নারীদের প্রতি সম্মানজনক ভরসা না থাকলেও বিজেপি মমতার বিকল্প নেত্রীর সন্ধানে ছিলেন। রূপা গাঙ্গুলী, লকেট চ্যাটার্জীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সার্থকতার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেননি রূপা অথবা লকেট। এখন তো রূপা গাঙ্গুলি অনেকটা দূরে সরে গেছেন, লকেট তো ভবানীপুরে প্রচারেই এলেন না। বিজেপি টক্কর দিতে যে প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে এগিয়ে দিয়েছিল, তিনি তাঁর চলনে-বলনে মমতার মতো ‘অগ্নিকন্যা’ হবার অভিনয় করলেও মমতার বিকল্প হওয়া স্বপ্নই থেকে গেছে। এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। আজ প্রথম কিস্তি।
ভবানীপুর উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হল। বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে ৫৮ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করে, ৮টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে এগিয়ে থেকে তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিজের আগের রেকর্ড ভেঙে জয়ী হলেন। মমতার জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু বিজেপির প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে টিভি চ্যানেলগুলির একটা প্রচার ছিল। প্রিয়াঙ্কা জিতবেন, এ কথা বলা না হলেও প্রকারান্তরে ‘টক্কর’ বা ‘লড়াই’এর কথা বলছিলেন তাঁরা নানাভাবে। বিজেপি নেতৃত্বই এই প্রচারটাকে যে উস্কে দিয়েছিলেন, সেটা অনুমান করা যায়।
না জিতুন বিজেপি প্রার্থী, কিন্তু তিনি যেন টক্কর দিতে পারেন; মমতার একটা বিকল্প হয়ে উঠতে পারেন। এটাই ছিল বিজেপির অভিপ্রেত। সন্দেহ নেই বিজেপি পুরুষতান্ত্রিক ও পুরুষশাসিত দল। তাঁরা মেনে নিতে পারেননি ‘একা এক নারীর’র এইরকম শক্তি ও প্রভাবকে। ২০২১ সালের নির্বাচনের ধাক্কাটাও মেনে নিতে পারেন নি তাঁরা। যেমন ২০১১ সালের ধাক্কা মেনে নিতে পারেনি সিপিএম। নারীদের প্রতি সম্মানজনক ভরসা না থাকলেও বিজেপি মমতার বিকল্প নেত্রীর সন্ধানে ছিলেন। রূপা গাঙ্গুলী, লকেট চ্যাটার্জীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সার্থকতার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেন নি রূপা অথবা লকেট। এখন তো রূপা গাঙ্গুলি অনেকটা দূরে সরে গেছেন, লকেট তো ভবানীপুরে প্রচারেই এলেন না। কুনাল ঘোষের কথা সত্য হলে বুঝতে হবে লকেটের মধ্যে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছে।
বিজেপি নেতৃত্ব টক্কর দেবার জন্য যে প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে এগিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর চলনে-বলনে মমতার মতো ‘অগ্নিকন্য’ হবার অভিনয় করেছিলেন, বলেছিলেন অনেক গরমগরম কথা, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, এমন কি পরাজিত হবার পরেও এনেছেন ছাপ্পা ভোটের প্রসঙ্গ। এটা শেষ পর্যন্ত হাসির খোরাক হবে। কারণ তাঁদের নির্বাচন কমিশনই সেসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, প্রিয়াঙ্কা যদি জেতেন, তাহলে বিরোধী দলনেতার পদ তিনি ছেড়ে দেবেন। এ কথা বলতে পেরেছিলেন শুভেন্দু, কারণ তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে ভবানীপুরে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তৃণমূলকে একটু ঘাবড়ে দেওয়া, তাঁদের কর্মীদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্ট করার জন্য প্রিয়াঙ্কাকে আসরে নামানো। একজন রাজনৈতিক নেতা যাঁকে ‘শাউটিং ভাবিজি’ আখ্যা দিয়েছেন।শুধু বিজেপি নয়, এর আগে কংগ্রেস ও সিপিএমও মমতার বিকল্প সন্ধান করেছিলেন। দীপা দাশমুন্সীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস। তারপরে দীপা দূরে সরে গেলেন রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে। চেষ্টা সিপিএমও করেছেন। সাম্প্রতিককালে মীনাক্ষীর মতো তরুণীদের সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। উল্টোদিকে অজন্তা বিশ্বাস ও বসুন্ধরা গোস্বামীর মতো বামপন্থীরা মমতার ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন সম্ভাব্য শাস্তির কথা মাথায় রেখেও। বিজেপিকে পুরুষতান্ত্রিক দল বলেছি, কিন্তু বামেরাও প্রচ্ছন্নভাবে পুরুষতান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত। তা না হলে সে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নারীশক্তির প্রাধান্য নেই কেন ? একবার বৃন্দা কারাতের মুখে সেই অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছিল।
একজন মানুষের বিকল্প অন্য মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। মনস্তা্ত্বিক বিচারে মমতা ব্যনার্জীর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমি ২০১১ সালে নির্বাচনের আগে ‘একা এক নারী : প্রতিপক্ষ কয়েকজন’ বইতে বিশ্লেষণ করেছিলাম, তার সারবত্তা ঘটনাধারায় প্রমাণিত। তাঁর সহজিয়া ভঙ্গী একেবারে ব্যতিক্রমী। চেহেরায়, চলনে-বলনে একেবারে ঘরোয়া নারী। চাপা হাসি মাপা কথার মানুষ নন। রাগ হলে সেই রাগ প্রকাশ করেন রাখ-ঢাক না করে। সভায় বক্তৃতা করতে করতে কর্মী- সমর্থকদের ধমকে ওঠেন, নতুন কোন অতিথি সভায় এলে বক্তৃতা থামিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে আসেন। বিবাহাদি করেননি, কিন্তু ব্যাচিলারসুলভ রুক্ষতা দেখা যায় না। পরিবারের প্রতি, কর্মী-সমর্থকের প্রতি তাঁর মমতা দৃষ্টিগোচর হয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct