সুলেখা নাজনিন: আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। রাজ্যের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের অধীনস্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অবশ্য সংখ্যালঘু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। স্বভাবতই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি রাজ্যের সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটা বিশেষ ভাবাবেগ জড়িত আছে। তাই আম জনতা থেকে বিশিষ্ট মুসলিমরা তিনি রাজনীতিক বা বুদ্ধিজীবী বা অন্য পেশার মানুষ যেই হোক না কেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।
এ প্রসঙ্গে প্রথমে সবচেয়ে বহুল চর্চিত যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হল রাজ্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ টাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছে না। অথবা, বাজেট বরাদ্দ টাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পেলেও তা খরচ করতে পারছে না।
যেহেতু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের প্রধান কারিগর উপাচার্য। তাই তার ভূমিকার উপরই অনেকটাই বাঁচা মরা নির্ভর করে। সেজন্য বর্তমান উপাচার্য মুহাম্মদ আলি ও বরাদ্দ অর্থ নিয়ে যত চর্চা। কেউ বলছেন তাকে সরানো হোক, কেউ বলছেন তাকে রাখা হোক। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন আলোচনার টেবিলে এখন অন্যতম আলোচনার বিষয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো ও অন্যান্য বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে এক উপাচার্য আসবেন, আর এক উপাচার্য বিদায় নেবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ কালে কতটা উন্নতি হল তা নিয়ে কোনও মূল্যায়ণ হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি স্লথ হয়ে যাওয়ার দায় কিন্তু উপাচার্য এড়িযে যেতে পারেন না। তেমনি কোন পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি তার দিশা দেখাতে না পারাটা ব্যর্থতার পরিচয়। শুধু পদ আঁকড়ে থাকলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কারও দোষে বিভিন্ন বিভাগের সাফল্য বা অগ্রগতি না হলে তার নৈতিক দায় উপাচার্যের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। তার মানেই তাকেই শুধু কাঠগড়ায় তোলাটা সমীচীন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন তারা সবাই কিন্তু দায়ী, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাই কাউকেই দায়ী করার প্রবণতা দূরে ঠেলে দিয়ে কী করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য ভাবা দরকার।
এখন দুটি প্রশ্নে উঠতে শুরু করেছে। একটি হল বাজেট বরাদ্দ টাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে কিনা। আর একটি দিক হল উপাচার্য হিসাবে এই কয়েক বছরে তার সক্রিয়তার মূল্যায়ণ করা দরকার। তবে, একটা বিষয় পরিষ্কার কার দোষ বড় কথা নয়, কেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিতে ভাটা তার পর্যালোচনা প্রয়োজন। মূলত রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতর ও উপাচার্য এই মেলবন্ধনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। তার জন্য ভুগতে হবে সমগ্র সংখ্যালঘু সমাজকে।
দিন কয়েক আগে এ বিষয়ে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তরফ থেকে অভিযোগ জানানো হয়েছে, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ বর্ষে বাজেট বরাদ্দ টাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বঞ্চিত। কিন্তু তার আগের অর্থবর্ষের তহবিল নিয়ে কিন্তু তেমন উচ্চবাচ্য নেই। এটা অস্বীকার করা যাবে না, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ বর্ষের কোটি কোটি টাকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করতে পারেনি। বাস্তব সত্য হল বিভিন্ন দফতরের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
এই ব্যর্থতার জন্য আমরা সাধারণ মানুষও দায় এগোতে পারি না। এতদিন কিন্তু আমরা তেমন কোনও খোঁজ নিইনি সংখ্যালঘু দফতর কত টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিল, অার তা খরচ হল কিনা। কিংবা যতটা প্রাপ্য তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নজর শুধু উপাচার্য আর সংখ্যালঘু দফতর কেন্দ্রিক। অথচ, আগের উপাচার্য বিদায় নেওয়ার পর যখন নতুন উপাচার্য দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তারপর কোনও মূল্যায়ণ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কত কোর্স বৃদ্ধি পেল, কিংবা পরিকাঠামোগত কি উন্নতি হল সেসবের যেমন আমরা খোঁজ নিইনি তেমনি মেডিক্যাল কলেজ করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার অগ্রগতি কত দূর তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। যে শিক্ষকদের তরফ থেকে বাজেট বরাদ্দ টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আনা
হল, তাদের আর্জিতে একবারও জানানো হয়নি বিভিন্ন বিভাগ থেকে কত টাকা ফেরত গেছে সরকারের কাছে। আর তার কারণটাই বা কি।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে চলাটা সংখ্যালঘুদের অধিকার। এর পথ চলার প্রতিবন্ধকতার জন্য যারা দায়ী তাদের কিন্তু সমাজ ক্ষমা করবে না ঠিকই, মন্থর গতির জন্য দায়ী কারা সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা যখন দেখি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাসে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়ার জন্য নোটিশ আসছে, তখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়। বাজেট বরাদ্দ টাকা না এলে প্রতিবাদে গর্জে উঠি। কিন্তু টাকা খরচ করতে না পেরে তা ফেরত পাঠানোর কোনও কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি না। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ বর্ষে রাজ্য বাজেট টাকা না রিলিজ করায় সংখ্যালঘু দফতরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মধ্যে নানা মন্তব্য, মতামত সামনে আসছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকের ধারণা, এই দাবি তোলার লক্ষ্য উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া। ভাবা উচিত রাজ্যের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যবহার করতে না পারায় ফেরত পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে? এমনকী প্রথম উপাচার্য সৈয়দ শামসুল আলম কিংবা আবু তালেব খানে উপাচার্য থাককালীন এভাবে টাকা ফেরত যাওয়ার তেমন অভিযোগ ওঠেনি। তাই বর্তমানে অর্থ কাজে না লাগানোর অভিযোগ উঠবে কেন এই প্রশ্নটা এখন তোলা হচ্ছে।
অথচ পরিসংখ্যান তুলে ধরলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে যেকোনও কারণেই হোক বর্তমান উপাচার্যের সময় অর্থ ফেরত গেছে। সূত্রে জানা গেছে, অালিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আদার গ্রান্টে’ পাওয়া অর্থের মধ্যে ম্যাথমেটিকস বিভাগের জন্য ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট দেওয়া হয়েছিল ৯ কোটি ৯৮ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা।
কিন্তু পুরো টাকাটাই ব্যবহার না করতে পারায় ফেরত দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে, নিদির্ষ্ট বিভাগের কাজে অর্থ ব্যবহার করতে না পারায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ৭ কোটি ৯৫ লক্ষা টাকা, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশনের জন্য ৮ কোটি ২১ লক্ষ টাকা, কেমিস্ট্রি বিভাগের সরঞ্জাম কেনার জন্য ৭ কোটি ১১ লক্ষ টাকা, বায়োলজিক্যাল বিভাগের সরঞ্জাম কেনার জন্য ৮ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা, বাংলা বিভাগের বিভিন্ন খাতে ব্যবহারের জন্য ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা, এমবিএ, ল ও ইকনোমিকস বিভাগের ল্যাবরেটরির জন্য ৫ কোটি টাকা, কম্পিউটার সায়েন্সের সরঞ্জাম কেনার জন্য তিন কোটি টাকা, কমন ল্যাবরেটরি ও তার সরঞ্জামের জন্য ৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে যেগুলি ২০২১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ বর্ষে দেয়া হয়েছিল। এই বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করতে না পারার বিষয়টি কিন্তু নজরে এসেছে এজি বেঙ্গলের। এ ব্যাপারে এজি বেঙ্গলের অ্যাকাউন্ট বিভাগ থেকে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর এক চিঠিতে সংখ্যালঘু দফতরের অতিরিক্ত সচিবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ২০১৮-১৯ বর্ষে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যে ৩৪০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা ফেরত দিয়েছে তার কারণ সমূহ বর্ণনা করতে। তাই বাজেট বরাদ্দ টাকা যেমন পাওয়া আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার তেমনি বরাদ্দকৃত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে নির্দিষ্ট অর্থবর্ষের মধ্যে খরচ করাটাও রাজ্যের সংখ্যালঘুদের অধিকার। বিগত অর্থ বর্ষের অর্থ খরচ করতে না পারার ব্যর্থতায় যদি আগামী বাজেটে আলিয়ার জন্য বরাদ্দ কম করে দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু কিছু বলার থাকবে না। তাই যারাই আমরা দোষ খোঁজার চেষ্টা করছি সংখ্যালঘু দফতর কিংবা উপাচার্যের মধ্যে সেসব পরিত্যাগ করে বরং পথ বের করা দরকার কীভাবে বরাদ্দ কৃত অর্থ আলিয়ার জন্য পুরোপুরি ব্যবহার করা যায়।
নির্দিষ্ট অর্থ বর্ষে খরচ করার প্রতিবন্ধকতা কি তা নির্বাচন করে এগিয়ে চলা দরকার। মেডিক্যাল কলেজ গড়ার জন্য সরকারের কাছে অর্থ চাইলে তারা আঙুল তুলবে খরচ করতে না পারার দিকে। অন্যদিকে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল কলেজ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হযেছিল বর্তমান সমস্যার কারণে সেই মেডিক্যাল কলেজ গড়ার কাজ বিশ বাঁও জলে। এখন আর মেডিক্যাল কলেজ গড়ার ব্যাপারে আর সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যতটা আমরা আলিয়ার অর্থ বরাদ্দে কিংবা বঞ্চনা নিয়ে সোচ্চার ততটা সোচ্চার নই অধ্যাপকের সংখ্যা বাড়ানো, পরিকাঠামো বাড়ানো, নতুন নতুন কোর্স বাড়ানো, যেসব মাদ্রাসায় আলিয়ার স্টাডি সেন্টার রয়েছে তাদেরকে উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে। বুঝতে হবে আলিয়াকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে উৎকর্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তার জন্য উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি।
আর সঠিকভাবে চলতে না পারলে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্চ শিক্ষা দফতরের অধীনে নিয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন হা হুতাশই করতে হবে।
এ ব্যাপারে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ আলির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ফোন সুইসড অফ থাকায় মতামত পাওয়া যায়নি। অপরদিকে সংখ্যালঘু দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত সচিব জি এইচ ওবায়দুর রহমান বলেন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কী করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার প্রচেষ্টা চালনো হচ্ছে। তবে, বাজেট বরাদ্দ বা ফেরত অর্থ কিংবা উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct