বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। চতুর্বিংশ কিস্তি।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট। অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপুজো ও শিলান্যাস। করোনাকবলিত দুঃসময়েও রামভক্তদের সীমা নেই উৎসাহের। ভূমিপুজোর আগে বিভিন্ন স্থানে ভক্তরা দীপোৎসব পালন করেছেন। অযোধ্যায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শিলান্যাস করবেন। অথচ সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কেউ কেই সাহসী হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। বলেছিলেন শিলান্যাস অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে। হয়তো বলেছিলেন জওহরলালের কথা, যিনি সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির কাছে রাজধর্মের চেয়ে রামধর্মের গুরুত্ব বেশি। অশরীরী রামই তাঁদের ভোটব্যাঙ্ককে পুষ্ট করেছেন।
দিল্লি থেকে বিমানে উঠলেন তিনি। তখন তাঁর উত্তরীয়ের রং হাল্কা সাদাটে। কিন্তু অযোধ্যায় দেখা গেল তা হয়েছে গেরুয়া হলুদ। মুখে অবশ্য মাস্ক আছে। বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বেপরোয়া নন তিনি। তাঁর মন্ত্র যে ‘দো গজ দুরি / মাস্ক জরুরি’। হনুমানগঢ়ীর পুজো থেকে রামলালার আরতি—সর্বত্র তিনি। রামের জন্ম মুহূর্ত নাকি ১২টা ৪৪ মিনিট ৮ সেকেণ্ডে। ভূমিপুজোর আসনে বসলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি যে যজমান। পুরোহিতের কথা মেনে চললেন অক্ষরে অক্ষরে। মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। পরলেন কুশের আংটি। একটা চৌকো গর্তের কাছে বসলেন তিনি। কেন ? কারণ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন ঠিক এখানেই ৬ ফুট বাই ৩ফুটের খাটিয়ায় জন্ম শ্রীরামচন্দ্রের। বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের ঠিক তলায় নাকি ছিল রামের জন্মস্থান।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। এখন আর মসজিদের বাধা নেই। সাদা তাঁবুর অস্থায়ী ছাইনিতে বিরাজ করছেন রামলালা।
গণেশ-বাবা-মা- ইষ্টদেবতা-ভূমিদেবতা-বাস্তুদেবতাকে স্মরণ করে যে পুজোর সূত্রপাত, তাতে বাদ গেল না কূর্মমাতা, পৃথিবীমাতা, অনন্ত শেষনাগ, বরাহদেবতা, মৎস্যদেবতা, দশাবতারের আরাধনা। একে একে পুজো করা হল গর্তে রাখা ৯টি ইটের। রামকে তাঁর নিজের ঘর যেন ফিরিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সঙ্গে একাকার হয়ে গেল ‘জয় মোদি’ ধ্বনি।
আশ্চর্যের বাকি আছে। তিনি রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের।
সেই অমৃতবাণীর কিছু অংশ : ‘ স্বাধীনতা আন্দোলনে কয়েক প্রজন্ম নিজেদের সব কিছু সমর্পণ করেছিল। ১৫আগস্ট সেই তপস্যা, লাখো বলিদানের প্রতীক। ... ঠিক একই ভাবে রামমন্দিরের জন্য কয়েক শতাব্দী ধরে, কয়েক প্রজন্ম অবিরাম একনিষ্ঠ চেষ্টা করেছেন। আজকের দিন সেই তপস্যা, ত্যাগ ও সঙ্কল্পের প্রতীক।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ০৬.০৮.২০২০)।
নরেন্দ্র মোদির আমলে চমকের পর চমক। নোটবন্দি, জি এস টি, সার্জিকাল স্ট্রাইক, ৩৭০ ধারা রদ....গত বছর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাম ফিরে পেলেন তাঁর জন্মভূমির অধিকার। এ বছর ৫ আগস্ট রামমন্দিরের শিলান্যাস। চমকের এখনও বাকি।
এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর আবার চমক। লখনউ-এর বিশেষ আদালতের বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদবের রায়। বাবরি ধ্বংস মামলার রায়। এক কথায় সে রায়ের নির্যাস হল : দোষ কারো নয় গো মা, দোষ কারো নয়। আদালত জানালেন :
১] অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা, উস্কানিমূলক বক্তৃতা, শ্লোগান দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার পরিকল্পনা পাওয়া যায় নি।
২] বাবরি মসজিদে বহুদিন নমাজ পড়া হত না। তাই উপাসনাস্থলের ক্ষয়-ক্ষতির অভিযোগ ধোপে টেকে না।
৩] বেআইনি জমায়েত ? না, সে অভিযোগও টেকে না , কারণ ১৪৪ ধারা ছিল না।
৪] ২৮ বছর তদন্ত চালিয়ে সি বি আই অভিযোগ প্রমাণে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারে নি। তাদের পেশ করা ভিডিয়োয় শিলমোহর, নিরপেক্ষ সাক্ষীর সই নেই। কবে, কে, কোথায়, কী অবস্থায় এসব ক্যাসেট তৈরি করেছিল, তার উল্লেখ নেই।
৫] লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলীমনোহর জোশি, উমা ভারতীরা করসেবকদের যে খেপিয়ে তুলেছিলেন, তার প্রমাণ নেই।
৬] চার্জশিটে এমন কোন প্রমাণ নেই যে অভিযুক্তরা সমাজবিরোধীদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে মসজিদ ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন বা কোন প্ররোচনা দিয়েছিলেন হাঙ্গামার বা যোগ দিয়ে ছিলেন তাতে । বিপরীত দিকে অভিযুক্তরা সমাজবিরোধীদের বাধা দিয়েছিলেন।
৭] আসলে সমাজবিরোধীরাই ভেঙেছিল মসজিদ। তারা মিশে ছিল করসেবকদের মধ্যে। তারা যদি প্রকৃত অর্থে রামভক্ত হত তাহলে অশোক সিংঘলের কথা শুনে শান্ত থাকত। বেলা বারোটা পর্যন্ত সব স্বাভাবিক ছিল। যখন সিংঘল ঘোষণা করলেন করসেবা কী ভাবে হবে, করসেবকদের একাংশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ব্যারিকেড ভেঙে তারা কাঠামোর উপরে উঠে পড়ে।
৮] ‘এক ধাক্কা অউর দো’ শ্লোগানে অভিযুক্তরা গলা মিলিয়ে ছিলেন বলে প্রমাণ করার নথি বা গলার আওয়াজের নমুনা পেশ করা হয় নি।
৯] ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ক ধারায় অপরাধ প্রমাণ করতে গেলে নির্দিষ্ট করে বলতে হবে কার ঠিক কোন কথায় গোষ্ঠীবিদ্বেষ ছড়িয়েছে, নষ্ট হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। এটা বলে দেওয়া যথেষ্ট নয় যে কেউ কিছু উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
১০] আদালতে তদন্তকারী অফিসার জানান যে তাঁরা তদন্ত করেছেন নিজেদের মতো করে। তাঁরা ফৌজদারি দণ্ডবিধি যথাযথভাবে মেনে চলেন নি।
তুচ্ছ হয়ে গেল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কয়েক লক্ষ নাম-না-জানা করসেবকদের বিরুদ্ধে রাম জন্মভূমি পুলিশ স্টেশনের সাব ইন্সপেকটর গঙ্গাপ্রসাদ তিওয়ারির প্রথম এফ আই আর ( কেস নম্বর ১৯৭/১৯৯২)। যাতে তিনি বলেছিলেন করসেবকদের আগ্রাসী মনোভাবের কথা। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সঙ্গে ধ্বংসকার্য, মুখঢাকা করসেবকদের পুলিশকে লক্ষ করে পাথর ছোঁড়া।
তুচ্ছ হয়ে গেল গঙ্গাপ্রসাদ তিওয়ারির দ্বিতীয় এফ আই আর (কেস নম্বর ১৯৮/ ১৯৯২)। যাতে তিনি রামকথা কুঞ্জের মঞ্চে অশোক সিংঘল, গিরিরাজ কিশোর, লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলীমনোহর জোশী, বিষ্ণু হরি ডালমিয়া, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, সাধ্বী ঋতাম্ভরার উপস্থিতির কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন ‘এক ধাক্কা অউর দো/ বাবরি মসজিদ তোড় দো’, ‘রামলালা হম আয়েঙ্গে/ মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’ শ্লোগানের কথা।
তুচ্ছ হয়ে গেল লিবেরহান কমিশনের বক্তব্য।
তুচ্ছ হয়ে গেল রাম জন্মভূমি- বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য , ‘ মসজিদ ভাঙা ও ইসলামিক সৌধ ধ্বংস আইনের শাসনের গুরুতর লঙঘন ছিল। অযোধ্যা মামলা চলাকালীন মসজিদের গোটা কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া পরিকল্পিত পদক্ষেপ ছিল। সাড়ে চারশো বছর আগে তৈরি মসজিদ থেকে মুসলিমরা অনৈতিকভাবে বঞ্চিত হয়েছিলেন।’
যে ৪৯ জন অভিযুক্ত ছিলেন, আদালতের রায়ে তাঁরা বেকসুর খালাস হলেন। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আদবানী বললেন, ‘ওই রায় রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রশ্নে আমার ও বিজেপির যে বিশ্বাস এবং দায়বদ্ধতা , সেটিকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আমি আশীর্বাদধন্য বলে মনে করছি
কারণ ওই রায়টি ২০১৯ সালে নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় আসার ফলেই অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের যে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল তা পূরণ হয়েছে।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ০১.১০.২০২০)
মরলীমনোহর জোশী বললেন, ‘ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল না তা আজ প্রমাণ হল।‘ (ওই)
উত্তরপ্রদেশের স্বনামধন্য মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বললেন, ‘স্রেফ ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে সাধুসমাজ, বিজেপি-ভি এইচ পি কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছিল কংগ্রেস।’(ওই)
আদালতের রায় সম্বন্ধে আমাদের কী ভাব ? ভাবের অভাব। আমরা বলব : চোপ আদালত চলছে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৯
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৮
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৭
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৬
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct