ফৈয়াজ আহমেদ: ‘উৎসব’ শব্দটি আমাদের সকলেরই প্রিয়। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যেকোনো প্রকার উৎসব হোক, সেসবে অংশগ্রহণ করতে কার না ভালো লাগে! আর বর্তমানে বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদযাপিত উৎসবের সমস্ত তথ্য আমাদের কাছে চলে আসছে। ফলে উৎসব এখন আর ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা জাতীয় সীমার মধ্যেও আবদ্ধ নেই।
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর হাজারো বর্ণিল উৎসব উদযাপিত হয়। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোই আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও কিছু উৎসবে আমরা আকৃষ্ট না হয়ে পারি না। ধরনে, রীতিতে, বিশ্বাসে- সমস্ত কিছুতেই অদ্ভুত এবং বিচিত্র রকমের তেমন ৬টি উৎসব নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
১. নাকি সুমো, জাপান
জাপানের টোকিওতে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে পালিত হয় ‘নাকি সুমো’ নামক এক অদ্ভুত খেলার উৎসব। সুমো শব্দটি দেখেই ভাববেন না এটি দৈত্যাকার সুমো পালোয়ানদের কোনো কুস্তি খেলা। কারণ, নাকি সুমোতে প্রত্যেক সুমো পালোয়ানের কোলে থাকে অনুর্ধ্ব দুই বছরের একটি করে শিশু। খেলার ময়দানে উভয় সুমো তাদের কোলের শিশুটিকে আরামদায়কভাবে ধরে দোল দিতে থাকে আর রেফারি পালাক্রমে উভয় শিশুর দিকে চেয়ে “নাকি নাকি” (কাঁদো কাঁদো) বলে চিৎকার করতে থাকেন। যার কোলের শিশুটি আগে কেঁদে উঠবে, সে-ই হবে এই খেলার বিজয়ী!
২. কুপারস হিল চিজ রোলিং, ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের গ্লুচেস্টারে অবস্থিত ‘কুপারস হিল’ নামক একটি ছোট পাহাড়ে প্রতি বছর মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘চিজ রোলিং’ উৎসব, যা বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে, যত জনপ্রিয়ই হোক না কেন, সাধারণ উৎসবকেন্দ্রিক খেলার তুলনায় কিছুটা বিপদজনক এই উৎসব এর রীতি ও ধরনে অত্যন্ত অদ্ভুত।
কুপারস হিলের ঢালে জমা হন দর্শকগণ, আর মাঝখানে ফাঁকা যায়গায় অনুষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতা। একে গড়াগড়ির প্রতিযোগিতা বললেও ভুল হবে না, যেখানে হাত-পা ভাঙারও সম্ভাবনা থাকে।
প্রথমে, কুপারস হিলের উপর থেকে ঢাল বরাবর একটি ৭ পাউন্ডের গোলাকার পনির গড়িয়ে ছেড়ে দেন কেউ একজন, আর প্রায় তৎক্ষণাৎ প্রতিযোগীরা সেই পনিরের দিকে ছুট দেন।
পনির ধরতে গিয়ে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে আছড়ে, গড়িয়ে, ডিগবাজি খেতে খেতে নিচের দিকে নামতে থাকেন প্রতিযোগীরা। যিনি সবার আগে পনিরটি কব্জা করবেন, বিজয়ী তিনিই। আর ঢালের নিচে অপেক্ষমাণ থাকেন একদল স্থানীয় রাগবি খেলোয়াড়, যারা নিয়ন্ত্রণ হারানো প্রতিযোগীদের ধরে ফেলেন। থাকে চিকিৎসক দলও!
৩. ওয়ার্ম চার্মিং, ইংল্যান্ড
ইংরেজি ‘স্নেক চার্মার’ এর বাংলা প্রতিশব্দ যদি হয় সাপুড়ে, তাহলে ‘ওর্ম চার্মার’ এর প্রতিশব্দ কি ‘কেঁচুড়ে’ হওয়া সম্ভব? প্রতিশব্দটি সঠিক হোক আর না হোক, ইংল্যান্ডের ডেভনের ব্ল্যাকঅটন গ্রামে প্রতিবছর মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় এক বিচিত্র উৎসব, যার নাম ‘ব্ল্যাকঅটনস ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব ওর্ম চার্মিং’। এই উৎসবে ব্যক্তিগতভাবে নয়, দলগতভাবে যোগ দিতে হয়।
প্রতিটি দলকে কোনো আবাদযোগ্য জমিতে এক বর্গ মিটার জমি এবং ১৫ মিনিট সময় দেয়া হয়। এই ১৫ মিনিটে তারা পৃথিবীর তাবৎ কৌশল প্রয়োগ করতে পারবেন, কেবল খুঁড়তে পারবেন না। ১৫ মিনিটে যে দল সবচেয়ে বেশি কেঁচো মাটির উপর নিয়ে আসতে পারবে, তারাই বিজয়ী। তো খনন না করে কীভাবে কেঁচো বের করে আনে তারা? কেউ মধুর সুরে বাঁশি বাজান কেঁচোদের আকৃষ্ট করতে, কেউ বা মাটিতে ড্রাম রেখে প্রচণ্ড শব্দে বাজাতে থাকেন যেন অতিষ্ঠ কেঁচোরা উপরে উঠে আসে! কেউ আবার নির্ধারিত ভূমির এক পাশে আগুনের তাপ প্রয়োগ করেন, যেন অন্য পাশে উঠে আসে কেঁচোরা। আরেকটি পদ্ধতি হলো ধীর লয়ে ঝিরি ঝিরি জল বর্ষণ করা, যেন কেঁচোদের কাছে মনে হয় বৃষ্টি নেমেছে!
৪. কাস্ট্রিলো ডি মুরসিয়া, স্পেন
স্প্যানিশ ভাষায় ‘কাস্ট্রিলো ডি মুরসিয়া’র অর্থ ‘দ্য বেবি জাম্পিং ফেস্টিভ্যাল’। এটি স্প্যানিশদের জন্য একটি আনন্দঘন উৎসব তো বটেই, ধর্মীয় অনুষ্ঠানও। উৎসবের মূল আকর্ষণ ভয়ানক সব মুখোশধারী মানুষজন, যারা শয়তানের প্রতীক। তারা মিছিল করে মূল উৎসবে আসার আগে রাস্তায় মানুষকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে থাকে। তবে উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো শিশুদের ভাগ্য থেকে অশুভ শক্তিকে তাড়ানো। উৎসবের জন্য নির্ধারিত স্থানে রাস্তায় শিশুদের শুইয়ে রাখা হয় ছোট ছোট বিছানায় আর তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যায় মুখোশধারীরা। এর অর্থ হচ্ছে, অশুভ শক্তি শিশুদের না ছুঁয়ে চলে যায়।
৫. লা টমাটিনা, স্পেন
প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষ বুধবার স্পেনের বুনোল শহরে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় এই উৎসব। উৎসবের স্থায়িত্বকাল হয় মাত্র ঘণ্টা দুয়েক। তবে এই ছোট্ট সময়ের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষারত থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজারো মানুষ। এখানে কোনো জয়-পরাজয় নেই, কেবল আনন্দ করাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এজন্য এর নিয়মও বেশ সহজ। নির্ধারিত স্থানে ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি পাকা টসটসে টমেটো আসবে। আপনার কাজ কেবল সেগুলো হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে ফাটিয়ে আপনার বন্ধু কিংবা সঙ্গীদের গায়ে ছুঁড়ে মারা। উৎসব শুরুর কয়েক মিনিটের মাঝেই অংশগ্রহণকারীরা আপাদমস্তক লাল হয়ে যান আর বুনুলের রাস্তায় হয় টমেটো সসের বন্যা! উৎসবটি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে এখানে যোগ দিতে হলে অন্তত ৩/৪ মাস আগেই আবেদন করতে হয়। কারণ, বুনোল শহরটি ছোট হওয়ায় অধিক মানুষের জায়গা সংকুলান সম্ভব হয় না। কর্তৃপক্ষ তাই আবেদনপত্রের ভিত্তিতে দেশি এবং বিদেশি পর্যটকদের উৎসবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে থাকে।
৬. হেয়ার ফ্রিজিং ডে, কানাডা
কানাডার হেয়ার ‘ফ্রিজিং ডে’ শুধু অদ্ভুত আর বিচিত্র এক উৎসবই নয়, কিছুটা কষ্টদায়কও বটে। বিশেষ করে যাদের শীত সহনক্ষমতা কম, তাদের জন্য এই উৎসব একেবারেই অনুপযোগী। তথাপি এই উৎসবের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কানাডার তাকহিনি নামক স্থানে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। কেমন সে উৎসব? হিমাঙ্কের নিচের (-৫° থেকে -১০° সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় পুলের জলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! ভয় পাবার কিছু নেই, বাইরের আবহাওয়া প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হলেও পুলে দেয়া থাকে আরামদায়ক গরম জল। এর মাঝে ডুবে থাকতে বরং আরামই লাগবে। আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, কেবল একবার জলে ডুব দিয়ে চুলগুলো ভালোমতো ভিজিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যান। বাকি কাজটা আবহাওয়াই করে দেবে! ভেজা চুল নিয়ে দাঁড়ানোর কয়েক মুহূর্তেই দেখবেন আপনার চুলের জল জমে বরফে পরিণত হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct