এই সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত। তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলির কথা বলিতে পারিতেন। নিত্য নতুন রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের কথা বড় মনে পড়ে। আফসোস হয়। সামাজিক রঙ্গ অপেক্ষা রাজনৈতিক রঙ্গ এখন প্রধান স্থান দখল করিয়াছে। রাজনৈতিক নেতাদিগকে অভিনয়বিদ্যায় কে দীক্ষা দিয়াছিল, জানি না; তাঁহারা ক্ষণে ক্ষণে হাসিয়া-কাঁদিয়া, নানাবিধ ছলাকলার দ্বারা বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমাইয়া তুলিয়াছেন। বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান ধারা লইয়া বিশ্লেষণ করিয়াছেন দিলীপ মজুমদার। আজ তৃতীয় কিস্তি।
কথায় বলে জো জিতা ওহি সিকিন্দর। ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় হইয়াছে। আপাতত বিজেপিতে কিছু প্রাপ্তির আশা নাই। পরাজয়ের পর সে দলের ভিতর কোন্দল শুরু হইয়াছে। আদি-নবর দ্বন্দ্ব। আদি বিজেপির লোকেরা বলিতেছেন তৃণমূলের গদ্দারদের অবাধ অনুপ্রবেশে দলের এই হাল হইয়াছে। এদিকে যাঁহারা বিজেপিতে গিয়াছিলেন, তাঁহারা তৃণমূলে ফিরিতে ইচ্ছুক। তাঁহাদের মস্তক মুণ্ডন করিয়া, কান ধরিয়া উঠ-বস করাইয়া , স্যানিটাইজার ছিটাইয়া শুদ্ধ করিয়া তৃণমূলে ঢোকানো হইল। শুদ্ধিকরণের সে দৃশ্য দেখিলে অশ্রুসংবরণ করা কঠিন। বিজেপির মতো বামেরাও পরাজয়ের কারণ খুঁজিতে বসিয়া গেলেন। এক বিদ্রোহী সদস্য বলিলেন, পরাজয়ের এই দায় নেতৃত্বকে লইতে হইবে। তাঁহাকে শোকজ করা হইল। হইবেই তো। এ দেশে কোন নেতা কখনও কোন দায় লন নাই, তাহা কর্মীদের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছেন। লাভের গুড় তাঁহারা গলাধঃকরণ করেন, বোকা মহাদেবের মতো কর্মীদের নীলকণ্ঠ হইতে হয়। বিজেপির যে সব প্রবাসী নেতা ভোট পরিচালনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের গায়েও আঁচড়টি লাগিল না। তথাপি কর্মীরা বলিতে লাগিলেন , নেতা ধর্ম , নেতা স্বর্গ।
রাজ্যের মুখ্যসচিবকে লইয়া বেশ এক দফা রঙ্গ হইয়া গেল। কলাইকুণ্ডায় তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কথায় চলিয়াছিলেন , প্রধানমন্ত্রীকে জো-হুজুর করেন নাই। তাই তাঁহার দিকে দিল্লির রক্তচক্ষু ধাবিত হইল। রাজ্য সরকার তাঁহাকে তিন মাস এক্সটেনশন দিয়াছিলেন , কিন্তু দিল্লি তাঁহাকে তলব করিলেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে অবসর দিয়া কিস্তি মাত করিতে চাহিলেন। কিন্তু কেন্দ্র ছাড়িবার পাত্র নহে। কি করিয়া মুখ্যসচিবকে ফাঁসানো যায় তাহার ফিকির খুঁজিবার চেষ্টা চলিতেছে।
শাসক দলের এক নারী সাংসদ ছিলেন সুন্দরী অভিনেত্রী। তিনি মুসলমান হইয়াও বিবাহ করিয়াছিলেন এক হিন্দু পুরুষকে। শাঁখা-সিঁদুর পরিয়া মন্দিরে গিয়াছিলেন। টানিয়াছিলেন ইসকনের রথ। পরে তিনি বলিতে লাগিলেন এ বিবাহ বিবাহই নয়। অতঃপর তাঁহাকে এক অভিনেতার সহিত ঘনিষ্ঠ হইতে দেখা গেল। স্বামীর সহিত সম্পর্কছিন্ন হইয়াও তিনি কেমন করিয়া গর্ভবতী হইলেন , সে প্রশ্ন উঠিল। কিন্তু নারীবাদী সাংসদ তাহাকে গ্রাহ্য করিলেন না। বিরোধী দলের লোকেরা তাঁহাকে ধিক্কার দিয়া রক্ষণশীল মনের পরিচয় স্থাপন করিলেন। তসলিমা নাসরিনের মতো নারীবাদীরা তাঁহার পক্ষ লইলেন। ইহাই তো প্রেমের লীলা। যুগ যুগ ধরিয়া এই লীলা চলিতেছে। এক্ষণে এই লীলায় অবগাহন করিয়াছেন শোভন- বৈশাখী। শোভন ছিলেন হেভিওয়েট মন্ত্রী ও মেয়র। বৈশাখী ছিলেন অধ্যাপিকা। দুজনেই ছিলেন বিবাহিতা , দুজনেরই সন্তান ছিল। প্রেমের এমনই লীলা যে দুজনেই সে সব পরিত্যাগ করিলেন এক লহমায়। দুজনে এখন নাচিতেছেন, গাহিতেছেন, ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়া হাওয়া খাইতেছেন। তাঁহাদের কাছে ‘সমাজ সংসার মিছে সব / মিছে এ জীবনের কলরব।‘’
আদালত চত্বরে আবার জমিল রঙ্গ। নন্দীগ্রামের পরাজয় মানিতে পারেন নাই শাসক দল। তাঁহারা দ্বারস্থ হইলেন আদালতের। বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে বিচার। কিন্তু শাসকদল বলিলেন এই বিচারপতি বিজেপির লিগাল সেলে ছিলেন, মামলা লড়িয়াছেন বিজেপির হইয়া, অতএব ইনি নিরপেক্ষ বিচার করিতে পারিবেন না। আইনজীবীরা এই ব্যপারে দ্বিধাবিভক্ত হইলেন।
নিউটাউনের ‘সুখবৃষ্টি’ আবাসনে ঘাপটি মারিয়াছিল পঞ্জাবের দুই সন্ত্রাসবাদী। পুলিশ সেখানে অপারেশন চালাইল। পুলিশের গুলিতে দুই সন্ত্রাসবাদী নিহত হইল। অনেকেই পুলিশের প্রশংসা করিলেন। কিন্তু বিরোধীরা বলিতে লাগিলেন এ রাজ্য সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, ইহাতে শাসকের প্রশ্রয় আছে। শুনিয়া রে রে করিয়া উঠিলেন শাসক দলের সদস্যরা। দল ও নেতারা কদাচ নিজেদের খামতি স্বীকার করেন না। নৌটাঙ্কি করিয়া তাঁহারা বুঝাইয়া দেন যে তাঁহারা নিষ্কলঙ্ক। দলীয় কর্মীরা সুর করিয়া বলিতে থাকেন : দোষ কারো নয় গো মা / দোষ কারো নয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct