বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। একবিংশ কিস্তি।
১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলাহবাদ হাইকোর্টে অযোধ্যা মামলার রায় দেন তিন বিচারক [ বিচারক এস ইউ খান, বিচারক সুধীর আগরওয়াল, বিচারক ডি ভি ভার্মা]। তাঁদের বক্তব্যের মূল কথা ছিল :
১] বিতর্কিত সৌধটি মসজিদ হিসেবে হয় বাবর তৈরি করেন, অথবা বাবরের আদেশে তৈরি হয়।
২] সৌধটি বাবর বা তাঁর আজ্ঞাবাহীর অধিকারভুক্ত কি না তা প্রমাণিত নয়।
৩] মসজিদ তৈরি করতে কোন মন্দির ভাঙা হয়নি।
৪] মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরেই তৈরি হয় মসজিদ।
৫] দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুরা বিশ্বাস করতেন যে বিতর্কিত জমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কোথাও ছিল রামচন্দ্রের জন্মস্থান।
৬] মসজিদ তৈরি হয়ে যাবার পরে হিন্দুদের মনে হয় মসজিদের অংশটিতে ছিল রামের জন্মস্থান।
৭] ১৮৫৫ সালের বহু পূর্ব থেকে রাম চবুতরা ও সীতা রসুইএর অস্তিত্ব ছিল। হিন্দুরা সেখানে পুজো করতেন।
৮] বিতর্কিত জমিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের অধিকার ছিল, কোন বিভাজন রেখা ছিল না।
এলাহবাদ হাইকোর্ট রায় দেন যে বিতর্কিত জমিটি ‘তিন টুকরো করে এক ভাগ দেওয়া হোক সুন্নিদের, বাকি দুই ভাগ দুই হিন্দু সংগঠনকে। কিন্তু গত নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ধার্য হল, মসজিদের ২.৭৭ একর জমির অধিকারী হবে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা গঠিত একটি ট্রাস্ট, যে সেখানে নির্মাণ করবে রামচন্দ্রের মন্দির। অপর দিকে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া হবে অযোধ্যাতেই কোথাও পাঁচ একর জমি, সেখানে তারা নির্মাণ করবে নতুন মসজিদ। সেটি অবশ্যই বাবরি মসজিদ হবে না, কারণ ইতিহাস এখন পুনর্লিখিত হচ্ছে।’ [দেশ /১৭.১০.২০]
২০১১ সালের ৯ মে অযোধ্যা জমি বিতর্কে এলাহবাদ হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বিতর্কিত এলাকায় রামমন্দির তৈরির অনুমতি প্রার্থনা করেন। বিচারপতি রঞ্জন গগৈএর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করা হয়। তৈরি হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী প্যানেল। কিন্তু শেষপর্যন্ত মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হয় প্যানেল। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর যুযুধান পক্ষগুলিকে আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দেন।
৭ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে এক আবেদনে জানায় যে বিতর্কিত স্থান থেকে কিছুটা দূরে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে মসজিদ তৈরি করা যেতে পারে।
১১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট এলাহবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দেন বিতর্কিত জমির ব্যাপারে সদর্থক মধ্যস্থতার জন্য ২ জন অতিরিক্ত জেলা বিচারককে ১০ দিনের মধ্যে মনোনয়ন করতে হবে। ২০ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের শিয়া সেন্ট্রাল বোর্ড সুপ্রিম কোর্টকে জানায় অযোধ্যায় হিন্দুদের মন্দির ও লক্ষ্মৌতে মুসলমানদের মসজিদ বানানো যেতে পারে। ১ ডিসেম্বর এলাহবাদ হাইকোর্টে ২০১০ সালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন করেন ৩২ জন নাগরিক অধিকার রক্ষাকর্মী।
২০১৮ সালের৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টৈ শুরু হয় সমস্ত দেওয়ানি মামলার শুনানি। ১৪ মার্চ যাঁরা এই মামলার পক্ষ হতে চেয়েছিলেন, সুব্রহ্মণ্য স্বামীসহ সকলের আবেদন নাকচ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ৬ এপ্রিল রাজীব ধাওয়ান ১৯৯৪ সালের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ ছিল তা বৃহত্তর বেঞ্চে পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানান। ২০ জুলাই রায় দান স্থগিত রাখে সুপ্রিম কোর্ট। ২৭ সেপ্টেম্বর ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে মামলা নিয়ে যেতে অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হয় ২৯ অক্টোবর থেকে মামলার শুনানি হবে ৩ বিচারপতির বেঞ্চে। ২৯ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে যথাযথ বেঞ্চে মামলার শুনানির দিন ধার্য করে, ২৪ ডিসেম্বর স্থির করা হয় ৪ জানুয়ারি থেকে সব আবেদনের শুনানি হবে। ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানায় শুনানির তারিখ ১০ জানুয়ারি স্থির হবে। সুপ্রিম কোর্ট ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করে। শীর্ষে রাখা হয় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে। অন্য বিচারকরা হলেন : এস কে বোবদে, এন ভি রামানা, ইউ ইউ ললিত, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়।
১০ জানুয়ারি বিচারপতি ইউ ইউ ললিত নিজেকে মামলা থেকে সরিয়ে নিয়ে ২৯ জানু্য়ারি নতুন বেঞ্চের সামনে মামলার শুনানি শুরু করতে বলেন।
২৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট ৫ সদস্যের যে সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করেন তাতে ছিলেন : রঞ্জন গগৈ, এস কে বোবদে, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোকভূষণ, এস কে নাজির।
২৯ জানুয়ারি কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে বিতর্কির অংশ বাদ দিয়ে বাকি ৬৭ একর জমি তাদের আদত মালিকদের ফিরিয়ে দেবার আবেদন জানায়।
২৬ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতার কথা বলে। আদালত নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারীদের উপর সে ভার দেওয়া হবে কি না সে সিদ্ধান্ত ৫ মার্চ নেওয়া হবে। ৬ মার্চ জমি বিতর্কে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে কি না সে সম্পর্কে রায় দান মুলতুবি রাখে সুপ্রিম কোর্ট। ৯ এপ্রিল কেন্দ্রের জমি ফেরানোর আবেদনের বিরোধিতা করে নির্মোহী আখড়া। ৯ মে ৩ সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি সুপ্রিম কোর্টে তাদের অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দেয়। ১৮ জুলাই মধ্যস্থতা চালিয়ে যেতে বলে সুপ্রিম কোর্ট। ১ আগস্ট রিপোর্ট জমা দেবার তারিখ স্থির হয়।
১ আগস্ট মধ্যস্থতা সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে সুপ্রিম কোর্টে। ৬ আগস্ট জমি মামলায় দৈনিক ভিত্তিতে শুনানির কথা জানায় সুপ্রিম কোর্ট। ১৬ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শেষ হয়। রায়দান মুলতুবি থাকে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/২০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৯
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৮
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৭
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৬
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct