দিলীপ মজুমদার: এখনও অব্যাহত আছে করোনা সংক্রমণ। মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে সংক্রমণের ব্যাপকতা আছে। তবে করোনার ধার ও ভার কমে গেছে। তাই সে সংক্রমণের বিবরণ আর দেব না। তার পরিবর্তে করোনাকে নিয়ে এক বিচিত্র কথোপকথন শোনাব। ভগবান ও শয়তানের কথোপকথন।
ভগবানের হাতে বিশেষ কাজ ছিল না। পর্বতের সানুদেশে বসে তিনি আকাশে মেঘের খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ এক অট্টহাসিতে চমকে উঠলেন। কে হাসে এমন করে! তিনি পেছন ফিরে দেখলেন এক বিকট মূর্তিকে। কোডেক্স গিগাস বা ডেভিলস বাইবেলে যে রকম বিকট মূর্তির ছবি আছে, অনেকটা সে রকম। ভালো করে দেখে চিনতে পারলেন তাকে। তাকে ভগবান বললেন, কি হে, কেমন আছ ?
সে একটু ক্ষুণ্ণ হল। বলল, আমিও তো একটা সত্তা। আমারও একটা নাম আছে। আমার নাম ধরে ডাকলে না কেন?
ভগবান মৃদু হেসে বললেন, তোমার তো অনেক নাম -শয়তান, ডেভিল, লুসিফার, দিয়ারল, বেলজেবাব, মেফিস্টোফিলিস- কোন নামে ডাকলে তুমি খুশি হবে ? আমার অবশ্য শয়তান নামটা বেশ পছন্দের। তা শয়তান, এই অসময়ে আমার কাছে কেন ?
শয়তান বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে একটু বিষণ্ণ দেখব। কিন্তু তা তো দেখছি না। ব্যাপারটা কি ?
অবাক হলেন ভগবান। খোলসা করে শয়তান বলল, তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছি বলে তুমি উদ্বিগ্ন হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো নিরুদ্বিগ্ন আছ।
ভগবান বললেন, তুমি কি করোনাসুরের কথা বলছ ?
আবার অট্টহাসি হেসে শয়তান বলে, ঠিক ধরেছ। করোনা মানে কোভিড-১৯এর কথাই বলছি। চোখে দেখা যায় না যে ভাইরাস, তাকে দিয়েও আমি পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছি। আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছি। জীবনের মতো মৃত্যুরও একটা অসামাজিক রূপ তৈরি হয়েছে। মেধাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা তার কুল খুঁজে পাচ্ছে না। AC-BC-র মানেটাই বদলে দিয়েছি একেবারে। কি ভাবে করোনাকে আটকানো যাবে, আদৌ আটকানো যাবে কি না, তার ভেকবদলের রহস্যটা কি, এ সব ভেবে ভেবে মানুষের পাগল হবার উপক্রম। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে !
ভগবান বললেন, তোমার আনন্দে তো ভাটা পড়ার কথা। প্রতিষেধক বেরিয়ে গেছে। করোনা মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
শয়তান একরোখাভাবে বলে, টিকার ক্ষমতা কত তা বোঝা হয়ে গেছে। টিকা নেবার পরেও করোনা হচ্ছে। তা ছাড়া তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ ওমিক্রন স্ট্রেনের কথা। ডেল্টা স্ট্রেনের বড়দা সে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই স্ট্রেন মারাত্মক। তাই সৌদি আরব থেকে নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, সিঙ্গাপুর এবং অন্যান্য দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই স্ট্রেন এবার ইউরোপে ঢুকতে শুরু করেছে। সেখানে এবার তার খেলা হবে। এর মধ্যেই কমপক্ষে ৫০টি মিউটেশন ঘটেছে তার, যার মধ্যে ৩০টির বেশি মিউটেশন ঘটেছে ভাইৃরাসের স্পাইক প্রোটিনে। বুঝলে !
শয়তানের কথা শুনে ভগবান এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন।
শয়তান রেগে গিয়ে বলল, তুমি হাসছ ?
ভগবান তখন এক মানুষ-কবির কবিতা আবৃত্তি করলেন : রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি / মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসে অন্তর্যামী।
কবিতা শুনে রেগে গেল শয়তান। বলল, এত মাথামোটা আমি নই যে তোমার কবিতার মানে আমি বুঝব না। তুমি বলতে চাইছ আমার কোন কৃতিত্ব নেই !
ভগবান শান্তভাবে বললেন, দেখো শয়তান, মানুষ সৃষ্টির অনেক আগে আমি ভাইরাস সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছি পৃথিবীতে। সে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর আগের কথা। আজও পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে আছে ১০০০ এরও বেশি ভাইরাস। তারা হল লিভিং ডেড। অনেকটা ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার মতো। সুতরাং যে ভাইরাসের জন্য পৃথিবীর আজ বিপর্যয়, তা তোমার সৃষ্টি নয়। এরপরে তুমি হয়তো বলবে যে তুমি ভাইরাসকে কাজে লাগিয়েছ মানুষকে দিয়ে। কিন্তু কোন দেশের মানুষ ? এর উত্তরে বেপরোয়া হয়ে তুমি বলতে পারো যে জীবাণু যুদ্ধের প্ররোচনা দেবার জন্য তুমি উহানের বিজ্ঞানীদের লেলিয়ে দিয়েছ গোপনে। কিন্তু সে ব্যাপারেও সন্দেহের মীমাংসা হয়নি। একে ‘চিনা ভাইরাস’, ‘উহান ভাইরাস’ বলে এক সময়ে আমেরিকার প্রেসেডেন্ট এক সময়ে খুব লাফিয়েছিল, অনেক বিজ্ঞানীর মতো আ্যান্টনি ফাউচিও এই ভাইরাসকে প্রাকৃতিক নয় বলে সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের উৎস সন্ধানে আমেরিকা যে তদন্ত শুরু করেছিল তার রিপোর্ট দেখেছ ? সেখানে বলা হয়েছে ভাইরাসটি জৈব অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয় নি, এর মধ্যে জিনগত কারসাজিও নেই, বুঝলে
ততক্ষণে ঘাবড়ে ঘোড়া হয়ে গেছে শয়তান। তার মুখে আর রা নেই।
ভগবান আবার বললেন, যদি ধরেই নিই যে ব্যাপারটা জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারর্ড, তাহলেও তোমার কোন কৃতিত্ব নেই।
মৃদুভাবে শয়তান বলে, কেন ? কেন ? মানুষের মনে অশুভ বুদ্ধি চালান করাই আমার কাজ। তাহলে আমার কোন কৃতিত্ব নেই এ কথা বলছ কেন ?
ভগবান বললেন,দেখো শয়তান, মানুষ তৈরি করে আমি তাকে দুটো ক্যাপসুল গিলিয়ে দিয়েছিলাম। একটা হল সুমতি ক্যাপসুল, আর একটা হল কুমতি ক্যাপসুল। কুমতি ক্যাপসুল হল আসলে রিপু ক্যাপসুল। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ছয় রিপু। আসলে আমি ডুয়েল পার্সোনালিটি তৈরি করে দিয়েছিলাম। মানে, মানুষের মধ্যে তোমাকে মানে শয়তানকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তাই মানুষ যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি ধ্ংসও করে। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু তা তা থই থই।
শয়তান হাঁ করে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ পরে বলল, তাহলে আমি কোথায় ?
ভগবান হাসলেন। বললেন, তুমিও তো আমার সৃষ্টি। তুমি হলে কুমতি ক্যাপসুল। মানুষকে আমি যেমন ধ্ংস করার শক্তি দিয়েছি, তেমনি দিয়েছি সৃষ্টি করার শক্তি। মানুষ দামামা বাজায় যুদ্ধের, গুলি চালায়, বোমা ফেলে ; আবার এই মানুষ মুখর হয় শান্তির আন্দোলনে। লোভের বশবর্তী হয়ে নির্বিচারে ধ্ংস করে পরিবেশ ; আবার সে সামিল হয় পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে। তুমি ভেবেছিলেন করোনাসুরকে দিয়ে ভয় দেখাবে মানুষকে। ভয় মানুষ পেয়েছিল, কিন্তু সেটা সাময়িক। করোনাকালেও রিপুর লীলা অব্যাহত ছিল, তখনকার খবরের কাগজের পাতা উল্টালে তার পরিচয় পাবে। খুন রাহাজানি ধর্ষণ সবই চলেছে, চলেছে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের লড়াই। তাহলে বুঝলে, করোনা মানুষকে দমাতে পারে নি। এর আগেও কত মহামারি, অতিমারি এসেছে, কত ঝড়, কত সাইক্লোন, কত ভূমিকম্প। দমেছে মানুষ ? রিপু তার অসীম পরিপাক শক্তি দিয়ে সব হজম করে ফেলেছে। কুমতি ক্যাপসুলের প্রতিক্রিয়া। করোনার ঢেউ আর একটু স্তিমিত হলে দেখবে আবার যানবাহনের বিচিত্র ও উৎকট শব্দে মুখরিত হবে আকাশ-বাতাস, গাছ কাটাআর বন উজাড় করার কাজ চলবে, রাসায়নিক বর্জ্য অকাতরে ঢালবে নদী-সমুদ্রে, সংগোপনে চলবে রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের নির্মাণ, খাদ্যে মেশাবে ভেজাল, সংকীর্ণ স্বার্থবোধের প্রেরণায় গণহত্যার গেন্ডুয়া খেলায় মত্ত হবে। আবার এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবে কিছু সুমতিসম্পন্ন মানুষ। পৃথিবীতে তারা মহাজন নামে খ্যাত হবে।
এসব শোনার পরে শয়তান হতভম্ব হয়ে বলে, মানুষের মধ্যে তুমি সুমতি আর কুমতিকে মেশালে কেন ? কেন তারা আমার মতো শুধু কুমতিসম্পন্ন হল না ?
ভগবান হাসলেন। বললেন, তুমি একটি আস্ত গাধা। তোমার মগজে একফোঁটা বুদ্ধি নেই। আরে, মানুষকে শুধু কুমতিসম্পন্ন করলে আমার মহিমা যে ক্ষুণ্ণ হত। তাহলে কি জোর গলায় বলতে পারতাম মানুষ আমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ! আবার দেখো, মানুষকে শুধু সুমতিসম্পন্ন করলে আমার আসন টলমল করত। কারণ, মানুষই তখন দেবতা হয়ে উঠত। আর তা হলে আমি ক্ষমতা হারাতাম। ক্ষমতাই তো আসল শক্তি।
শয়তান বলল, বাবাঃ, মানুষের মতো তোমার রাজনৈতিক বুদ্ধিটা প্রখর।
--রাজনৈতিক বুদ্ধি ! ভগবান বললেন, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-টুরাণ পড়লে দেখবে দেবতাদের মতো শতরঞ্জের খিলাড়ি হতে এখনও মানুষের ঢের দেরি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct