জয়প্রকাশ কুইরি, পুরুলিয়া: পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহল সহ পার্শ্ববর্তী ঝাড়খন্ড ও ওড়িষ্যা রাজ্যের শ্রেষ্ঠ লোক উৎসব হল করম। এই উৎসব কুমারী মেয়েরা ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীর দিন পালন করেন। উৎসবের নয় ,সাত, পাঁচ বা তিনদিন পূর্বে কুমারী মেয়েরা নদী বা স্থানীয় কোন জলাশয় থেকে বালি ভর্তি ডালাতে প্রায় নয় ধরনের বীজ রোপন করে পুজো আরাম্ভ করেন। প্রতিদিনই পুজোর আখাড়াতে সেই বালি ভর্তি ডালা রেখে দিয়ে গানের মাধ্যমে করম পুজো ও নাচ করে থাকেন মেয়েরা। বালি ভর্তি ডালাকে আঞ্চলিক ভাষায় জাওয়া ডালি বলা হয়ে থাকে। জাওয়া কথার অর্থ হলো জন্ম বা বীচের অঙ্কুরোদগম। এই উৎসব কবে শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন তবে বিশিষ্ট পন্ডিত বর্গের মতে কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার। সেই হিসেবে বলতে পারা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে গ্রাম স্থাপন হয়েছিল। করম উপলক্ষে যে করম ডালকে আখড়াতে পোতা হয় তা থেকে অনুমান করা যায় এই সময় সীমার মধ্যে কৃষি সভ্যতার যে সূচনা হয়েছিল সেই সময়ের মধ্যে করম পরবের উৎপত্তি হয়েছিল। এই উৎসবের জন্য পৌরোহিত্য করেন গ্রামের লায়া বা কোন বয়স্ক ব্যক্তি।এছাড়া করমা ও ধরমা নামে যে লোক কাহিনী প্রচলন আছে তা উপবাসী কুমারী মেয়েদের একাগ্রহ চিত্রে শোনার জন্য আহ্বান করেন পূজারী ,মেয়েরা তা শুনেও থাকে। কাহিনীর মাধ্যমে লায়া বা পূজারী মেয়েদের সামাজিক ও সাংসারিক জীবনের নানার বিবিধ বিষয় গুলি ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেন। জানা যায় এই পুজোতে কোন রূপ মন্ত্র উচ্চারণ হয় না অন্যদিকে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতের প্রয়াজন হয় না।
আর এর থেকেই অনুমিত হয় ভারতে বৈদিক ধর্ম প্রচলিত হওয়ার বহু পূর্বে এই এলাকাতে করম পরবের প্রচলন ছিল। যার কোন রূপ ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখ নেই। কিন্তু ১০০০ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে যখন ভবিষ্য পুরান রচিত হল তখন পণ্ডিতগণ করম উৎসবের লোক কাহিনীকে বিকৃত রূপে স্থান দিয়েছেন।তাছাড়াও “জাহুই জাহুই করম রাজা, এহোই ছয়মাস আউত ভাদর মাস আনবো ঘুরাই “ গানটির মাধ্যমে করম পরবে প্রাচীনত্ব জানা যায়। কারণ যখন ঋতু চক্রের বর্ষ গণনা হতো তখন থেকে করম পরবের উৎপত্তি হয়েছিল তা প্রমাণ হয়। কৃষি কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্যে হল মেয়েদের ভাইয়ের প্রতি মঙ্গল কামনা করা ও দীর্ঘায়ু লাভ করা। সুখে, দুঃখে, বিপদে, আপদে একে ওপরের পাশে দাঁড়ানো। প্রশ্ন উঠতেও পারে মেয়েরা করম গাছ উপস্য রূপে কেন গ্রহণ করেন। বলা যায় করম এমন একটি গাছ যাকে কোন কীট পতঙ্গ আক্রান্ত করে নষ্ট করতে পারে না। সেই মতো মেয়েরা সেই গাছকে সাক্ষী রেখে তাদের তদ্রুপ ভাবী স্বামীর কামনার প্রতীক রূপে মেনে থাকেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct