কাশ্মীর মানে ভূস্বর্গ। কাশ্মীর মানে এক উদাস স্বপ্নে ভেসে আনন্দে বিভোর হওয়া। কাশ্মীর মানে সাদা বরফের ঢাকা প্রান্তর, সবুজ ঢাকা অথবা উলঙ্গ উচ্চ পাহাড়। এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যভরা স্বর্গ কিন্তু বাস্তবে কাশ্মীর মানে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্ক। সন্ত্রাসীবাদীদের হামলা-মৃত্যু অথবা সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে মৃত্যু। সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের-অনুপ্রবেশকারীদের হামলা, কত শত মায়ের পুত্র, কত স্ত্রীর স্বামী, কত পুত্রকন্যার পিতার রক্তাক্ত দেহ অথবা সেনাবাহিনীর এ কে ৪৭-এর গুলির শব্দ। কাশ্মীরের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি পাহাড় পর্বত উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমনই আতঙ্ক। সম্প্রতি কাশ্মীর উপত্যকা ঘুরে এসে নিজের সরজমিন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন এস এম শামসুদ্দিন। আজ প্রথম পর্ব।
কাশ্মীর মানে ভূস্বর্গ। কাশ্মীর মানে এক উদাস স্বপ্নে ভেসে আনন্দে বিভোর হওয়া। কাশ্মীর মানে সাদা বরফের ঢাকা প্রান্তর, সবুজ ঢাকা অথবা উলঙ্গ উচ্চ পাহাড়। এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যেভরা স্বর্গ কিন্তু বাস্তবে কাশ্মির মানে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আতঙ্ক। সন্ত্রাসবাদীদের হামলা- মৃত্যু অথবা সীমান্তরক্ষীদের গোলাগুলিতে মৃত্যু। সসস্ত্র পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের -অনুপ্রবেশকারীদের হামলা, কত শত মায়ের পুত্র, কত স্ত্রীর স্বামী, কত পুত্রকন্যার পিতার রক্তাক্ত দেহ থবা সেনাবাহিনীর এ কে ৪৭-এর গুলির শব্দ।
কাশ্মীরের আনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি পাহাড় পর্বত উপত্যকার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমনই আতঙ্ক।
সারাবিশ্বের মানুষের সামনে কাশ্মীর আর কাশ্মীরের সমস্যা এক আন্তর্জাতিক সমস্যা।
সম্প্রতি ভারত সরকার ৩৭০ধারা বিলপ করে কাশ্মীরের মানুষের অধিকার বিলোপ নিয়ে বিতর্ক দেশজুড়ে শুধু নয় বিশ্বজুড়ে।
কাশ্মীর ভ্রমণ যেকোন ও সচেতন মানুষের স্বপ্ন। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অমোঘ আকর্ষণ।
আমাদের মতো ভ্রমণপিপাসুদের কাছে যেটা স্বপ্ন সেটা যদি সম্ভবের সুযোগ আসে কে হাত ছাড়া করে।
অমরেশ ধাড়া আমার একান্ত অনুরাগী ভক্ত। পেশায় শিক্ষক নেশায় ভ্রমণ পিপাসু পাগল। নিজে শুধু নয় সময় সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়েন অজানাকে জানা অচেনাকে চেনার আনন্দ উপভোগ করতে, অন্য সাথী সঙ্গীদের নিয়ে। নাম মাত্র খরচায় সমস্ত পরিষেবা নিয়ে তিনি হাজির। নানান বাধা সত্ত্বেও সে নাছোড়, মূলত তাঁরই অনুরোধে শতভয় ভীতি ফেলে বের হয়ে পড়েছি কাশ্মীরের পথে। কেমন আছে কাশ্মীরের মানুষ জানার প্রবল আগ্রহে।
পাঞ্জাবের অমৃতসর স্বর্ণমন্দির, ভারত পাকিস্তান ওয়াঘা বর্ডার, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড স্থল ঘুরে আমরা রাত্রি ১১.৪০ মিনিটে অমৃতসর স্টেশন থেকে দুর্গীয়ানা এক্সপ্রেসে উঠলাম জম্মুর উদ্দেশ্যে। আগেই আমাদের রিজার্ভেশন করা ছিল সুতরাং অসুবিধা হল না। ভোর পাঁচটায় আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছাল জম্মুতে। বেশ শীত শীত ফলে যে যাঁর সঙ্গে আনা শীত বস্ত্র পরে লাগেজ নিয়ে বার হয়ে এলাম স্টেশনে। মাঝে মাঝেই বন্দুকধারী সেনাদের নীরব উপস্থিতি। যাত্রীদের
নীরবে এগিয়ে চলার মাঝে কোভিড ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট পরীক্ষা করে আমারা বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। তখনও আলো আঁধারী। ট্রেন যাত্রীদেরই উপস্থিতি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাড়ি। অমরেশবাবু আগেই আমাদের যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাঁর নির্দেশে আমরা যে যাঁর লাগেজ নিয়ে এগিয়ে চলেছি গাড়ির দিকে। চড়াই উতরাই পথ পার হয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখলাম এক স্রোতস্বিনী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ১২-১৪ জন যাওয়ার মতো ছোট ট্রাভেলা গাড়ি। যে যাঁর মালপত্র গুছিয়ে গাড়ি যখন ছাড়ল তখনও
আলো আঁধারী, পূর্বদিকে আকাশ জুড়ে লাল আভার ঘনঘটা। ড্রাইভার সুজন চৌধুরী বেশ মিশুকে হাসমুখী। জম্মু শহর ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি দ্রুতবেগে কাশ্মীরের পথে ডাল লেকের পাশে আমাদের জন্য বুকিং করা হোটেল ভিক্টরিয়ার দিকে।
কিৎনা ওয়াক্ত লাগেগা সুজনভাই।
-পৌঁছনে মে চার পাঁচ বাজ জায়েগা।
তার মানে জম্মু থেকে ৩০০ কিমি ১১-১২ ঘণ্টার পথ। পাহাড়ের বুক ভেদ করে চড়াই উতরাই পথ, ক্রমশ পাহাড়ের ভয়ঙ্কর পথে আমরা চলেছি একদিকে প্রাণ শুকিয়ে যাওয়া গভীর খাদ, অন্যদিকে উঁচু পাহাড়। গাড়ির গতি ঊর্ধ্বমুখী, পাহাড়ের শরীর কেটে রাস্তা চলেছে পাহাড়ের চূড়ার পথে। মাঝে মাঝে কাশ্মীরি যুবক বা বৃদ্ধ পাল পাল ভেড়া ছাগল তাড়িয়ে চলেছে। উঁচু পাহাড়ের বুকে পাইন দেবদারু আর কত কি গাছের সমাহার, সর্বশক্তিমানের কি অপরূপ সৃষ্টি, না দেখলে উপলব্ধি করা সত্যিই কঠিন, যা ভাষায় বর্ণের ঠাস বুননে বর্ণনা অসম্ভবও। দুচোখ ভোরে দেখা অন্তর প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্যে বিভোর আমরা। সারারাতের ক্লান্তিতে যাত্রীরা ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউবা ঘুমে ঢোলে পড়ছে মাঝে মাঝে কেউবা মাথা হেলিয়ে ঘুমে অচেতন। প্রকৃতির এই যে অপরূপ শোভা সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আহা সাধের মায়াবী শরীর। তার ক্ষুধার্ত উদোর সে না ভরালে সবল সচল হয় না তাঁর অঙ্গপ্রতঙ্গ। আমিও মাঝে মাঝে ঢুলছি আবার জাগছি।
সুজন ড্রাইভারের হুঁশিয়ারি ড্রাইভার কা পাশ বইঠনেসে মাত শোনা। নেহি ত মেরা আঁখ লাগ জানে সে মুশকিল হো জায়গা ফির। শুকনো সুপারি মুখে দিয়ে ক্লান্তির ও ঘুমের সঙ্গে লড়াই করছি আর চোখে জ্বালা নিয়ে দেখছি পাহাড়ের চডাই উতরাই ভয়ঙ্কর পথ গভীর খাদ।
জম্মু জেলার সীমান্ত পানিহাল এসে আমরা পৌঁছলাম তখন বেলা নতুন।
রৌদ্রোজ্জ্বল কিন্তু বেশ শীতের গভীরতা বেশি। ঠাণ্ডার প্রকোপ বেড়েছে অনেকটাই। অমরেশদার সহযোগীরাও নেমেছে রাস্তায়। রাস্তার অন্যদিকে পানিহাল রেল স্টেশন। এখন থেকে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর পর্যন্ত আছে ট্রেন পথ। জম্মুর শেষ আর কাশ্মীরের শুরু সীমান্ত এই পানিহাল। রাস্তার দুই পাশে মুসলিম হোটেল। সব মুসলিম নানান দ্রব্যের দোকান। হোটেলের কর্মচারী কাশ্মীরি যুবকরা তাঁদের হোটেলে খাওয়ার আহ্বান করছে।
ওদের একজনকে ডাকলাম কাছে।
আসসালামু আলাইকুম, নাম কেয়া হ্যায়
-জি সালমান।
- ইধার সে পুরাসাব মুসলমান হ্যায়।
ইধার সেনাকা ইয়া পুলিশকা কই জুলুম ইয়া দাবাও চাল রাহা হ্যায় কি নেহি,
নেহি এইসা কোহি বাত নেহি, হাম সাব এম আদমি হ্যাঁয়, হাম আপনা কম করতে হ্যায় আউর ওহ আপনা।
বন্ধুকধারী মিলিটারিদের আনাগোনা বেশ বেড়েছে। ঘন ঘন সাঁজোয়া মিলিটারিদের গাড়ি হুস হাস করে বার হয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। তাদের গম্ভীর আনাগোনা দেখলেই ভয়ে হাড় হিম হয়ে আসে বৈকি।
আমরা ৫২ জন বাস থেকে নেমে হোটেলে খানাপিনা শেষে আমাদের ট্রাভেলার গাড়ি ছাড়ল কাশ্মীরের পথে।
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। জম্মুর মতো পাহাড়ি পথ নয় ক্রমশ সমতলের পথে আমরা এগিয়ে চলেছি। বানিহাল এখন থেকে তাই কাশ্মীরের শ্রীনগর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করে। কম সময়ে পৌঁছানো যায় রাজধানী শ্রীনগর। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এল বিশাল উচ্চ পাহাড়। এই উচ্চ পাহাড়ের পেট অপারেশন করে তৈরি হয়েছে চেনারি নাসরি টানেল। একদিকে চেনারি অন্যদিকে বিশাল উঁচু পাহাড় বেষ্টিত নাসরি গ্রাম। কমসময়ে জম্মু থেকে রাজধানী শ্রীনগরে পৌঁছাতে তাই অতি সম্প্রতি তৈরি হয়েছে টানেল। প্রায় ৯কি মি টানেল। ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি এই টানেল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি টানেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাজ্যপাল এম এম বোরা ও মেহবুবা মুফতি মুখ্যমন্ত্রী এই টানেরের উদ্বোধন করেন। এই টানেল পর হওয়ার পর আরেকটি টানেল এল। এটাও ৮৫০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হয়েছে।
এর পরে দূরে দূরে উঁচু উঁচু পাহাড় বটে কিন্তু গাড়ি চলার পথ আসে পাশে সমতল ভূমি। আসে পাশেই ধান ক্ষেত। ধান কেটে জমির মাঝে খড় জমা করে রাখা। বাংলার খড়ের গাদার মতোই কাশ্মীরের খড়ের গাদা। ক্রমশ শীতের প্রকোপ বাড়ছে। বাসের মাথায় রাখা লাগেজে সঙ্গে আনা শীতের কাপড় আগত্যায় বেশ জড়ো অবস্থা।
দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার ধারে ধারে বিশেষ করে লোকালয় দোকান বাজার জনবসতি এলাকায় বন্দুকধারী সেনাদের উপস্থিতি। এলাকার ব্যস্ত জনসাধারণের মাঝেই বন্দুক উঁচিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ঘুরছে। রাস্তার পাশে সেনাদের সাঁজোয়া গাড়ির উপস্থিতি চোখে পড়ছে। আমাদের গাড়ির চালক যুবক সুজন সিং বেশ সপ্রতিভ।
মোদি জি আনেকা বাদ ইধার কা বিকাশ কায়সা হুয়া।
কেইসা বিকাশ। কুচ নেহি। বেকারি বে রোজগারি বাড় গিয়া। আদমিক কম ধান্দা নেহি। কাশমীর কা কুচ বিকাশ নেহি হুয়া। মেহেঙ্গায়ি বাড় গিয়া।
৩৭০ উঠানে সে ইধারকা কেয়া বিকাশ হুয়া, কেয়া বদলাও হুয়া।
আরে সাব ছোড়িয়ে না, ইয়ে সাব সিয়াসতকা খেল হ্যায়, আউর কুচ নেহি। এম আদমি কা কাশ্মীর আউর জাম্মুকা এম আদমিকা কুচ নেহি হুয়া ইস সে। পেহলে সে আউর ভি হালাল বাদতার হুয়া।
৩৭০ পেহলে থা কেয়া স্পেশাল সুবিধ্যায়ে মিলতা থা, আউর আজ নেহি হ্যায়, আরে ছড়িয়ে না ইয়ে সব সিয়াসত ওয়ালে বাত।
অব জম্মু আউর কাশমীর কা রেহনেওয়ালে জামিনদার তায় কার চুকা হ্যায় আপাস মে ইয়ে লোক বাহার কিসিক জমিন নেহি বেঁচেঙ্গে। আপ বাহারকা আদমি রাহ সাকতে হ্যাঁয় লেকিন জমিন খরিদ নেহি সকতা।
হ্যাঁ মোদি আনে কা বাদ বাডা বাডা রাস্তা বান রাহা হ্যাঁয়।আউর কুচ নেহি।
শ্রীনগর পৌঁছাতে এখনো ১০০ কি মি পথ বাকি। প্রশস্ত রাস্তার মাঝে পথ নির্দেশ মূলক বোর্ডে নির্দেশ দেখে যাচ্ছে জায়গা ও দূরত্বের পরিমাণ। যুদ্ধ কালীন ভিত্তিতে গড়া চলছে নতুন নতুন প্রশস্ত রাস্তা, দেখলেই বোঝা যায় সীমান্ত এলাকা, অপর সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনী বা সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। প্রয়োজন পড়তেই পারে যে কোনও মুহূর্তে সেনাবাহিনীর। প্রয়োজনে দেশের যে কোনো সেনা ছাউনি থেকে আনা যেতে পারে সেনাবাহিনী আর সেই কারণেই এই প্রশস্ত রাস্তার প্রয়োজনীয়তা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct