সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৯ কিস্তি ১
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
পল্লব নিজেই উদ্যোগ নিয়ে এক সপ্তাহ আগে সকলকে নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছিল। একটা পরিপূর্ণ আলোচনা খুব প্রয়োজন। বিভেদরেখায় সকলে দুলছে। অথচ সামনাসামনি কেউ কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। সেটাকেই পল্লব সবচেয়ে বড়ো বিপদ বলে ভাবছিল। মন মুখ আলাদা হওয়া উচিত নয়। এভাবে চলতে থাকলে ক্যানসার রোগের মতো সংস্থার অভ্যন্তরীণ শক্তিকে ক্রমে দুর্বল করে তুলবে। মনের গতিতে চিড় ধরলে তা থেকে বের হয়ে আসা ভয়ানক কঠিন ব্যাপার। পল্লব হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল যে, জিৎ এবং আসিফের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই আছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। জিৎ কিছু বললে আসিফ তার প্রতিবাদ না করে ছাড়ছে না। আসিফের প্রসঙ্গ এলে জিৎ-ও একই মনোভাব গ্রহণ করছে। সে আরও বেশি উগ্র। আসিফকে মেনে নেওয়া আজকাল তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। সমান্তরালভাবে চলতে থাকা এ সংঘাত সোপানকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট, অন্যান্যরা সেই সূত্রে যত বেশি ঢুকে পড়ছে, ততই বিভাজন রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেটাই সবচেয়ে বড়ো বিপদের। সেকথা ভেবে পল্লব বাধ্য হয়ে নোটিশ দিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা করল যাতে এতদিনের মিলিত নাট্যভাবনা বিভেদের জালে আটকে না থাকে।
পরের দিন থেকে পল্লব নিজেই সবচেয়ে বেশি চিন্তিত না হয়ে পারল না। নানান ধরণের কথা ভেসে আসছে কানে। জিৎ এর বিপরীতমনোভাব নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা শুনতে পাচ্ছে সে। শুধু নিজে নয়, জয়া, পারভিনও ভীষণ কম্পিত। পল্লবের চিন্তা অন্য আরেকটা খাতে তরতর করে বয়ে চলেছে। নিজে উদ্যোগ নিয়ে এ নাট্যসংস্থা গড়ে তুলেছিল। এতদিন খুব বেশি এগোতে পেরেছে, এমনও নয়। তবে নাটকের মাধ্যমে সবার মধ্যে দেশপ্রেম নিয়ে কিছুটা সূক্ষ্ম বোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রাপ্তির ঘরে কেবল সেটুকুই পাওনা। এজন্যে মনে মনে বেশ গর্ব অনুভব করত। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সেই গর্বের স্রোতে কেমন যেন ভাটার গতি এনে দিয়েছে। নিজেই এখনও নাট্য সংস্থার মূল মাথা, তাই সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার যন্ত্রণা তাকে সহে নিতে হচ্ছে। বিতর্কিত সভার সন্ধিক্ষণ যত এগিয়ে এল, ততই নানা ভাবনায় কম্পিত না হয়ে পারল না। তাকে কেন্দ্র করে সোপানের সব কর্মকাণ্ড এতদিন আবর্তিত হয়েছে।
সন্ধ্যার শুরুতে সোপানের ঘরে ঢুকে দেখল, তখনও কেউ আসে নি। পাশের চেয়ারে আনমনে বসল। মনের আকাশে গুমোট ভাবনার বিস্তার ক্রমে বড়ো হয়ে উঠছে। চোখ বুজিয়ে সোপানের মিলিত নাট্যভাবনার মধ্যে একটা বড়ো ফাটল দেখতে পেল। শুরুর সময় যা নিয়ে সে এতটুকু স্বপ্নও দেখতে পারে নি, সেটাই কঠোর বাস্তব হয়ে তাকে ভীষণ নাড়া দিতে থাকল। মানসিকতায় ফাটল ধরলে সামগ্রিক পরিস্থিতি যে কত তাড়াতাড়ি নিম্নমুখি হয়ে উঠে যেতে পারে, তা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারল।
দুঃখ একটাই স্বাধীনতার এত বছর পরে দেশপ্রেম নিয়ে সকলে একমত হতে পারল না। দুশ্চিন্তার পলে পলে সাঁতার না জানা ছোটো বালকের মতো ভাসতে লাগল পল্লব। কেউ যে তাকে টেনে তুলতে পারে, তেমন সম্ভাবনাও নেই। মনের মুগুরে হতাশার ক্ষতবিক্ষত ছবি। নতুন নতুন মূল্যায়ন ধরা পড়ছে। তার চিন্তায়। আসন্ন বিভেদের জন্যে যদি সে নিজেই দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যায়। এতেও তার মনে এতটুকু কিন্তু নেই। ভিতরের ঐক্য বাঁচানোর জন্যে তাকেই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। একটা নতুন ভাবনা বার বার নাড়া দিতে থাকল। জিৎ-এর উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলে কেমন হয়? একটু না সূচক হলেও দায়িত্ব পেলে সে পুরোপুরি সদর্থক হয়ে উঠতে পারে।
ভাবতে ভাবতে এক ঝলক স্বস্তি অনুভব করল পল্লব। এ নিয়ে আসিফকে ঠিকমতোবোঝাতে পারলে হয়তো সে জিৎকে মেনে নিতে পারে। ছেলেটার মধ্যে দেশপ্রেম নিয়ে, নাট্যভাবনা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও কখনো তার বিরুদ্ধে যায় নি, বরং নাটক করতে করতে, দেশপ্রেম শিখতে শিখতে এক ধরণের কৃতজ্ঞতা জন্মেছে তার মধ্যে। সেই ভাবনার উপর যথেষ্ট ভরসা করতে পারে সে। বললে আসিফের পক্ষে না বলা সম্ভব হবে না। ব্যক্তির মনে দেশ নিয়ে খাঁটি ভালোবাসা তীব্র হয়ে উঠলে তা দেশপ্রেম হয়ে ওঠে। তখন সে দেশের প্রতি ধূলিকণাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে পারে। আসিফ সেই পথে দৌড়ে চলেছে। কোথাও বাধা পেলে সবার আগে তার কাছে ছুটে আসে। নতুন করে ভাবতে চায়, আরও জানতে চায়, নতুন করে পথ চলা শুরু করে।নিত্যকার জীবনে যথেষ্ট আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও তা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। ভজুর মতোলোক সঠিক পথ লাভ করতে পারলেন না, কিন্তু আসিফ পেরেছে নির্দিষ্ট নিশানা ধরে সামনে ছুটতে। সে পেরেছে জিৎ-এর সব না সূচক মনোভাবে বাধা দিত। সোপানের ঐক্য ধরে রাখার প্রয়োজনে আসিফকে শুধু শুধু আবেগে ভাসতে দেওয়া চলবে না। প্রয়োজন হলে তার উপর কিছুটা জোর খাটানো যেতে পারে।
রিয়ার্স রুমে আসিফ ঢুকে দেখল, মেঘলা মুখে ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসে আছে পল্লব। পাথরের মতো মুখের অবয়বে ভরা কাঠিন্যের ছাপ। বুঝতে অসুবিধা হল না যে কেন পল্লবদা এত বেশি চিন্তিত। মনের অনুসঙ্গে তার সাথে পল্লবের একটা মিল রয়েছে। সেটাইছবি হয়ে ভেসে উঠল আসিফের মনের ইজেলে। প্রশ্ন করল, এত ভাবছ কী পল্লবদা?
ভাবনা তো একটাই।
এভাবে বিগড়ে যাচ্ছ কেন? দেখবে একটা সহজ সমাধান বের হয়ে আসবে।
তুইও এভাবে ভাবছিস?
না ভেবে উপায় নেই পল্লবদা। এতদিন ধরে সকলে একসাথে রয়েছি।
আমি কিন্তু অন্য ছবি দেখতে পাচ্ছি রে। একটা অশনি সংকেত দুচোখের সামনে ভেসে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত সোপানের বিরুদ্ধে সব কিছু চলে যাবে নাতো?
আগে কোনোদিন তোমাকে এভাবে নাসূচক পথে ভাবতে দেখি নি পল্লবদা। নতুন পরিস্থিতি যেভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
একটু হাসল আসিফ, বেশ হাল্কা করে। পল্লব দাশের মতো উঁচু পাহাড় তাৎক্ষণিক চাপে কেমন যেন মাটির ভিতরে ঢুকে যেতে বসেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার।
দীপ ঘরে ঢুকল আরেকটু পরে। আসিফ তখনও পল্লবের পাশে দাঁড়িয়ে। টিপ্পনি কাটল শ্লেষ স্বরে, একি পল্লবদা, আমাদের বিপ্লবীকে এখনও বসতে দাও নি?
আসিফের মুখে স্মিত হাসি। – তোর চিমটি কাটার স্বভাব এখনওগেল না রে।
এতে চিমটি কাটার কী দেখলি? আমি শুধু পল্লবদার ভুলটুকু সংশোধন করে দিলাম। তা তোর গায়ে লাগল কেন শুনি? পল্লবদার হয়ে আমি নিজেই তোকে অনুরোধ করছি, হে মহান বিপ্লবী, দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।
এভাবেই খুনসুটির পালা শেষ হল। এল সুমন, দেবু, জিৎ, জয়া, রফিক, পারভিন ও আরও অনেকে। পর পর।জিৎ এর সাথে নতুন একজনকে দেখে পল্লব কিছু সময়ের জন্যে থমকে থাকল। আজকের আলোচনা কেবলমাত্র সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।জিৎও তা জানত। তাহলে সে কী করে ওই ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে সোপানের ঘরে ঢুকতে পারল? পল্লবের ভিতরে দ্বিধা বাড়তে বাড়তে ঘন কুয়াশা হয়ে উঠল কিন্তু বাইরে বিন্দুবৎ প্রকাশ করল না। বরং চা বিস্কুট এলে খেতে খেতে সকলের সাথে ঠাট্টায় মজে থাকল। অকারণ সন্দেহ করে সংগঠনের ঐক্য ভাঙতে চায় না সে। চা খাওয়া শেষ হলেও থম্ মেরে বসে থাকল। কথা শুরু করল জিৎ নিজেই, পল্লবদার কথা শুনে মনে হয়েছে, লাইফ চয়েসের এ্যাড নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই। তবে এটা শুধু আমি জানলে হবে না, সকলের সামনে আজ পল্লবদাকে সরাসরি বলে দিতে হবে। দেখেছি, সোপানের শেষ শো-গুলোর জন্যে পল্লবদা কীভাবে গাঁটি খসিয়ে দিয়েছে। এভাবে খুব বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। এ্যাড নিলে এ ভার সংগঠনের মাথা থেকে অনেকখানি নেমে যাবে।
আসিফ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, দেখছি, জিৎ বেশ গায়ে ফেলে কথা বলতে শিখেছে। কবে যে এভাবে বাঁকা পথে বকবকম করতে শিখল, কী জানি।
দেবুর মন্তব্য, তুই এভাবে টিপ্পনি কাটতে পারিস না।
সুমন বলল, মেকি বিপ্লবী তো, অন্যকে আঘাত না করে কথা বলতে পারে না।
দীপের মন্তব্য, পল্লবদার কাছে জানতে চাচ্ছি, আসিফ এভাবে ঘ্যাংরামি করে কথা বলার সাহস পাচ্ছে কী করে?
জয়া গলার স্বর উপরে তুলে বলল, আসিফের কথাগুলো টিপ্পনির পর্যায়ে পড়ে কি জানি না, তবে তোমাদের কথাগুলো যে সোপানের ঐক্য ভাঙার পক্ষে যথেষ্ট, তা বেশ বুঝতে পারছি। আরেকটা প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিই, আসিফের কথাগুলো টিপ্পনি হলে তোমাদের কথাগুলো অবশ্যই হুমকির পর্যায়ে পড়ে।
জিৎ রাগত মুখে জয়ার দিকে তাকাল। ভিতরে ভিতরে সে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
আসিফও কথার ফোড়ন দিতে কোনো ভুল করল না। বলল, এভাবে কথা বলতে নেই জয়া। এতে আর যাই থাক, জিৎকে ঠিকমতো সমর্থন করা হল না। সোপানে থাকতে হলে জিৎ আর পিংপং বসুকে সমর্থন না করাটাই একটা মস্ত বড়ো অপরাধ। দেখছি, জয়ার মাথায় সেই বুদ্ধিটুকুও নেই।
দেবু উঠে দাঁড়াল প্রতিবাদ করতে। শোন্ আসিফ, বন্দুত্ব আছে বলেই তুই এভাবে আঘাত করে কথা বলতে পারিস না।
জিৎ-এর মন্তব্য, ওর সাথে কথা বলে বিতর্ক বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই রে। আমরা এসেছি পল্লবদার সাথে মন খুলে কথা বলতে। কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না যে নাটকের দল ভালোভাবে চালাতে গেলে উপযুক্ত আর্থিক যোগান ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা যারা নাটকের সাথে যুক্ত, সকলের জীবনে অর্থের প্রয়োজনও রয়েছে। এটা কেউ জোর করে অস্বীকার করতে চাইলে তা কঠোর বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়। তাছাড়া মানুষের জীবনে অসুখ বিসুখ আছে, একটু আমোদ প্রমোদের প্রয়োজন রয়েছে, মেলা পার্বণ রয়েছে, বন্ধুদের সাথে মেলামেশাও করতে হয়। আরও টুকিটাকি রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই হাতখরচ লাগে। তা যোগাতে পারলেই তবে সমাজের মূল স্রোতে টিকে থাকা সম্ভব। নতুবা বেমানান হয়ে যেতে হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct