এই সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত। তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলির কথা বলিতে পারিতেন। নিত্য নতুন রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের কথা বড় মনে পড়ে। আফসোস হয়। সামাজিক রঙ্গ অপেক্ষা রাজনৈতিক রঙ্গ এখন প্রধান স্থান দখল করিয়াছে। রাজনৈতিক নেতাদিগকে অভিনয়বিদ্যায় কে দীক্ষা দিয়াছিল, জানি না; তাঁহারা ক্ষণে ক্ষণে হাসিয়া-কাঁদিয়া, নানাবিধ ছলাকলার দ্বারা বঙ্গরঙ্গমঞ্চ জমাইয়া তুলিয়াছেন। বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান ধারা লইয়া বিশ্লেষণ করিয়াছেন দিলীপ মজুমদার। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
হিড়িক পড়িল দলবদলের। নির্বাচনের পূর্বে বিজেপি জিতিতেছে বলিয়া তৃণমূলের অনেকে বিজেপিতে চলিয়া গিয়াছিলেন। তৃণমূল তাঁহাদের ‘গদ্দার’ বলিয়া দাগিয়া দিয়াছিলেন। সেই গদ্দাররা এবার ঘরে ফিরিতে চাহেন। সোনালি কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিলেন। রাজীব শুভেন্দুর বিরুদ্ধে গরম গরম বাক্যবাণ ছাড়িতে লাগিলেন। দলবদলের রঙ্গ জমিয়া গেল।
আশা ও স্বপ্ন পূর্ণ হয় নাই। নির্বাচনে পরাজয় হইয়াছে। তথাপি বিজেপি মচকাইতে চাহে না। কোন রাজনৈতিক দলই তাহা চাহে না। ছুতা খুঁজিতে থাকে। বিজেপও ছুতা খুঁজিয়া পাইল। সেই ছুতা হইল আইন-শৃঙ্খলার অবনতি। এমন বলিতেছি না যে তৃণমূল বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা লইয়াছে। সহিষ্ণুতায় পারঙ্গম হইয়াছে। রাজনীতির সহিত ক্ষমতাদখলের হিংসা যুক্ত থাকে। কিল-চড়-ঘুষিতে সে হিংসা সীমাবদ্ধ থাকে না। আরো শাণিত অস্ত্রের দীপ্তি উদ্ভাসিত হয়। তবে বিজেপির চিৎকারে অতিরঞ্জন ছিল। স্বাভাবিক। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তৃণমূল পরাজিত হইয়া এরূপ চিৎকার করিয়াছিল। বিজেপি অভিযোগ করিতে লাগিল তাহাদের কর্মী-সমর্থকদের শাসকদলের লোকজন পিটাইতেছে , ঘর ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে।
পরাজিত বিজেপির এই চিৎকার গতি পাইল রাজ্যপাল মহাশয়ের কার্যক্রমে। বঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে বর্তমান রাজ্যপালের সত্যই কোন তুলনা নাই। রাজভবনে ঢুকিয়াই ইনি শাসকদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন। সেরূপ করিবার জন্য ইঁহাকে প্রেরণ করা হইয়াছিল কি না তাহা সবিশেষ জানা যায় নাই। ইনি শয্যাত্যাগ করিয়া টুইট করেন , দ্বিপ্রহরে ভাতঘুমের পরে টুইট করেন, নিশা সমাগমে টুইট করেন , এমন কি মধ্যরাতে জাগিয়া উঠিয়া টুইট করেন। সে সব টুইটে থাকে শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কখনও আইন-শৃঙ্কলা, কখনও শিক্ষা, কখনও স্বাস্থ্য লইয়া। শাসক ও বিরোধীর তরজার রঙ্গে রাজ্যপাল মহাশয় নতুন রঙ্গ যুক্ত করিয়া দেন। এবার তিনি বলিতে লাগিলেন রাজ্যের শাসক দল হিংসা ত্যাগ না করিলে তাঁহাদের ভয়াবহ পরিণামের শাস্তি পাইতে হইবে। রাজভবনের আরাম ত্যাগ করিয়া রাজ্যপাল সরজমিন তদন্ত করিবার জন্য কপিলাবাস্তুর রাজকুমারের মতো পথে বাহির হইলেন। সঙ্গে লইলেন বিজেপি সাংসদকে। ইহাতে শাসকদলও ধুম মাচাইয়া দিলেন। বলিতে লাগিলেন রাজ্যপাল নিরপেক্ষ নহেন, তিনি প্রকারান্তরে বিজেপির মুখপাত্র। তাঁহারা নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্যপালের ভূমিকা লইয়া গগনবিদারী চিৎকার শুরু করিয়া দিলেন। শীতলখুচি লইয়া খোঁচাইতে লাগিলেন।
দিন তিন চার পরে আবার জমাট নাটক।
রাজ্যপাল মহাশয়ের সম্মতিক্রমে সিবিআই মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী ও ফিরহাদ হাকিম, বিধায়ক মদন মিত্র , কলিকাতার প্রাক্তন মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জী মহাশয়দের গ্রেপ্তার করিল ঊষাকালে। গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। কর্মী-সমর্থকরা করোনাকে তুড়ি মারিয়া ছুটিয়া গেলেন সিবিআই চত্বরে। নেতাদের অপমান বলিয়া কথা ! প্রতিবাদ গাঁধীপ্রদর্শিত পথ অতিক্রম করিয়া গেল অচিরে। ইট-পাটকেল নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। মুখ্যমন্ত্রীও ছুটিয়া গেলেন। কয়েকঘন্টা বসিয়া রহিলেন। গেলেন আইনমন্ত্রীও। তাঁহাদের উপস্থিতি লইয়া প্রশ্ন তুলিল সিবিআই। নিম্ন আদালতে জামিন হইলেও সেই রাত্রিকালে সিবিআই দ্বারস্থ হইলেন হাইকোর্টের। জামিন নামঞ্জুর হইল। এদিকে রাজভবনের সম্মুখে এক ছোকরা একপাল ভেড়া লইয়া দাঁড়াইয়া গেল। সে বোধহয় বলিতে চাহিল, ‘রাজ্যপাল ভেড়ার পাল ’।
অভিযুক্তদের তিনজন অসুস্থ বোধ করায় তাঁহাদের পি জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইল। বিরোধীরা বলিলেন ইহা নাটকের রঙ্গ। এদিকে যে বান্ধবীর জন্য শোভন চ্যাটার্জীবাবু স্ত্রী-পুত্র-দল ছাড়িয়াছিলেন, তাঁহার কক্ষেও অভিনীত হইতে লাগিল নাটক। তাঁহার বান্ধবী কাঁদিয়া-কাটিয়া নাটক জমাইয়া দিলেন। নিন্দুকেরা বলিতে লাগিল : লাগ ভেলকি লাগ। ইহার মধ্যে কালারফুল মদন মিত্র রঙিন জামা পরিয়া, গান গাহিয়া, ‘লাভলি লাভলি’ বলিয়া হাসপাতাল মাতাইয়া দিলেন।
দেখিতে দেখিতে আসিয়া পড়িল ইয়াস।
মত্যভূমিতে মানুষের মতো প্রকৃতিও রঙ্গে মাতে। ইয়াস ঝড়ও রঙ্গে মাতিল। মেদিনীপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহু অঞ্চল জলমগ্ন হইল, ঘরবাড়ি পড়িয়া গেল, শস্য ও গবাদি পশু বিনষ্ট হইল। এবার শুরু হইল ত্রাণ লইয়া নতুন নাটক। বিরোধীরা ত্রাণের গাফিলতি, স্বজন-পোষণ লইয়া সরকারকে দোষারোপ করিতে লাগিল , শাসকদল নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা সাব্যস্ত করিতে সর্ববিধ চেষ্টা করিতে কসুর করিলেন না। কেন বাঁধ হয় নাই, কেন ম্যানগ্রোভ নষ্ট হইল তাহা লইয়া চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার হাট বসিয়া গেল। শাসকদল রাজীব, শুভেন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপাইতে তাঁহারাও রে রে করিয়া বাক যুদ্ধে লাফাইয়া পড়িলেন। রসিক মানুষ বলিতে লাগিলেন : এ তো বড় রঙ্গ যাদু, এ তো বড় রঙ্গ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct