ফৈয়াজ আহমেদ: মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভোগে বিশ্বের অনেক মানুষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২২ থেকে ৪৮ শতাংশ মানুষ এক মাসের ভেতর মেরুদণ্ডের কোনো না কোনো ব্যথায় (ঘাড়, পিঠ, কোমরব্যথা) ভোগে।
মেরুদণ্ড কেবল একটি হাড় নয়। অনেকগুলো ছোট ছোট হাড় বা কশেরুকার সমন্বয়। মাথা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে মেরুদণ্ডের উৎপত্তি। এর শেষ হয়েছে পশ্চাদ্দেশে। ঘাড়, পিঠ এবং কোমর—মেরুদণ্ডের এই তিন অংশ। মেরুদণ্ডের হাড়, দুই হাড়ের মাঝের ইন্টারভার্টিবাল ডিস্ক, লিগামেন্ট, মাংসপেশি, মেরুদণ্ডের মাঝে যে স্নায়ু আছে এই সবকিছুর কোনো না কোনো সমস্যার জন্য মেরুদণ্ডে ব্যথা হতে পারে। বেশির ভাগ মানুষেরই এ ব্যথার অভিজ্ঞতা আছে। পজিশনগত কারণে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে।
(আপনজন টিভি দেখতে এখানে ক্লিক করুন)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে ধরনের কাজ করতে হয়, সেখানে কাউকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয়, কাউকে অনেক ভারী জিনিস ওঠানামা করতে হয়। আবার কেউ কেউ খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত, অনেকের ঘুমানোর ভঙ্গিমা সঠিক নয়। এসব কারণে মেরুদণ্ডে ব্যথা হয়ে থাকে। এ ছাড়া মেরুদণ্ডে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ রোগও হতে পারে। কিছু রোগ আছে যেমন নার্ভাল বা সার্ভিক্যাল স্পন্ডিলাইটিস, ক্ষয়জনিত রোগ অস্টিওপোরোসিস—এসব রোগের কারণেও ব্যথা হয়। বাতের কারণে মেরুদণ্ডে ব্যথা হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। মেরুদণ্ডের ভেতরে ইন্টারভার্টিবাল ডিস্ক স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করলেও ব্যথা হয়।
অনেক বেশি বয়সী কারও মেরুদণ্ডে ব্যথা হলে তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পাশাপাশি হাত-পায়ের কোনো একটি অংশ অবশ হয়ে যাচ্ছে এবং প্রস্রাব–পায়খানার বেগ টের পাচ্ছে না এমন লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে সমস্যা বেশ গুরুতর। এ ছাড়া যদি কোনো রোগীর অতীতে ক্যানসার বা যক্ষ্মা রোগের ইতিহাস থাকে এবং ব্যথার সঙ্গে জ্বর হয়, তাহলেও সেটা মেরুদণ্ডের কোনো মারাত্মক রোগের লক্ষণ হিসেবে ধরে নিতে হবে। কখনো কখনো দেখা যায় তীব্র ব্যথা, কোনোভাবেই তা কমানো যাচ্ছে না। অথবা আঘাতের কারণে অতি তীব্র ব্যথা, বাতজনিত ব্যথার সঙ্গে গিরা ফুলে গেছে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ছাড়া অল্প ঝামেলাহীন ব্যথা ছয় সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে, তখনই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এ ধরনের ব্যথাগুলো সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হলে সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। একধরনের বাতের ব্যথাকে অ্যাঙ্কাইলসিং স্পন্ডিলাইটিস বলে। এটি মেরুদণ্ডে বেশি আক্রমণ করে। এ রোগ হলে কাজের সময় ব্যথা কম থাকে, বিশ্রামের সময় বেশি হয়। এর যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে মেরুদণ্ডের হাড় জোড়া লেগে শক্ত হয়ে যায়। তখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা যায় না। সাধারণত তরুণদের ভেতর এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। আবার কারও ক্যানসারের কারণে ব্যথা হলে সেটির চিকিৎসা না হলে হাড় ভেঙে যাওয়া থেকে শুরু করে একটি অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে। যক্ষ্মার ইনফেকশনে মেরুদণ্ডের ব্যথার ক্ষেত্রে হাড় বাঁকা, কুঁজো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ক্ষয়ের কারণে ব্যথার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চলাচলে সমস্যা হয়। নার্ভের কারণে ব্যথা হলে স্থায়ীভাবে শরীর অবশ হয়ে চলাফেরা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে মেরুদণ্ডের যেকোনো ব্যথার সঠিক নির্ণয় ও চিকিৎসা করতে পারলে স্বাভাবিক ব্যথাহীন জীবনযাপন করা সম্ভব।
ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে নানা রকমের ব্যথানাশক আছে। এর ভেতর যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তাদের ইটোরিক্স, যাদের কিডনিতে সমস্যা আছে, তাদের অল্প মাত্রায় নাবুমেট, হার্টের রোগীদের ন্যাপরোক্সজাতীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়। যাদের আঘাতের বা পজিশনের কারণে ব্যথা হয়, তাদের ব্যথানাশকের পাশাপাশি মাসল রিলাক্সজেন্ট দেওয়া হয়। ‘প্রথম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যথানাশক দিয়ে করতে হয়। পরে ব্যথার উৎপত্তি যে রোগের জন্য হয়, তার চিকিৎসা করা হয়। এ রোগ সেরে গেলে সব ধরনের ব্যথা এমনিতেই কমে যাবে।’
মেরুদণ্ডের ব্যথার কারণ নির্ণয়ের সময় রোগীর ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। তার বয়স, পেশা, ভারী জিনিস ওঠানোর ইতিহাস, অতীত ও বর্তমানের কোনো রোগ ইত্যাদি সম্পর্কে জানা হয়। এ ছাড়া চিকিৎসকেরা রক্তের সিবিসি সিআরপি, এক্স–রে, এমআরআই, বায়োপসি ইত্যাদি পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে থাকেন।
মেরুদণ্ডের ব্যথা প্রতিরোধের জন্য জীবনযাপন পদ্ধতিতে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে সঠিক পজিশনে দাঁড়াতে এবং বসতে হবে। মেরুদণ্ড একদম সোজা করে।
একটানা বেশিক্ষণ বসে বা না দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টা পরপর পাঁচ মিনিটের জন্য হাঁটাহাঁটি করতে হবে। ঘুমের ভেতর বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। কোনো ভারী জিনিস ওঠাতে গেলে সেটাও মেরুদণ্ড সোজা রেখে ওঠাতে হবে। যে ভর আমরা বহন করতে পারি, তার চেয়ে বেশি মাত্রার কিছুই বহন করা যাবে না। মেরুদণ্ডের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নজর দিতে হবে ঘুমানোর ম্যাট্রেসের ওপর। এটি খুব নরম বা শক্ত কোনোটাই হওয়া যাবে না, এমনটা পরামর্শ দেন ডাক্তারবাবুরা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct