সঞ্জীব মল্লিক, বাঁকুড়া: বালুচরী নামের মধ্যেই রয়েছে আভিজাত্য। প্রতিটি শাড়ি যেন কথা বলে। প্রতিটি সুতোর টানে যেন নিজস্ব একটা কথন আছে। কোথাও ফুটে উঠেছে টেরাকোটার কারুকাজ। কোথাও মহাভারতের গল্প। কোথাও আবার আদিবাসী নৃত্য।
বাঙালির শাড়ির সম্ভারে বছরের পর বছর ধরে স্বমহিমায় বিরাজমান বালুচরী। নবাবী এই শাড়িগুলি কোনওটি তৈরি করতে সময় লাগে এক মাস। কোনওটি আবার পনেরো দিন। এক একটা শাড়ির দাম ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা। বালুচরীর ইতিহাস বলতে, এটি শুরু হয়েছিল মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ সংলগ্ন বালুচর নামে কোনও এক এলাকায়। অনেক নথি আবার বলছে, জিয়াগঞ্জেরই পূর্বনাম ছিল বালুচর। সেই বালুচর নাম থেকেই এসেছে বালুচরী। শিল্পীদের কাছে বালুচরীর বয়ন এক সাধনার মতো। সেই সময় নবাবরা তাঁদের বেগমদের জন্য শাড়ি বানাতেন বালুচরের শিল্পীদের দিয়ে। বিদেশের বাজারেও কদর বাড়ছে মল্লগড়ের বালুচরীর কালক্রমে গঙ্গাগর্ভে হারিয়ে যায় এই বালুচর প্রদেশ। এরপর কালের নিয়মে হারিয়ে যায় বালুচরী শাড়ি। মাঝে পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। দীর্ঘদিন পর এর কিছু নকশা শুভ ঠাকুরের হাত ধরে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত কারুকার্য শিল্পী অক্ষয়দাস পাঠরাঙার হাতে আসে। তার পর বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পৃষ্টপোষকতায় বালুচরী শিল্পের নবজাগরণ ঘটে।
সেই আভিজাত্যকে বজায় রেখে পূজোর সম্ভারে আবারও সেজে উঠেছে বালুচরী। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও অভিনবত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন বর্তমান প্রজন্মের বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত বালুচরী শিল্পী অমিতাভ পাল। এবারে তার নতুন ডিজাইনের শাড়ির নাম রেখেছেন কারুকলা। এই অতিমারী পরিস্থিতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলার হস্ত শিল্প গুলি, সেই শিল্প গুলি সুতোর বয়নে বালুচরীতে স্থান দিয়ে নামকরন এই কারুকলা। জেলার ছয়টি হস্ত শিল্প যথা ডোকরা, হ্যান্ডলুম গামছা, লন্ঠন, টেরাকোটা, শাঁখ এবং হাতে গড়া বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দশাবতার তাসকে ফুটিয়ে তুলেছেন। গত দেড় দশক ধরে অমিতাভ বাবু বালুচরীর অভিনবত্ব এনে চলেছেন, এবারে তার শিল্প সত্ত্বায় মানবিকতা ভর করেছে। তিনি বলেছেন, “মুখ থুবড়ে পড়া হস্ত শিল্প গুলো যাতে প্রান পায় তারই চেষ্টা তিনি করেছেন”। এই কারুকলার বাজার দর ১৮ হাজার টাকা রাখা হয়েছে, ইতিমধ্যেই ১৭টি শাড়ির বরাত তিনি পেয়েছেন।
ইতিমধ্যেই মল্লগড়ের এই বালুচরী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়িয়ে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে, চাহিদাও আছে বর্তমান বাজারে। এই নবাবী শাড়ির ব্যাপ্তি যদি যাতে আরো সুদীর্ঘ হয় এই আশায় বুক বাঁধছেন শিল্পীরা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct