মাহমুদুল হাসান: টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে- ফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া।
সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বেশি। ডিজিটাল আসক্তি যেন এখন ডিজিটাল আগ্রাসনের নাম, যাকে রুখতে না পারলে আমাদের আগামী প্রজন্ম আলোর দিশা হারিয়ে ফেলবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সি অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না।
গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি আমেরিকার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কিশোরীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেম খেলে।
৫০ শতাংশ কিশোর স্বীকার করেছে, তারা তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বোধ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখে যাচ্ছে, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস-টু-ফেস ইন্টার-অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস তার সন্তানদের নিজের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। তিনি একবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের যে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’
ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধপ্রবণতা, উদ্বেগ, একাকী থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধত্ব, নিয়মিত স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিঅ্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয়, এমনকি এক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিও নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। অনুরূপভাবে শারীরিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, তাদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, পিঠে ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, দুর্বলতা, কার্পাল টানেল সিনড্রোম, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, চোখের শুষ্কতা, অন্যান্য দৃষ্টি সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন হ্রাস বা স্থূলত্বসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ শরীরে দানা বাঁধতে থাকে।
এ মানসিক ও শারীরিক প্রভাবগুলোর পাশাপাশি ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ক্ষতিও হয়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে ওঠে, কারও সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগাযোগ রাখতে চায় না, আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলতে চায় না ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। মোটকথা, ডিজিটাল আসক্তি শিক্ষার্থীদের জীবনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। লেখাপড়া ঠিকমতো না করে অনেক ক্ষেত্রে বখাটে জীবনযাপন করে এবং পরিণত হয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যে। তখন সমাজে অনাচার, অত্যাচার, নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি। ফলে পিতা-মাতার কাছে আদরের সন্তানেরা তখন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct