বাচ্চারা কোনো না কোনো সময়ে মিথ্যে কথা বলেই থাকে। তার সবকটা যে খুব সচেতনভাবে তা নয়। প্রথম প্রথম হয়তো খুব হালকা চালে কিছু মিথ্যা কথা বলতে পারে বাচ্চাটি। কিন্তু সেই মিথ্যা বলায় কোন বাধা না পেলে, পরে বাড়তে থাকে মিথ্যার পরিমাণ। আর তখনই বিষয়টা সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ মিথ্যা বলার প্রবণতা থেকে বাচ্চাকে থামানো উচিত। এই বিষয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন নারী বিষয়ক লেখিকা.... নাজমা আহমেদ
ছোটবেলায় শিশুরা বানিয়ে কথা বললে মা-বাবার শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেটা অভ্যাসে পরিণত হলে সমস্যা তৈরি হয়।
আকাশের মা সুমাইয়া। তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে এ ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আকাশ দুষ্টুমির ছলে এমন নানা বিষয়ে মিথ্যা বলে। বুঝতে পারি কিন্তু কীভাবে সত্য বলার অভ্যাস করাব, বুঝতে পারি না।’
শিশুরা কেন মিথ্যা বলে
* শিশুরা বকা বা শাস্তির ভয়ে মিথ্যা বলে। যেমন স্কুলগামী শিশুদের হোমওয়ার্ক করা, খাবার খাওয়া, দুষ্টুমি করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি থাকে।
* আমি কি সত্যটা বলব? সত্যটা শুনে যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? শিশুদের মনে এসব সংকোচবোধ তৈরি হয়। তাই সে মিথ্যা বলে নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখতে চায়।
* স্কুলগামী শিশুরা অনেক সময় সহপাঠীদের মাঝে নিজেকে আলাদাভাবে পরিচয় করাতে চায়। এ জন্য সে বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা গল্প করে। যেমন শিশুরা ভূতের গল্প, অদ্ভুত কোনো বীরত্বের কাহিনি ইত্যাদি বলে থাকে।
* মা-বাবা শিশুদের যথেষ্ট সময় না দিলে তারা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এ জন্য অনেক মিথ্যা বাহানা তৈরি করে। এভাবে মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হয়।
* অনেক সময় শিশুরা মনে করে সত্য বললে অন্য পক্ষ অখুশি হবে বা কষ্ট পাবে। যেমন কোনো বন্ধু একটি নতুন পেনসিল এনে জিজ্ঞাসা করল কেমন হয়েছে? যদি পেনসিলটি পছন্দ না-ও হয় তবুও সে বলে সুন্দর। কারণ অসুন্দর বললে বন্ধুটি কষ্ট পেতে পারে। এভাবে অন্যকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলার প্রবণতা তৈরি হয়।
* অনেক সময় মা-বাবাকে অনুকরণ করে শিশুরা মিথ্যা কথা বলা শেখে। যেমন মা-বাবা সন্তানকে মুখে বলছে মিথ্যা বলো না আবার তার সামনেই অন্য কাউকে মিথ্যা বলছে। যেমন ফোনে মিথ্যা বলা। কথা ও কাজের ভিন্নতা দেখে শিশু সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারে না এবং মিথ্যা বলা শেখে। ‘সোশ্যাল কগনেটিভ থিওরি’ অনুযায়ী এটিকে ‘রোল মডেলিং’ বলে।
এইভাবে ক্রমাগত যদি চলতে থাকে, তাহলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারণে-অকারণে মিথ্যা বলাটা অভ্যেসে পরিণত হবে এবং সেটা তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য খুবই ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে। বাচ্চাদের মিথ্যে বলা থেকে বিরত রাখতে করণীয়-
রোল মডেল হোক সত্যটা
মিথ্যা যে বলে সে খারাপ, আর সত্যি যে বলে সে ভালো। যে ভালো, তাকেই রোলমডেল করা উচিত। এরকম একটা ধারণা ছোটবেলা থেকেই তার মনে সৃষ্টি করে দিন। মিথ্যা যে বলে, তাকে কেউ পছন্দ করেনা, তার সঙ্গে কেউ খেলে না, তাকে কেউ ভালবাসেনা এমন একটা ধারণা বাচ্চার মনে গেঁথে দিন। এমন কোন একজন কাল্পনিক চরিত্রের কথাও তাকে বলতে পারেন, মিথ্যে বলে যার জীবন খুব কষ্টে কাটে।
সত্যি বললে পুরস্কার
বাচ্চা কেন মিথ্যে বলছে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে এবং প্রথমেই সেই জায়গাটা তাকে দিতে হবে, যাতে সে সত্যি বলতে ভয় না পায়। তাকে বুঝিয়ে দিন, ঘটনাটা যত খারাপই হোক না কেন সত্যি বলতে সে যেন কখনো ভয় না পায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পথ, সে যদি প্রথমে মিথ্যে বলে, তারপর সত্যিটা স্বীকার করে, তাহলে তাকে পুরস্কার দিন। সে ক্ষেত্রে সত্যি বলার উৎসাহ বাড়বে।
সাবধান করুন
প্রথমবার মিথ্যে বললে শাস্তি দেয়ার রাস্তায় হাঁটবেন না। বরং তাকে সাবধান করুন। এটাও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিন সেই কথা না মানলে কি কি শাস্তি হিসেবে পেতে পারে। যেমন ধরুন আগামি ছুটিতে তাকে নিয়ে হয়তো কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা আছে। মিথ্যে বললে, সেটা বাতিল হয়ে যেতে পারে এমন শাস্তির আভাস দিয়ে রাখুন।
বিশ্বাস ফিরিয়ে আনুন
মিথ্যা বলার পর সে যদি সত্যিটা স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাকে যতটা পুরস্কার দেবেন বলে জানিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি কিছু দিন। তাতে তার বিশ্বাস বাড়বে। সে সত্যি বলার ভালো দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
যদি দেখেন কোনভাবেই বাচ্চার মিথ্যে বলার অভ্যাস বন্ধ করা যাচ্ছে না, তাহলে মনোবিদের পরামর্শ নিন। কারণ তিনি বলতে পারবেন, কোন থেরাপির মাধ্যমে কিভাবে তার মিথ্যা বলার অভ্যাস বন্ধ করা যায়। তবে বিষয়টি খুব বাড়াবাড়ি জায়গায় গেলেই এই পদক্ষেপটি করতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct