সাহিল ছবির ছবি তুলেও ওদের মন ভরে না ।স্মৃতির স্মরণীকায় এ দৃশ্য অমলিন চির ভাষ্মর হয়ে থাকবে।
কি অদ্ভুত এ মহিমা আর স্রষ্টার কি অপার সৃস্টি। সমুদ্র যদি নালা খাল বিল থেকে গ্রীষ্মের দাবদাহের পিঠে চড়ে জল বাষ্প উঠে যায় হালকা শরীরে ঊর্ধকাশে আবার বরফ হয়ে ঝরে পড়ে পাহাড় চূড়ায় গাছে পথ ঘাটে।তাপের সঙ্গে বিবাদের জেরে শক্ত পোক্ত কঠিন বরফ ক্রমশ নরম শীতল গলে জল হয়ে গড়িয়ে আসে উঁচু থেকে নিচে।গাছ গাছালি পশু পক্ষী মানুষের খাদ্য সৃষ্টির আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসে নিচে ক্রমশ সমতলে ।কি অদ্ভুত স্রষ্টার লীলা খেলা।
হে মহান স্রষ্টা তোমার সৃষ্টি কৌশল মহিমা বোঝা বড়ই কঠিন ।তুমি কতই না মহান ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct