বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। ত্রয়োবিংশ কিস্তি।
অযোধ্যা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক ও অযোধ্যা বিশেষজ্ঞ ডি এন ঝা বলেন :
‘অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় হতাশাজনক। যে যুক্তির ওপরে এই রায়, তার অনেক কিছুই প্রশ্নযোগ্য। একটি অংশ হল ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের ২০০৩এর রিপোর্টের উল্লেখ। শীর্ষ আদালত সেখান থেকে কিছু সিদ্ধান্ত টেনেছে। ওই রিপোর্ট সবদিক থেকেই ভ্রান্ত, নির্ভরযোগ্য নয়। প্রত্নতাতত্বিক খননের বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে ওই খনন করা হয় নি। আদালতের রায়ে ওই খননকার্য চালানো হলেও প্রথম থেকেই ধরে নেওয়া হয়েছিল তলায় একটি হিন্দু মন্দির রয়েছে। এই ধারণাকে প্রমাণ করার জন্য যা যা বলটে হয় বলেছে। যে যে প্রমাণ এই পূর্বধারণার সঙ্গে মেলে না তা গোপন করা হয়েছে। যেমন পশুর হাড়, চিত্রিত পাত্র, গ্লেজড টাইলস পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় নি। ওই রিপোর্টে ইটের তৈরি স্তম্ভপাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। খনন দেখছিলেন এমন প্রত্নতাত্ত্বিকরা তখন অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন যে এধার-ওধার থেকে পাওয়া ইট একজায়গায় জড়ো করে স্তম্ভের তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে। সেই স্তম্ভও কোন ভারবাহী স্তম্ভ নয়। মজার কথা হল গোটা রিপোর্টে মন্দিরের অস্তিত্বের কোনও উল্লেখ নেই, কিন্তু রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার পরিচ্ছেদে হঠাৎ মন্দিরের উল্লেখ করা হয়। এই অংশটির লেখক কে, তা বলা নেই।বোঝাই যায় এ বিকৃত রিপোর্ট।
‘ইতিহাসবিদরা ওই রিপোর্টকে আগেই খারিজ করে দিয়েছিলেন। এর আগে চার ইতিহাসবিদ—সূরয ভান, আথার আলি, রামশরণ শর্মা ও আমি সমস্ত পুরাতাত্ত্বিক ও পাঠ্য নিদর্শন খতিয়ে দেখছিলাম। আমাদের উপসংহার ছিল মসজিদের নীচে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব নেই। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, অ-ঐস্লামিক কাঠামো পাওয়া গেছে বলে এএস আই বলেছে। তা কী, স্পষ্ট নয়। এই নিয়েও পুরনো বিতর্ক আছে।
‘ এলাহবাদ হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল সেখানে হিন্দু পক্ষের বিশ্বাস অন্য যুক্তির ওপরে প্রাধান্য পেয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট এলাহবাদ হাইকোর্টের রায় খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত রিপোর্টকেই উল্লেখ করেছে।
‘ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের মন্দির ভেঙেছেন। কিন্তু হিন্দু শাসকরা এর থেকে বেশি মন্দির বা ধর্মস্থান ভেঙেছে। জৈন ও বৌদ্ধদের অসংখ্য ধর্মস্থান তারা ভেঙে দিয়েছে। কে কত ধর্মস্থান ভেঙেছে, তা নিয়ে গবেষণা চলতেই পারে। মধ্যযুগের ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের তেমন ইতিহাস না থাকলেও অযোধ্যায় ১৮৫৫তে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত হয়েছিল। অওধের নবাব সেই সংঘাতের মীমাংসায় মসজিদের বাইরে মূর্তি বসাবার অনুমতি দিয়েছিলেন, ওই জায়গাই পরে সীতা কা রোসই নামে পরিচিত। ওয়াকফ বা ট্রাস্টও তিনি তৈরি করেছিলেন। ১৮৮৫তে আইনগতভাবে ঠিক হব মসজিদে মুসলিমের অধিকার থাকবে, সীতা কা রোসই হিন্দুদের হবে। এই প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক অভিযান নতুন করে শুরু হয় ১৯৪৯এর ডিসেম্বরে মসজিদের অভ্যন্তরে চুপিসারে মূর্তি বসিয়ে দেবার পর থেকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তৈরি হবার পরে এবং বাবরি মসজিদের জায়গাতেই রাম মন্দির বানাতে হবে—এই শ্লোগান তোলার পরে সাম্প্রদায়িকতা চড়া মাত্রা পায়। তারপরে কীভাবে রাম মন্দির নির্মাণের অভিযান চালানো হয়েছে তা আমরা সকলেই দেখেছি।
‘আমার মনে হব, বিচারবিভাগের উচিত ছিল আগেই ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞদেরেই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার। তাঁদের অভিমত নেওয়া যেতে পারত। এমন কি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া যেতে পারত। কোনও একটি রিপোর্টের হঠাৎ এবং বিচ্ছিন্ন উল্লেখ করে কোনও বিশ্বাসের ধারণাকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস ভালো লাগে নি।
‘পেশাদার ইতিহাসবিদ আমি বলতে পারি রাম ওই ২.৭৭ একরেই জন্মেছিলেন, তা কোনদিনই প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি নেই। বিশ্বাসের ভিত্তিকে যুক্তির পেছনে ঠেলে দেওয়া সমাজের পক্ষে কল্যাণকর নয়।’ ( গণশক্তি ১০.১১.২০১৯)
ইতিহাসবিদ হরিবংশ মুখিয়ার অভিমত :
‘সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের অনেকগুলি দিক আছে। এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে রাম নামক পৌরাণিক চরিত্রটিকে ঐতিহাসিক চরিত্র করে তোলা হল। এই রায়ে বলা হয়েছে, বিশ্বাস কখনওই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তি হতে পারে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হিন্দুদের এই বিশ্বাসকেই মান্যতা দিয়েছে যে রাম বাবরি মসজিদের গম্বুজের তলায় জন্মেছিলেন। কাজেই এই রায় অবশ্যই রামকে একটি ঐতিহাসিক চরিত্রের মান্যতা দিয়েছে। দেখুন, পৌরাণিক চরিত্রগুলি যে ইতিহাসের চরিত্র, হয় তা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন, যেমন কি না হিন্দুরা করেন বলে বলা হয়ে থাকে, কিংবা একজন পণ্ডিত হিসেবে, ইতিহাসকার হিসেবে এবং বিশেষ করে ন্যায়বিচারের আদালত হিসেবে এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন, তার মানে কিন্তু পৌরাণিক চরিত্রগুলির প্রতি অসম্মান দেখানো নয়। কোনও পৌরাণিক চরিত্রকে ইতিহাসের চরিত্র হিসেবে মনে না করার অর্থ তাঁর প্রতি অসম্মান দেখানো নয়। তবু এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা পাণ্ডিত্য এবং ন্যায় বিচার উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। এক দিকে এই রায় বলছে রাম জন্মভূমি কোনও এনটিটি নয়, তবুও এই রায় রাম জন্মভূমিকে মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দিল, কারণ সেটাই হিন্দুদের বিশ্বাস। অবশ্য এই রায় এক প্রকার রাজনৈতিক
ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করেছে পাঁচ একর জমি মুসলমানদের দিয়ে। এই রায় বলছে, এমন কোন প্রমাণ নেই যে এই মসজিদ তৈরি করতে কোনও মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। হিন্দুদের পুরো মামলাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই দাবির উপর যে একটা রাম মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। কাজেই এক অর্থে এই রায়ে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেও সেটাকে মান্যতা দেওয়া হল। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার যে রিপোর্ট, সেটা নিয়েও বরাবরই বিতর্ক উঠেছে। তবুও যদি সেই রিপোর্ট মেনেও নেওয়া যায়, সেই রিপোর্টে বলা হবেছে যে মসজিদের তলায় একটা অ-মুসলমান ইমারত ছিল। কিন্তু এও বলা হয়েছে যে সেটা ভেঙে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল এমন কোন প্রমাণ নেই, এবং সেটাকে সুপ্রিম কোর্ট মান্যতা দিয়েছে। হিন্দুদের দাবির ভিত্তিই হল রাম মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি। এক অর্থে এই রায়ে সেই ধ্বংস করা নয়ে প্রশ্ন তোলা হল, আবার আর এক অর্থে একটি রাম মন্দির যে ধ্বংস করা হয়েছিল তা মেনে নেওয়া হল।’ ( অনুলিখন নীলাঞ্জন হাজরা। এই সময় ১০.১১.২০১৯)
ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের অভিমত :
‘ সুপ্রিম কোর্টের রায় যখন, তখন তা মান্য করতেই হবে। কিন্তু এই রায় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রায়ের অনেক অংশই স্ববিরোধী। অনেক প্রশ্নের উত্তর ভ্রান্ত।বলে হয়েছে, বাবরি মসজিদ ফাঁকা জমির উপর তৈরি হয় নি। এই তথ্য কোথা থেকে পাওয়া গেল ? এ এস আইএর একটি রিপোর্ট থেকে তা মনে হয়েছে।সেই রিপোর্ট আপাদমস্তক বিভ্রান্তিকর। এমন সময়ে সেই খননকার্য চালানো হয়েছে যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক উপকরণই বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হয় নি। নিয়ম মেনে খননই হয় নি। ওই রিপোর্ট কেউ যদি ভালো করে পড়েন, দেখবেন পশ্চিম প্রান্ত দেওয়ালের কথা বলা আছে। যে খিলান ও দরজার কথা বলা হয়েছে, তা একেবারেই মসজিদের রীতি অনুযায়ী। ওই ভগ্নাবশেষকে মন্দিরের প্রমাণ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেখানে আচমকাই স্তম্ভ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে যদিও তার কোন স্থাপত্য প্রমাণ নেই। এমন কি এই অভিযোগও উঠে্ছিল যে ২০০৩ এর ওই রিপোর্টে এমন উপকরণ পেশ করা হয়েছে যা আদৌ অযোধ্যায় পাওয়া যায় নি। বাইরে থেকে আনা হয়েছিল।
‘শীর্ষ আদালত নিজেই বলেছে. ১৫২৮ থেকে মুসলিমরা ওখানে প্রার্থনা করত। ১৯৪৯-এ মসজিদের ভেতরে মূর্তিরাখা হয়েছে। ১৯৯২তে মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং তা অন্যায় হয়েছে। তাহলে সেই জমি হিন্দু সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কেন ? মুসলিমদের অধিকারকে একেবারেই নস্যাৎ করা হল কেন ?
সুপ্রিম কোর্ট ‘সম্ভাবনার ভারসাম্য’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছে। এখানে সম্ভাবনার বিচার ছিল কী? সম্পত্তির অধিকারের মামলা হচ্ছিল। এমন কি ১৫২৮এর আগে ওই জমি হিন্দুদের হাতে ছিল তার কী প্রমাণ আদালতে দাখিল হয়েছে ? না, হয় নি।
‘বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে সেই জমির উপর মন্দির তৈরির অধিকার দিয়ে দেওয়ার একটি বৃহত্তর তাৎপর্য রয়েছে। এবার মথুরা, কাশীতেও এই নীতি প্রয়োগ করা হতে পারে। ৫০০-৬০০ বছর আগে তৈরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া যেতে পারে এই বলে যে ওখানে মন্দির ছিল। অধবা, মন্দির ছিল বলে বিশ্বাস রয়েছে। যা আসলে গুরুতর অপরাধ তার জন্য দরজা খুলে যেতে পারে এই রায়ে। এমনকি গুজরাটে এমন মন্দির আছে যা ছিল জৈনদের, শৈবরা তা দখল করেছে। এবার কী ওই মন্দির ভেঙে আবার নতুন করে মন্দির হবে ?
‘অযোধ্যার বিতর্কিত জমি ২,৭৭ একর , তা নিয়েই এলাহবাদ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল। সেই রায়ে বিশ্বাসকে ভিত্তি করায় আমরা অনেকেই আপত্তি করেছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে ওই ভূখণ্ড থেকে তো বটেই ওই এলাকা থেকেই মুসলিমদের হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যায় অধিগৃহীত জমির পরিমাণ ৬৭ একর। যে ৫ একর জমি মসজিদ করার জন্য দেওয়া হবে বলা হয়েছে, তা ওই ৬৭ একরের মধ্যে নয়। কোথায় তা বলা নেই। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে দূরে কোথাও। গোটা প্রাঙ্গণ থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করা হল।
‘ শীর্ষ আদালত বলেছে সরকার মন্দির তৈরির জন্য একটি ট্রাস্ট গড়ে দেবে। অথচ আমাদের সংবিধানে কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেবার অনুমোদন নেই। এ এক নতুন বিপদ।মন্দির-মসজিদ তৈরির জন্য সরকারকে টেনে আনা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে ক্ষুণ্ণ করেছে।’
( গণশক্তি ১০.১১.১৯১৯ )
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের অভিমত:
‘প্রথমেই বলি শীর্ষ আদলতের এ রায়কে খুব খুঁটিয়ে পড়তে হবে। রামলালা বিরাজমান অর্থাৎ রামের নামে যে শিলা তাকে মান্যতা দেওয়ায় তো কোন বিরোধ নেই ; কারণ সত্যই ওই পাথরকে রামের প্রতীকরূপে অনেকেই ধরে নিয়েছেন বহু দিন ধরেই। তাই রামলালা বিরাজমান কথায় কোন সমস্যা নেই। তবে এর মানে এই নয় যে রামকে ইতিহাসের চরিত্র রূপে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে । সব ইতিহাসবিদই জানেন, মানেন রাম একটি এপিক চরিত্র, এক ধরনের মিথ, যার প্রাণ ছিল কালিদাসি যুগে। তারপর কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে লোকে তাঁকে ভুলে গিয়েছিল। এই যে এখন হিন্দি বলয়ে তাঁর এহেন মান্যতা, তাও কিন্তু তুলসীদাসের আগে হয় নি। উত্তর ভারতে এই তাঁর অবতার হয়ে ওঠাও সেই যুগ থেকেই। তুলসীদাসের আগে তাঁর এই প্রতিপত্তি ছিল না, সেখানে আমরা পাচ্ছি শেবধর্মের প্রতিপত্তি। বাংলায় কালী, শক্তির আরাধনা আর উত্তর ভারতে শৈব। রাম কাল্ট যাকে আমরা বলি তা তো শুরু করলেন তুলসীদাস।
‘ কিন্তু ওই যে বললাম রাম তবু ইতিহাসবিদদের কাছে যিশু বা বুদ্ধের মতো রিয়াল নন। আমরা যে ভিত্তিতে এত আলোচনা করছি, অর্থাৎ বাল্মীকির নামে যেটা চলে, রামায়ণ, সেটা তো একটা টেক্সট। সেই টেক্সট অনুযায়ী যাঁকে আমরা পাই, তিনি তো কাল্পনিক চরিত্র, ইতিহাসের চরিত্র নন। কালিদাস বা সন্ধ্যাকর নন্দী, যদিও দুজনের সময়ের ফারাক আছে, আমরা দেখছি তাঁদের সৃষ্ট সংস্কৃত কাব্যে রামের একটা প্রভাব আছে।... আকবরের সময় এসে তুলসীদাস রাম কাল্টকে চাগিয়ে তুললেন। এবার সত্যি যদি রাম বলে কেউ থেকে থাকেন, সে সম্পর্কিত কোন নথি কী আমরা পাই ? আমরা যে ভাবে রামকে পাই তা ওই পৌরাণিক রামই। অতএব যদি কেউ ভাবেন, এই রায়ের ফলে রাম ইতিহাসের চরিত্ররূপে মান্যতা পেল, তা অমূলক।
‘ এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। রামজন্মভূমি। এটাই নাকি রামের জন্মস্থান। সে প্রসঙ্গে উঠে আসবেই আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার খননকার্য ও রিপোর্টের কথা। সে সময়ে গৌরী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডিরেক্টর। আমি উল্লেখ করব ইরফান হাবিবের কথা যিনি সরেজমিন তদন্ত করে সে রিপোর্টে আপত্তি করেছিলেন। তিনি কিন্তু আসল খননকার্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তখন খুঁড়ে যা পাওয়া গিয়েছিল তাতে আমরা জানি বাবরি মসজিদ বাবরের সময় তৈরি হয়েছিল; তারও নীচে কয়েকটা স্তর আছে। দেখতে হবে তাতে কী পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে আমরা পাই একটা মসজিদ। সুলতানি আমলের। ইরফান হাবিব এটা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন। তাঁর মতের সঙ্গে আমিও একমত।
‘তৃতীয় স্তরে যা পাচ্ছি তা আমার মতে একটা মন্দির। সম্ভবত শৈব মন্দির। উত্তর ভারতে তখন শৈব আধিপত্য চলছে। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকে ওই মন্দির তৈরি হয়েছিল।
‘এবার যদি ধরে নিই যে ওখানে ওই যে মন্দির ছিল, তার উপরে যে হেতু মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, অতএব সেখানে একটা মন্দির তৈরি করতে হবে, তাও রামের নামে, তা অন্তত ঐতিহাসিকভাবে গ্রাহ্য হওয়া উচিত নয়। রাম নিঃসন্দেহে এক পৌরাণিক চরিত্র ; রামায়ণ ও রামচরিতমানসও তাই। মানুষ বহুদিন ধরে যা মান্য করে, তাকে সম্মান জানানো আলাদা কথা, কিন্তু যদি বলা হয় রাম সত্যি, রাম ইতিহাসের সজীব চরিত্র এবং এই তাঁর জন্মস্থান, তবে বড় ভুল হবে।’ ( অনুলিখন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এই সময় ১০.১১.২০১৯)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৯
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৮
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৭
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৬
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct