সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৪ কিস্তি ১
মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।
ত্যাগ আর ভোগের দুপ্রান্তে দুজন দাঁড়িয়ে। একদিকে পল্লব, অন্যদিকে জিৎ। নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে দুজনের মধ্যে। পল্লব বুঝতে শিখেছে, ত্যাগে পরমার্থ রয়েছে। জিৎ তাতে এতটুকু বিশ্বাস করে না। জিৎ-এর ভাবনায়, ভোগই জীবন। যা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়, তার বাইরে অন্য কিছু নেই। পল্লবের মূল ভাবনা জিৎকে অনেক আগে ছাপিয়ে গেছে। জেনে ফেলেছে সে, ভোগ কখনও জীবনকে মৃত্যুহীন করে তুলতে পারে না। পল্লব ত্যাগের রাজা, জিৎ ভোগের। পল্লব পলে পলে নিজের জীবনকে ত্যাগের মন্ত্রে আরও বেশি করে রাঙিয়ে তুলতে চায়। জিৎ সেই ভাবনাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে একেবারে বদ্ধপরিকর। অর্থ উপার্জনের পথে সে নিজের জীবনকে সার্থক করে তুলতে চাচ্ছে। সেই যাত্রাপথে জিৎ কোনো সমঝোতায় যেতে চায় না। মানুষকে জাগানোর জন্যে নাটকের আন্দোলনে তার এতটুকু বিশ্বাস নেই। বরং নাটক করে যদি অর্থলাভ করা যায়, সেই পথে জিৎ অনেক দূর যেতে রাজি। উপযুক্ত পাওনা পেলে শুধু নাটক নয়, যে কোনো পথে ঢুকতে জিৎ-এর মনোভাবে কোনো না নেই। পল্লব নাটকের উপাসক হতে চায়, জিৎ নাট্য ব্যবসায়ী।
জিৎ-এর মূল সমস্যা, সে জানতে পারে নি যে নাটকের ক্ষেত্রে ব্যবসা ও উপাসনাকে একবিন্দুতে মেশানো যায় না। ব্যবসার উপর জোর দিলে মননে ফাঁকি ধরা পড়ে, আবার উপাসনাকে প্রধানতম অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলে হয়তো নাট্যভাবনার গভীরতা বাড়ে কিন্তু ব্যবসার সাফল্য একান্ত অবহেলায় পথে পড়ে মরে যেতে পারে। নাটক বিশেষ শিল্প বলেই শেষ পর্যন্ত উপাসনাকেই জয়ী করে। এতে যে জীবন সংগ্রামের সাফল্য রয়েছে, তা পল্লব মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পারে কিন্তু জিৎ এর পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এই সত্যটুকু বোঝে বলেই পল্লব নিজের জীবনকে সঠিক বলে ভাবতে শিখেছে।
রবিবার সন্ধে না হতেই জিৎ নাট্যসংস্থার ঘরে ঢুকে দেখল, কেউ নেই সেখানে। খুব আশা করে এসেছিল, নিরিবিলি সোপান এর আর্থিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে একটু শলাপরামর্শ করবে কিন্তু তা সম্ভব হল না বলেই খড়ের ছাউনির দিকে দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল। কী ভেবে দু’ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসি ফোটাল, আবার গম্ভীর হল। পল্লবের না আসা নিয়ে মনে মনে অনেকখানি নিশ্চিত হল। এলে এতক্ষণ এসে যেত। নিশ্চয় অন্য কোনো কাজে আটকে পড়েছে। নাহলে এমন হতে পারে না। নাট্যসংস্থার শুরু থেকে সেদিন পর্যন্ত কোনো রবিবার পল্লব এত দেরি করে সোপানের ঘরে ঢোকে নি। চা দোকানের দিকে শ্লথ পায়ে হাঁটতে শুরু করল জিৎ। গিয়ে দেখল, দোকানদার আঁচ ধরাতে ব্যস্ত। জিৎ-এর প্রশ্ন, চা হবে এখন?
আঁচের আগুন আরেকটু গনগনে হলেই দেব।
কত সময় লাগবে?
অন্তত মিনিট পাঁচেক।
জিৎ একবার ভাবল, সোপানের ঘরে ফিরে যাই। আবার ভাবল, যেতে যে সময় লাগবে, ততক্ষণে চা তৈরি হয়ে যাবে। অগত্যা বেঞ্চে বসে থাকল গরম চায়ের প্রতীক্ষায়। নির্ধারিত পাঁচ মিনিট পার হল। তখনও আঁচের আগুন গনগনে হয়ে ওঠে নি। জিৎ আর তাড়া দিল না। দেখল, দোকানদারের মুখে জড়তার ছবি। আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি গরম চায়ের কাপ তার হাতে তুলে দিতে। আরেকটু সময় গেল। দোকানদার বলল, এই হয়ে গেছে জিৎদা।
জিৎ একটু হাসল। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এভাবে বলছ কেন? আঁচের আগুন নিজের মতো বাড়ে কমে। তুমি তো আপ্রাণ চেষ্টা করেছ।
না, মানে বসে বসে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হল।
এত সুন্দর চা করে দিলে, তা নিয়ে তো একটাও কথা বললে না।
দোকানদার একটু হাসল। এই করেই আমাকে চলতে হয় জিৎদা। প্রশংসা পেলে একটু বেশি উৎসাহিত হই, এই যা।
জিৎ হাসল। দুজনের মন এক বিন্দুতে মিলিত হল। দেরি করে গরম চা দেওয়ার জন্যে দোকানদারের মনের আকাশে যে মেঘ জমেছিল, তা কেটে গেল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিৎ আরেকটা কঠিন ভাবনায় ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠল। তখনও সে সোপানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সোপান কী পারবে তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে? নাকি তাকে অন্য পথ বেছে নিতে হবে? সমালোচনার সূক্ষ্ম সূত্রগুলো ক্রমে তার মধ্যে আরও ধারালো হয়ে উঠছে। সমাজ জীবনে সে একক ব্যক্তি। সমাজ থাকল কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হল না, তাহলে একক জীবনে সে কী দাম পেল? পল্লব দাশ সমাজের উন্নয়নে নাটকের নামে সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারে। এটা তার কাছে নিছক পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তার পক্ষে ঐ পাগলামি করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
চা খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে দিল জিৎ। হাঁটতে শুরু করল। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটে চলল হন হন পায়ে। তাকে জিততেই হবে। যে কোনো মূল্যে। মিনিট কুড়ি পরে সে তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, বাইরের শোভা দেখে অবাক না হয়ে পারল না। এমন দৃশ্যবহুল বাড়ি সে খুব কম দেখেছে। এখানে থাকেন মিস্টার পিংপং বসু। কলিং বেলে আঙুলের আলতো চাপ পড়তেই ক্রিং ক্রিং শব্দের অনুপ্রাস ভেসে এল কানে। জিৎ তখনও ভুলে যেতে পারে নি পল্লব দাশকে।
একটু পরে পিংপং বসু উপর থেকে তরতর করে নীচে নেমে এলেন। সদর গেট খুলে দিলেন হাসি মুখে। প্রথম প্রশ্ন, আপনি কী জিৎ?
জিৎ এর ভিতরের কৌতুহল বেড়ে হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেল। অনেকদিন ভেবেছে, পিংপং বসুর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। সেই লোকটা তার দুচোখের সামনে দাঁড়িয়ে। একটু হেসে বলল, কী করে চিনলেন?
চেনার আগে অনেক কিছু জানতে হয়। সেই পথ ইতিমধ্যে সেরে ফেলেছি। আপনি তো সোপান নাট্যসংস্থার একজন কুশলী শিল্পী। আর্থিক মানদণ্ডে সোপানকে উপরে টেনে তুলতে চান। সেই প্রশ্নে পরিচালক পল্লব দাশের সাথে আপনার ঠিক মিল হচ্ছে না। ঠিক বললাম তো?
জিৎ অবাক। ভেবে পেল না, প্রথম সাক্ষাতের আগে মিস্টার পিংপং বসু এত কিছু জানলেন কী করে! তাহলে কী খুব নাট্যপ্রেমী মানুষ? নাকি স্রেফ ব্যবসার প্রয়োজনে এ সব তাকে জানতে হয়েছে। একটু হেসে বলল, এত কিছু জানলেন কী করে?
নাট্য আন্দোলনকে সফল করে তুলতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় আপনাদের। তুলনায় আমার জানাটা অতিশয় তুচ্ছ। পল্লববাবু তো নাটক করেন সমাজের ভাবনাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে। এটুকু আমি কী জানতে পারি না? নাটকের মাধ্যমে দেশে দেশে সমাজ পাল্টানোর যে ইতিহাস রয়েছে, তা সকলকে মনে রাখতে হবে। পল্লববাবু যে আপনাদের নাট্যসংস্থার পরিচালক, তাও জেনে ফেলেছি। শুনেছি, ভারি সুন্দর নির্দেশনা দিতে পারেন। জীবন এবং সমাজকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছে থাকলেই এভাবে ভালো নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব।
জিৎ-এর চোখে বিস্ময়ের ঘোর। এত সব খবর রাখেন লোকটা? মানে পিংপং বসু শুধু নিজের কেরিয়ার নিয়ে পড়ে থাকেন না, জীবনের শিল্পকলা নিয়ে নানা কৌতুহল জাগিয়ে রাখেন নিজের মধ্যে। জিৎ কেমন যেন বেশি ভাবিত হল। পিংপং বসুকে নিয়ে তার চিন্তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। যা মিষ্টার বসুর নজর এড়িয়ে গেল না। একটু হাসলেন। বললেন, এ নিয়ে এত অবাক হচ্ছেন কেন? আপনাদের ‘সোপান’ নিয়ে আরও কিছু তথ্য জেনে ফেলেছি। বড়ো বিজ্ঞাপন নেই, তাই সোপান-এর চলার ক্ষেত্রে সাবলীল জয়যাত্রা নেই। ভিতরে আর্থিক কষ্ট থাকলে একটা নাট্যসংস্থার কার্যবিধি এগিয়ে নিয়ে চলা ভয়ানক সমস্যার। আমি মনে করি, এজন্যে আমাকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রমাণ করা যাবে না, আমার সংস্থা শিল্পকলা নিয়েও ভাবতে শিখেছে।
জিৎ-এর মধ্যে নতুন প্রত্যাশা জেগে উঠল, মনের গভীরে নতুন আশা। তাহলে পিংপং বসু বাংলা নাটকের উন্নতি নিয়ে নিজের মতো করে এত বেশি ভেবেছেন? সোপান নিয়ে তার চিন্তা এত গভীর? ‘বিশেষ উদ্যোগ’ মানে তো ‘স্পনসরার’ হতে চাচ্ছেন। কোম্পানি একটা নাট্যসংস্থাকে সচল রাখার জন্যে যে এভাবে ভাবতে পারে, তা আগে জিৎ-এর জানা ছিল না। তাতেই তার ভিতরের বিস্ময় বাড়ছে জোয়ারের স্রোতের মতো।
পিংপং বসু আবার বলতে শুরু করলেন, মাত্র কদিন আগে আমাদের কোম্পানি ইণ্ডিয়াতে লঞ্চ করেছে। আরও কয়েকদিন গেলে অনেক কিছু জানতে পারব। একটা বিষয়ে আপনার সাথে নিরিবিলি আলোচনা সেরে নিতে চাই। বিজ্ঞাপন দিয়ে সোপান-কে সাহায্য করাই যেতে পারে। কীভাবে সেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে, সেটাই খুলে বলুন। ভিতরে কোনো কিন্তু রেখে কথা বলবেন না। আই এ্যাম দি বেষ্ট ফ্রেন্ড অফ সোপান।
আসার পথে জিৎ অনেকবার ভেবেছিল, পিংপং-কে বসুদা বলে ডাকবেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা বলে দিল, পিংপং এর অবস্থান এত উপরে যে তাকে দাদা সম্বোধন করা চলে না। মনে মনে সংকোচে ভাসল জিৎ। পিংপং বসু এগিয়ে এসে জিৎ এর সাথে হ্যান্ডসেক সেরে নিলেন। বললেন, নাটকে তোমার রোলটা ভারি আকর্ষণীয়। ফোটাতে পেরেছও বেশ। দেখছি পল্লববাবুর নির্দেশনায় তুমি পোক্ত অভিনেতা হয়ে উঠেছ। সবে তো দৌড় শুরু হয়েছে। লেগে থাকলে আরও অনেকদূর যেতে পারবে। পরিচয় না থাকলেও একজন অচেনা দর্শক হিসেবে তোমার অভিনয় দেখে আমি খুব পুলকিত হয়েছি। পিংপং বসু ‘আপনি’ সম্বোধনকে কখন তুমিতে নামিয়ে এনেছেন, জিৎ তা একবারও ভেবে দেখার সুযোগ পেল না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct