২৯টা বছর কেটে গেছে। কিন্তু এখনও ৬ ডিসেম্বর এলেই
বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে চর্চা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে তার অস্তিত্ব থাক বা না থাক বাবারি ধ্বংসের স্মৃতি কিন্তুএখনও দেশের মানুষ মন থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। তাই এই দিনটি এলেই দেশের বিভিন্ন ষংবাদমাধ্যমও ফের চর্চিত বিষয় করে তোলে বাবরি মসজিদ রামমন্দির প্রসঙ্গ। রামমন্দির তৈরি কিংবা বাবরি ধ্বংসের বিষয় নিয়ে হয়তো আলোচনা অবিরাম চলতেই থাকবে। সেই স্মৃতি রোমন্থন করেছেন আব্দুস সামাদ মণ্ডল। আজ প্রথম কিস্তি।
৯টা বছর কেটে গেছে। কিন্তু
এখনও ৬ ডিসেম্বর এলেই
বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে চর্চা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে তার অস্তিত্ব থাক বা না থাক বাবারি ধ্বংসের স্মৃতি কিন্তুএখনও দেশের মানুষ মন থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। তাই এই দিনটি এলেই দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও ফের চর্চিত বিষয় করে তোলে বাবরি মসজিদ রামমন্দির প্রসঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাবরি স্থলে রামমন্দির তৈরি কিংবা বাবরি বিকল্প জমি দান নিয়ে হয়তো আলোচনা অবিরাম চলতেই থাকবে। সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে বাবরি মসজিদের ইতিহাসের ম্মৃতিচারণা।
নামকরণের ব্যুৎপত্তি
“বাবরি মসজিদ”-এ নামকরণ করা হয়েছে মুঘল সম্রাট বাবরের নামে, তিনিই এ নির্মাণ কাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মসজিদের নির্মাণপদ্ধতি
দিল্লির সুলতানি এবং তার উত্তরাধিকারী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা শিল্প এবং স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাদের নির্মিত অনেক সমাধি, মসজিদ ও মাদ্রাসা সূক্ষ নির্মাণকৌশলের নিদর্শন বহন করে। মুঘলদের স্থাপত্য তুঘলক রাজবংশের স্থাপত্যের প্রভাব বহন করে যার একটি স্বতন্ত্র গঠনশৈলী আছে। ভারতের সর্বত্র, মসজিদসমূহের ভিন্ন ভিন্ন গঠনশৈলী আছে যা বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এই নির্মাণগুলির মধ্যে আদিবাসী শিল্প ঐতিহ্য এবং স্থানীয় কারিগরদের মার্জিত শৈলী ও দক্ষতা উভয়ই প্রকাশ পায়। মসজিদের নির্মাণে আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক জলবায়ু, ভূখণ্ড, উপকরণ ইত্যাদি প্রভাব ফেলতো যার ফলে বঙ্গ, কাশ্মীর ও গুজরাটের মসজিদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মসজিদগুলি শুধুমাত্র স্থানীয় মন্দির বা গার্হস্থ্য গঠনশৈলীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। বাবরি মসজিদ জানপুরের সুলতানি স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে।
বাবরের মসজিদ ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ ছিল। এক শ্রেণির হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস, এ বাবরি মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত ছিল সেটাই ছিল হিন্দু ধর্মের অবতার রামের জন্মস্থান। যদিও এর যথেষ্ট প্রমাণের অভাব আছে, এই বিষয়টি নিয়ে আঠারো শতক থেকেই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছে, যা অযোধ্যা বিবাদ নামে পরিচিত।
১৭৮৮ সালে এক খ্রিস্টান পাদরি ‘জসেফ টাইফেন’ হিলেন প্রথম কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়াই বাবরি মসজিদের আশেপাশে কোনও এক জায়গাতে ‘রাম জন্মভূমি’র কথা উল্লেখ করেন।
তারপর, ১৮৮৫ সালে মাহান্ত রাঘুবার দাস ফাইজাবাদ জেলায় এক আদালতে ‘রাম মন্দির’ স্থাপনের জন্য আবেদন করে। যদিও আদালত ১৮৮৬ সালে সেই আবেদনকে খারিজ করে দেয়।
১৯৪৯ সালে ২২ শে ডিসেম্বরে রাতের অন্ধকারে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী দল বাবরি মসজিদের ভীতরে রামের এক মূর্তি রেখে দিয়ে আসে। এরপর থেকে মুসলমানদের মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া শুরু হয়।
১৯৫০ সালে ৫ জানুয়ারিতে জেলা আধিকারিক কে কে নায়ার মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়।
সঙ্গে হিন্দুদের পুজা আর্চনা করার অনুমুতি দেওয়াও হয়। এমনকি মুসলিমদের ‘বাবরি মসজিদের’ আসে পাশে যেতে বাধা দিতে থাকে। এই ঘটনার পরেই কে কে নায়ারকে লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় ‘জন সঙ্ঘ দল’ থেকে টিকিট দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি ভারতের চতুর্থ লোকসভা নির্বাচনে বাহরাইচ লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৫০ সালে ‘হাশেম আনসারি’ বাবরি মসজিদের দরজার তালা খোলার জন্য ফাইজাবাদ আদালতে আবেদন করেন। এর ঠিক কয়েকদিনের মধ্যে ‘গোপাল বিশারদ’ ও ‘মহান পরাভাংস চন্দ্র দাস’ আদালতে পূজার জন্য আবেদন করেন।
তার ঠিক কয়েক বছর পরে ১৯৫৯ সালে ‘নির্মোগি আখাড়া’ মন্দিরের আধিকারিদের ‘রামের’ মূর্তি সরিয়ে আখাড়াদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করে।
১৯৬১ সালে উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের পক্ষ থেকে মসজিদে মুসলিমদের নামাজের জন্য আবেদন করে আদালতে।
১৯৮৪ সালে ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ রাম মন্দির স্থাপনের জন্য এক কমিটি গঠন করে। এর পর ‘রাম মন্দির’ স্থাপনের জন্য জোর কদমে বিভিন্ন আন্দোলন চালাতে থাকে।
১৯৮৬ সালে ১লা ফেব্রুয়ারি জেলা বিচারক কেএম পাণ্ডে, ইউ সি পাণ্ডের আবেদনে হিন্দুদের জন্য পুজা করার অনুমতি দেওয়া হয় বাবরি মসজিদের সন্নিকটে। সঙ্গে ঐদিন ‘বাবরি মসজিদ’ হিন্দুদের আয়েত্তে চলে যায়।
১৯৮৯ সাল ৯ নভেম্বরে তৎকালীন কংগ্রেস প্রধান মন্ত্রী রাজিব গান্ধী ‘রাম মন্দির’ স্থাপনের জন্য অনুমতি দেয়। ঠিক কয়েক দিন পরে ১১ নভেম্বরে ভারতীয় জনতা পার্টি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সম্মিলিত ভাবে ‘রাম মন্দিরের’ শিলান্যাস করে।
এর পরেই মুসলিমদের উপরে নানান ধরণে আক্রমণ হতে থাকে।
১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টির সর্ব ভারতীয় সভাপতি এল,কে আদবানির নেতৃতে এক রথ যাত্রা করে।
রথ যাত্রাটি ছিল গুজরাটের সোমনাথ থেকে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা পর্যন্ত।
‘রাম মন্দিরকে’ কেন্দ্র করে ১৯৯১ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভ করে বিজেপি।
ঐ সালে ৭ই অক্টোবরে ‘বাবরি মসজিদের’ ২.৭৭ একর জমি হিন্দুদের দখলে চলে যায়। তার পরেই বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে রাম মন্দির তৈরির কাজ শুরু করে দেয়।
১৯৯২ সালে ২৩শে জুলাইয়ে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও এর পক্ষ থেকে মসজিদের সংরক্ষণের জন্য একটু তৎপরতা দেখা যায়।
কিন্তু এল কে আদবানি ঐ সালে ২৮শে নভেম্বরের সুপ্রিমকোর্টের রায়কে অমান্য করে মন্দির স্থাপনের জন্য ঘোষণা করেন। এর পরেই ৬ ডিসেম্বরে সরকার, আদালত ও সকল মানুষের সম্মুখে দিবালোকে ‘বাবরি মসজিদকে’ ভেঙে ফেলা হয়। (ক্রমশ...)
লেখক সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দুত্ববাদী ‘করসেবক’ জমায়েত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে ‘বাবরি মসজিদকে’ ধ্বংস করে দেয়। (সমাপ্ত)
(মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct