এসএম শামসুদ্দিন: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয় বার রাজ্যে ক্ষমতায় তৃণমূল সরকার। বিগত সরকারে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজের অধীনে রেখে রাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন গিয়াসুদ্দিন মোল্লাকে। এবারে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের পূর্ণ মন্ত্রী করেছেন গোলাম রব্বানীকে। উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে হয়েছেন পূর্ণ মন্ত্রী। ২০১৬ সালে তিনি তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়ে হয়েছিলেন শ্রম দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ। পেশায় উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম রব্বানী অবশেষে রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের স্বাধীন মন্ত্রী।
স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের নানান অসম্পূর্ণ বিষয়কে সম্পূর্ণ করতে তিনি সদর্থক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে আশা। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন শাখার সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে দেখা করছেন। অভাব অভিযোগ শুনছেন। নানান বিষয়ে সমস্যা ও জটিলতা জানার চেষ্টা করছেন। সেটা খুবই সদর্থক দিক নিঃসন্দেহে। কিন্তু সমস্যা জেনে সমাধানে আন্তরিক সচেষ্ট হবেন বলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের আশা নিয়ে রয়েছেন।
রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক নানান সমস্যা নতুন নয় বরং দেওয়ালে পিঠ ঠেকার মতোই অবস্থা থেকে উন্নয়নের শুরু। বিশেষ করে দীর্ঘ ৩৪ বছর বামশাসকগণ সূক্ষ্ম সুপ্তভাবে সম্প্রদায়কে অবহেলার চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল। বঞ্চনার রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে ‘সাচার কমিটির’ রিপোর্টে সেই জ্বলন্ত তথ্যভিত্তিক উদহারণ সারা ভারতের সমস্ত রাজ্যকে পিছনে ফেলে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। ২০১১ সালে নির্বাচনে তার প্রভাব পড়ে। রাজ্যে শাসন পরিবর্তনে সহায়ক হয়ে সংখ্যালঘুদের সেই করুণ পরিস্থিতির রিপোর্ট। তাই তারা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শামিল হয়ে শাসক পরিবর্তনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। বাম সরকারের শাসনে সম্প্রদায়ের অভাব অভিযোগ প্রয়োজন তুলে ধরলেই প্রায়শই মৌলবাদী বলে তকমা সেঁটে দেওয়া হত। এমনকি এই সমস্ত বাম মুসলিম নেতৃত্ব এই সম্প্রদায়ের প্রয়োজনের কথা বলতে পারতেন না। এখনও যে শাসক দলের বিধায়করা তা বরতে পারেন তা নয়, তবে তাদের দাবি বা অধিকারের কথাকে সাম্প্রদায়িক তকমা দেয় না, এটা বাস্তব। মমতা বন্দোপাধ্যায় রাজ্যের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিকাশে নানান পরিকল্পনা করেছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চাদপদ শ্রেণির কল্যাণে ১০ শতাংশ ওবিসি-এ ও ৭ শতাংশ ওবিসি-বি সংরক্ষণের জন্য বিধানসভায় আইন পাশ করেছেন। এক পদক্ষেপ বঞ্চনার অনেকটাই রূপ পাল্টে দিচ্ছে।
কিন্তু দুঃখ ও বেদনার বিষয় যে পশ্চিমবাংলার ২৩ টি জেলায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার বাংলার মুসলমানদের প্রতিনিধি থাকলেও তাঁদের সমস্যা প্রয়োজন সঠিক ভাবে সরকারকে উপস্থাপন করতে পারেননি। সরকার আন্তরিকভাবে উন্নয়নে সচেষ্ট হলেও প্রকৃত সমস্যা, জটিলতা ও প্রয়োজনের কথা সরকারকে বোঝাতে পারেনি বা ভাবতে পারেননি।
সরকারের বা আধিকারিকদের তৈল মর্দন করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধিতে মগ্ন থেকেছেন বেশকিছু তথাকথিত সংখ্যালঘু নেতা। সামগ্রিক সম্প্রদায়ের সমস্যার সমাধানে যতটা না ভাবিত তদপেক্ষা নিজেদের প্রচারের আলোয় এনে নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে বা নিজেদের সরকারের দৃষ্টিআকর্ষণে অধিক সচেষ্ট ও যত্নশীল হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলে সমস্যার গভীরে প্রবেশকরে সমাধানের সঠিক দিশা বা প্রস্তাব দিতে ব্যর্থ। ফলে সমস্যা থেকে গেছে সমস্যাতেই।
রাজ্যের নবনিযুক্ত সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী গোলাম রব্বানী সজ্জন ও সুশিক্ষিত ব্যক্তি। নিশ্চিত রূপে রাজ্যের সম্প্রদায়ের মানুষ জটিল ও সমস্যাসংকুল অবস্থার সমাধানে আন্তরিক সচেষ্ট হবেন এবং প্রকৃত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে সমাধানে সচেষ্ট হবেন বলে সম্প্রদায়ের সচেতন উন্নয়নকামী মানুষ মনে করেন। সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের আওতায় রাজ্যে ৬১৪টি মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে সিনিয়র ও হাই মাদ্রাসা ও এম এস এক বা মাদ্রাসা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। প্রথমত, বিগত ২০০২ সালের পর থেকে নতুন কোনও মাদ্রাসা সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়নি। জনসংখ্যা বাড়লেও প্রয়োজন থাকলেও এ বিষয়ে কোনো ভাবনা ভাবা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, এই সমস্ত মাদ্রাসার অধিকাংশতেই হেডমাস্টার নেই। টিআইসি ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাবে সহ শিক্ষক কেউ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্লার্ক, পিওন নিয়োগ হয়নি বামশাসন কাল থেকেই। ক্রমশ এক ভয়ঙ্কর গয়ংগচ্ছ ভাবে চলছে মাদ্রাসাগুলি।
দীর্ঘকাল শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। যেসমস্ত মাদ্রাসায় বিজ্ঞান আছে সেখানে ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা জরুরি। যদিও শোনা যাচ্ছে কোটি টাকা করে ল্যাবরেটরির জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত,স্বাধীন স্বশাসিত মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের ভূমিকা ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দরকার। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদকে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে মনোনীত নয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা একান্ত আবশ্যক। এভাবে হয়তো মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন হবে কিন্তু প্রথাগত শিক্ষার তেমন উন্নতি হবে না। অথট, রাজ্যের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু মানুষ প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করে থাকে। সেক্ষেত্রে মাদ্রাসা ব্যতিরেকে সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সংবিধানের ৩০ ধারার অধিকার উপলব্ধ হওয়া দরকার। রাজ্যের খ্রিস্টান, শিখ সংখ্যালঘু পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সংবিধানের ৩০ ধারার সুবিধা পেলেও মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পায় না। অাশা করা যায় এবার সেই অধিকার পাবে। তবেই হবে স্বাধীন সংখ্যালঘু মন্ত্রী পাওয়ার সার্থকতা।
লেখক সমাজকর্মী ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct