ফৈয়াজ আহমেদ: আরব সাগরের কাছে এমন একটি দ্বীপ রয়েছে, যা এই পৃথিবীর অন্য দ্বীপগুলোর চেয়ে বেশ স্বতন্ত্র। এই দ্বীপে এমন সব বিচিত্র উদ্ভিদ আর প্রাণীর দেখা মেলে, যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এজন্য দ্বীপটি পৃথিবীর অদ্ভুত জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। আকারে খুব একটা বড় নয় এই দ্বীপ। দ্বীপের জনগোষ্ঠী বহু বছর যাবৎ এখানেই বসবাস করে আসছেন। এখানেই তাদের মূল শেকড় বলা যেতে পারে। (APONZONE TV আপনজন টিভি দেখুন)
দ্বীপটির নাম সোকোত্রা। দ্বীপটির ইয়েমেনের অংশ। দ্বীপটিতে স্থানীয় শত শত প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সুরক্ষা এবং সুরক্ষিত রাখার জন্য সোকোত্রাকে ২০০৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী এক স্থান হিসাবে মনোনীত করেছে। দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অনন্য।
সোকোত্রা, আব্দ আল কুরি, সামহা ও ডারসা- এই চারটি দ্বীপ মিলে তৈরি হয়েছে সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ। প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর আগে মূল আরব ভূখণ্ড থেকে দ্বীপপুঞ্জটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রকৃতির খেয়ালে এখানে কোনো পরিবর্তনের ছাপ পড়েনি। তার জেরেই এখনও টিকে রয়েছে অতি প্রাচীন হরেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী।
ইয়েমেনের মূল ভূখণ্ড থেকে ২২০ মাইল দূরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ। চারটি দ্বীপের মধ্যে সোকোত্রায় সবচেয়ে বৃহত্তম দ্বীপ। ৯৫ শতাংশ জলাভূমি তার অধিকারে রয়েছে। শুধুমাত্র এ দ্বীপেই জনবসতি রয়েছে। দৈর্ঘ্যে এই দ্বীপ ১৩২ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ৪৯.৭ কিলোমিটার। দ্বীপটি ইয়েমেনের অংশ হলেও সোমালিয়ার উপকূলের খুব কাছেই এটি অবস্থিত।
দ্বীপ জুড়ে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদের দেখা মেলে। দ্বীপের কোথাও ছাতার মতো গাছ, আবার কোথাও দেখা যায় খর্বাকৃতির গাছ। কোনো গাছ পাতাহীন, কিন্তু গাছের প্রতিটি ডালে ফুল ফুটে আছে। সোকোত্রা দ্বীপে ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩০৭টি প্রজাতিই স্থানীয়।
এখানকার প্রায় ৩৭ শতাংশ উদ্ভিদকে পৃথিবীর অন্য কোথাও জন্মাতে দেখা যায় না। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রজাতি আবার প্রায় দু কোটি বছর ধরে টিকে রয়েছে। গবেষকদের মতে, অত্যধিক জলাভাব এবং প্রখর তাপমাত্রার কারণেই গাছগুলো এমন অদ্ভুত দেখতে হয়েছে।
সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের এক বিস্ময়কর গাছের নাম ড্রাগন ব্লাড ট্রি। এই দ্বীপপুঞ্জের বাইরে আর কোথাও এ গাছ জন্মায় না। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মধ্যে গাছগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যের অংশবিশেষ। এ প্রজাতির গাছ ৬৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঁচে।
গাছের পাতার ওপরের অংশে সবুজ পাতার ঠাস বুনোট থাকার কারণে দূর থেকে গাছগুলোকে ছাতার মতো দেখায়। গাছগুলো খরাসহিষ্ণু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতে গাছগুলো জন্মে। এ গাছের বৃদ্ধি খুব ধীরে হয়। দশ বছরে মাত্র তিন ফুটের মতো বৃদ্ধি পায়। বর্ষার সময় সোকোত্রো দ্বীপপুঞ্জের আবহাওয়া স্যাঁতস্যাতে হয়ে পড়ে। তখন ড্রাগন ব্লাড ট্রি তার পাতার সাহায্যে বাতাসের জলীয় কণা শুষে নেয়। তারপর শিকড় এবং শাখা-প্রশাখার সাহায্যে তা গাছের সারা শরীরে পৌঁছে যায়।
এই গাছে টকটকে লাল রঙের একধরনের ফল হয়, যা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের গুঁড়ি থেকে ঘন লাল রঙের আঠা পাওয়া যায় যা আয়ুর্বেদিক ওষুধ এবং রং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গাছের এই লাল রস থেকেই স্থানীয়দের মুখে গাছটির নাম হয়ে যায় ড্রাগন ব্লাড ট্রি। গাছটি এতটাই জনপ্রিয় যে ইয়েমেনের মুদ্রায়ও এর ছবি খোদিত আছে। এ দ্বীপে একধরনের শসাগাছও হয়। এই গাছও ভীষণ অদ্ভুতুড়ে। ফুলে থাকা কাণ্ডটি মানুষের চেয়েও উঁচু।
দ্বীপে ৩৫ প্রজাতির প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়, যার মধ্যে ২৯টিই স্থানীয় সরীসৃপ এবং ছয় প্রজাতির স্থানীয় পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। এসব প্রাণীর জন্ম, বংশবৃদ্ধি এই দ্বীপেই। এখানকার স্থলশামুকের ৯৫ শতাংশই বিশ্বের কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না।
নানা প্রজাতির মাকড়শা, পাহীন টিকটিকি, তিন প্রজাতির কাঁকড়া যা এখানকার বিচিত্র প্রাণীজগত। মানুষ বাদ দিয়ে বাদুর প্রজাতির প্রাণীই দ্বীপটির একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে দ্বীপটিতে প্রচুর সরীসৃপ আছে। সরীসৃপগুলোর নব্বই শতাংশই এই দ্বীপের বাইরে কোথাও পাওয়া যায় না।
সোকোত্রা দ্বীপের এক বিষাক্ত প্রাণী ব্লু বেবুন স্পাইডার। এই মাকড়সার বর্ণিল রঙ এবং এর আচার আচরণ অন্যান্য মাকড়সার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্বীপটিতে কোনো উভচর প্রাণী নেই।
সৈকত এবং পাহাড় দ্বীপটিকে ঘিরে রয়েছে। দ্বীপ উপকূল জুড়ে বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত রয়েছে। সাদা বালির এই অপরূপ সৈকত আরব সাগর থেকে গার্ডাফুই চ্যানেল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সাদা বালির সৈকত এ অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। সৈকতের এই সাদা বালিয়ারির কারণে এই দ্বীপকে ভিনগ্রহের দ্বীপ হিসেবেও অনেকে অভিহিত করেন।
সমুদ্রে বিভিন্ন প্রজাতরি ডলফিন, তিমি এবং নানারকম মাছের দেখা মেলে। পাহাড় কিংবা সাদা বালির সৈকত থেকে আরব সাগরে ডলফিনদের এ খেলে বেড়ানো উপভোগ্য এক দৃশ্য।
এই দ্বীপেই বিশাল মরুভূমির পাশাপাশি ছোট ছোট পাহাড়ি এলাকা আর উপকূলীয় সমুদ্র সৈকত দ্বীপটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। দ্বীপের এক দর্শনীয় স্থান হাজহির পর্বতশ্রেণী। হাজহির পর্বতটি দ্বীপটির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী হাবিদু শহরের উত্তরে অবস্থিত। দ্বীপের প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে এই পর্বত বিস্তৃত। এই পাহাড়ের পাদদেশেই গড়ে উঠেছে এখানকার স্থানীয় জনগণের আবাসভূমি, গড়ে উঠেছে দ্বীপের প্রধান উপকূলীয় শহর।
এই গ্রানাইটের পাহাড়টির এক অদ্ভুত রং আছে। কাছাকাছি সমুদ্র সৈকত থেকে বাতাসে ভেসে আসা কুয়শা পাহাড়ের চারপাশে এক অদ্ভুত রহস্যময়তার আবরণ সৃষ্টি করে। এই দ্বীপের আরও একটি পাহাড় মাশানিগ। এটি সর্বোচ্চ পর্বতমালা যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উপরে অবস্থিত। অনেক পর্যটকেই হাইকিংয়ের জন্য এই পাহাড়টিকে বেছে নেন। দ্বীপের পাহাড় জুড়ে শত শত ছোট গুহা রয়েছে যা স্ট্যাল্যাক্টাইট এবং স্ট্যাল্যাগমাইটে ভরপুর।
এই দ্বীপজুড়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা এখানে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীনকালের বহু নিদর্শনের সন্ধান পেয়েছেন। এখনও দ্বীপের অনেক জায়গায় অনুসন্ধান চলছে। যদিও এসব নির্দশনের আর্থিক মূল্য তেমন না থাকলেও এর ঐতিহাসিক মূল্যে কোন অংশে কম নয়। সমুদ্রের উপর প্রাচীন এক পরিত্যক্ত দুর্গ রয়েছে যা অনেককাল আগের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এসব দুর্গ, খিলান দ্বীপটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
ভৌগলিকভাবে দ্বীপটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সারাবছরই এখানে হালকা বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষা মৌসুমে এই বৃষ্টিপাতের পরিমান বেড়ে যায়। এ সময় সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয়।
সোকোত্রায় বর্তমানে ছশোটি গ্রামে প্রায় ষাট হাজার মানুষ বসবাস করে। দক্ষিণ আরব জনগণের সাথে সোকোত্রা অঞ্চলের জনগণের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে দ্বীপ জুড়ে সোমালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম।
সোকোত্রার বাসিন্দারা অনেকটাই শান্তপ্রিয়। এখানকার অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। তাদের অধিকাংশ কৃষি এবং মৎস্যজীবী। মাছ ধরাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। খেজুর এবং মেষ পালন করে বাকিরা জীবিকা নির্বাহ করেন।
সোকোত্রা সত্যিই এই গ্রহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি। দ্বীপটিতে রয়েছে সমুদ্রসৈকত, বর্ণিল পাহাড়ের সারি আর রয়েছে অদ্ভুতুড়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান। ফ্লোরা এবং ফনার এক বৈচিত্রময় সমাহার এই দ্বীপ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct