বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। বিংশ কিস্তি।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এম এস লিবেরহানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেন তার নাম লিবেরহান অযোধ্যা কমিশন অফ এনকোয়ারি বা সংক্ষেপে লিবেরহান কমিশন। ৩ মাসের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৪৮ বার সময় সীমা বদল করে কমিশন ১৭ বছর পরে ২০০৯ সালের ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংএর কাছে জমা দেয় রিপোর্ট। ২০০৯ সালের নভেম্বরে একটি সংবাদপত্রে এই রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম সংসদে এই রিপোর্ট পেশ করেন। মোট ১০০জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিল এই কমিশন। এঁদের মধ্যে আছেন উত্তরপ্রদেশের উচ্চ পদাধিকারী আমলা ও পুলিশ অফিসার, জেলা শাসক আর এন শ্রীবাস্তব, অযোধ্যার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পোলিশ ডি বি রায়, সাংবাদিক মার্ক টুলি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি আর কুমারমঙ্গলম, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস বি চ্যবন, বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী, আর এস এস নেতা কে এস সুদর্শন, সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু, বিজেপির সভাপতি মুরলিমনোহর জোশী, বিজেপি নেতা এল কে আদবানি, বিজেপি নেতা বিনয় কাটিয়ার, ভি এইচ পি নেতা বিষ্ণু হরি ডালমিয়া, জনতা দল নেতা ভি পি সিং, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং, প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও, অযোধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের পরিদর্শক তেজ শংকর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন সিং, বিজেপি নেতা স্বামী শচীদানন্দ, ভি এইচ পি নেতা অশোক সিংঘল, বিজেপির উত্তরপ্রদেশের সভাপতি কালরাজ মিশ্র, রাম জন্মভূমি ন্যাসের সভাপতি মহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়েম সিং যাদব, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি মাধব গডবোলে প্রভৃতি।
এই কমিশনের রিপোর্টের ১৮টি অধ্যায় :1.Introduction 2. Ayodhya and its geography 3. The police administration 4. Sequence of events 5. The administration 6. Mobilisation of Karsevaks 7. Security set up and environment 8. Circumstance 9.Orgazinations and their interlinks 10. The joint common enterprise 11. President’s rule. 12. Secularism 13. The assault on the media 14. Conclusion 15. Recommendations 16. Afterword 17. List of witnesses 18. Maps
রিপোর্টের ভূমিকায় কমিশন রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য নীতি বিসর্জন দেওয়ার নিন্দা করেছেন । এর চরম মূল্য দিতে হয় ব্যক্তিমানুষ, দেশ ও জাতিকে [ ‘For some , the temptation of power is supreme. The usual means of acquiring power is through politics. There is always an urge and quest to use politics for acquiring power and for one’s own purpose --- nothing matters beyond political desirable results, however achieved. In the process of acquisition of power the consequence of the process on the institution, the nation, individuals and society as a whole does not matter. Life itself become politicized . Objectivity or intellectual honesty or logic is lost in the process. To acquire the political power or achieve the politically desirable results, institution, law, written or unwritten moral ethics, epics are contemptuously ignored. Healthy or legitimate process of governance is not cared for and political neutrality is lost.’]
১.২ ধারায় কমিশন বলেন যে স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের উপস্থিতিতেই ৬ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক দল, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা দল, শিব সেনার নেতা ও কর্মীর । এই ধ্বংসকার্যকে তাঁরা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন । সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাধু-সন্তরা, পুলিশ প্রশাসন, সংবাদ মাধ্যমের সদস্য ও করসেবকরা । ধ্বংসকার্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ [ ‘In the process all acts were directed for or to acquire the political power and thereby achieve the politically desirable results’. ] প্রশাসন, আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা কোনভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করেননি ।
১.৩ ধারায় কমিশন বলেন যে সমাজের এক বৃহত্তর অংশের নানুষ মনে করেন ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা দেশ ও জাতি, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার কাছে এক কলঙ্ক স্বরূপ। এটা মৌলিক অধিকারের উপর আঘাত। এর ফলেই পরবর্তীকালে দেশে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। [ ‘It was defacement of a country at the international for a, an act of violence against the very fundamental rights and against the concept of reasoned argument for political change. It was one of the worse abhorrent acts of religious intolerance in the history of nation and Hindu religion. The aftermath of demolition provoked communal riots all over the country which were witnessed with shock and disbelief. Various Commissions etc. were later appointment to go into the communal aspects of the riots.’]
কমিশনের মতে নিম্ন সংগঠনগুলি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য দায়ী :
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ভারতীয় জনতা দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, সন্ত সমাজ, ভারতীয় বিকাশ পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ, ভারতীয় মজদুর সংঘ, আদিবাসী কল্যাণ কেন্দ্র, ফিসারমেনস’ কো-অপারেটিভ সোসাইটি, বিবেকানন্দ মেডিকেল মিশন, অধ্যাপক পরিষদ, বিবেকানন্দ কেন্দ্র, দীন দয়াল শুদ্ধ সংস্থা, জনতা যুব মোর্চা, শিক্ষা ভারতী, হিন্দু স্বয়ং সেবক সংঘ, সরস্বতী শিশু মন্দির, বিদ্যা ভারতী, বানারসী কল্যাণ আশ্রম, বিজ্ঞান ভারতী, সংকল্প, সংস্কার ভারতী, শালাহকর পরিষদ।
কমিশনের মতে নিম্ন ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষভাবে বাবরি ধ্বংসের জন্য দায়ী :
বিনয় কাটিয়ার, লালু সিং, ব্রহ্মদত্ত দ্বিবেদী, সাক্ষী মহারাজ, শ্রীচন্দ্র দীক্ষিত, সূর্য কৃষণ, স্বামী চিন্মায়ানন্দ, স্বামী ভাম দেওজি, উমা ভারতী, বিজয়রাজ সিন্ধিয়া, উমানাথ সিং, অভয় রাম, আচার্য ধর্মেন্দ্রদেব, আচার্য গিরিজাকিশোর, অক্ষয়রাম দাস, অনিল কালিয়া, অনিল তিওয়ারি, অরবিন্দ কুমার, অশোক ধাওরা, অশোক সিংঘল, অবিদ্যানাথ, বৈকুণ্ঠলাল শর্মা, বি বি তোশনিভাল, চম্পত রাই, চরণ দাস, গোবিন্দ আচার্য, এইচ ভি শেষাদ্রি, ইন্দর সিং, জে ডি এন আগরওয়াল, জয় ভগবান গয়াল, জয় ভান সিং, কে এস সুদর্শন, কল্যাণ সিং, লালু সিং চৌহান, মোহন্ত নৃত্যগোপাল দাস, মোহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস, মাখু সিং, ওমপ্রকাশ, ওংকার ভাবা, প্রমোদ মহাজন, পবন গুপ্ত, রাজেন্দ্র গুপ্ত, রাম খাতরি, রামকৃষ্ণ অগ্নিহোত্রী, রামমুরত শরণ, সাধ্বী ঋতাম্বরা, সুরেশকুমার।
কমিশন মসজিদ ধ্বংসের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছিল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংকে। তিনি আর এস এস ও ভি এইচ পির মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন। অযোধ্যায় তিনি যে পুলিশ ও আমলাদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। এটাও পূর্বপরিকল্পিত –‘ Systematically and in a pre-planned manner removed inconvenient bureaucrats from positions of power , dismantled and diluted the security apparatus and infrastructure , lied consistently to the High Court and the Supreme Court of India and to the people of India to evade constitutional governance and thus betrayed the confidence of the electorate.’
বাবরি মসজিদ ধ্ংসের জন্য অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা যেমন করা হয়েছিল, তেমনি সেই পরিকল্পনাকে সার্থক করার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল।
সংঘ পরিবারের বিবিধ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছিল অর্থ –‘ As in evident from the evidence , in order to support the prerequisites for such a movement, the finances required were channeled from the coffers of the various Sangh Parivar organizations through various banks to accounts held in the names of various organizations and individuals to carry out the innumerable acts needed for the movements.’
যাঁদের নামে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তাঁরা হলেন : ওংকার ভাবে, মহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস, নৃত্যগোপাল দাস, গুর্জন সিং, নারদ শরণ, আচার্য গিরিজা কিশোর, বিষ্ণু হরি ডালমিয়া, নানা ভাগত, যসবন্ত রাই গুপ্ত, বি পি তোসনিওয়াল, সীতারাম আগরওয়াল, অশোক সিংঘল, রামেশ্বর দয়াল, প্রেমনাথ, চম্পত রাই, সূর্য কিষণ, যশোবন্ত ভাট, এ কে দাস শাস্ত্রী। রাম জন্মভূমি ন্যাসের সঙ্গে যুক্ত বহু সংগঠনের জন্যও অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল।
করসেবকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধ্বংসকার্যে শামিল হয়েছিল বলে যে মত প্রচার করা হয়েছিল, তা যথার্থ নয় বলে কমিশন মনে করে—‘ The mode of assault, the small number of karsevaks who carried out the demolition and the constraints of the space to accommodate the number of the people, veiling of the identity of the karsevaks entering the domes, the removal of the idols and the cash box from under the dome and the subsequent reinstallation in the make-shift temple, availability of instruments and material for demolition and for swift construction of the make-shift temple categorically leads to the conclusion and finding that the demolition was carried out with great painstaking preparation and preplanning.’
সংসদে এই রিপোর্ট পেশ হবার পরে তর্ক-বিতর্ক হয়। বিজেপি ও সংঘ পরিবার লিবেরহান কমিশনের রিপোর্টকে একদেশদর্শী বলে উল্লেখ করে।
বিজেপি রিপোর্ট ফাঁস হবার ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করে, ‘ This is a planned leak. It is motivated leak. The first motivation for leaking the report is the unity in opposition on the sugarcane price issue which the government wanted to break.’ আর এস এস ও ভি এইচ পি-ও এই রিপোর্টকে তীব্র সমালোচনা করে। আর এস এসের প্রধান কে সি সুদর্শন বলেন, করসেবকরা নয়, মসজিদ ভেঙেছে সরকারের লোকেরাই।
ভি এইচ পির নেতা প্রবীণ তোগোদিয়া বলেন, ‘ Reports like that of the Liberhan Commission come and go. But the Hindu culture which takes pride in its heritage and protects its places of worship, has been in place for ages and will remain so forever.
Any symbolic structure left by any invader in Akhand Bharat is a national shame. And the demolition of Babri mosque was the proudest moment for Hindus.’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৯
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৮
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৭
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৬
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct