মনিরুদ্দিন খান: সাধারণত মুসলিম নামে পদবির কোনো গুরুত্ব নেই। তবু বাঙালি মুসলিমদের নামের পদবি নিয়ে বিভ্রাট এক অতি পরিচিত ঘটনা। এ নিয়ে সমস্যাও কম হয় না। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের যে একটি বড় অংশকে সরকারিভাবে ‘অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণি’- র তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেই তালিকাভুক্তি হয়েছে মূলত পদবিকে ভিত্তি করে। কিন্তু মুসলিমদের বেশিরভাগই নামে পদবি ব্যবহার না করায় সেই ‘অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণি’-র জন্য যে সুবিধা তা আদায় করার শংসাপত্র যোগাড় করতে পারেনি। আর পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামে তো এই নাম-পদবির অমিলের ফলে অনেককেই বে-নাগরিক করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পদবির ব্যাপারে মুসলিমরা যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন নয়।
যেহেতু মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কোনো ক্ষেত্রেই বংশ বা গোত্র আলাদাভাবে কোনো গুরুত্ব বহন করে না, তাই তাদের নামের সঙ্গে পদবির কোনো গুরুত্ব থাকে না। কেউ লেখেন, কেউ লেখেন না। অথচ মুসলিম নামের এই পদবি নিয়ে অমুসলিম তো বটেই মুসলিমদের নিজেদের মধ্যেও নানা বিভ্রান্তি। নামের শেষের অংশ মানে সেটাই পদবি - এই ধারণা বহু মুসলিমও পোষণ করেন। আসলে মুসলিমদের আরবী/উর্দু নামের অর্থ বেশিরভাগ অমুসলিম এবং মুসলিমরা নিজেরাও বোঝেন না। তাই এই বিভ্রান্তি। আবার পদবি মানেই যে সেটা নামের শেষে থাকবে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেও কিছুটা বিভ্রাট চলে আসে। কিন্তু পদবি নামের প্রথমেও অনেকেই লেখেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এর নামের শেষে পদবি, কিন্তু সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ-র নামের প্রথমে পদবি। অবশ্য নামের প্রথমে পদবি লেখাটা ব্যতিক্রম হিসাবেই ধরা হয়। তবু এমনটা লেখা যেতেই পারে এবং লেখা হয়ও। বিশেষত ‘সৈয়দ’ পদবিটি সাধারণত নামের প্রথমেই লেখার প্রচলন বেশি। মহম্মদ (সংক্ষেপে মহঃ লেখে অনেকেই) রফিকুল ইসলাম-এর এক ছেলের নাম আব্দুল হক, অন্য ছেলের নাম মূনীরুদ্দীন আহমেদ, মেয়ের নাম জান্নাতুন খাতুন। এইরকম ক্ষেত্রে একজন অমুসলিম প্রায়শ বলে থাকেন, ‘কী জানি বাবা! কী সব নাম! এদের নাম-পদবির কোনো ঠিক ঠিকানা নেই! বাপ, ছেলে, মেয়ে- সবার পদবি আলাদা আলাদা! এ আবার হয় নাকি!”
আবার একজন শিক্ষিত মুসলিমও তার এই বিষয়ে অজ্ঞানতাকে ঢাকতে বলেন, ‘কেন? বাপের নামে ইসলাম আছে মানে ওটাই ‘টাইটেল। আমাদের ধর্মে টাইটেলের গুরুত্ব নেই, তাই ইসলাম সাহেবের ছেলে-মেয়েরা তাদের নামে টাইটেল লেখেনি।’ কিন্তু বিষয়টি আদৌ তেমন নয়। এক্ষেত্রে বাপ-বেটা-বেটি কারোর নামেই টাইটেল অর্থাৎ পদবি ব্যবহার হয়নি। এই আরবী, উর্দু, ফার্সি বা তুর্কি ভাষা মিশ্রিত নামগুলির অর্থ বুঝলেই সেটা বোঝা যাবে। ‘রফিক’ ( বন্ধু) - ‘উল’ (র বা এর, ইংরেজি of) - ইসলাম (শান্তি বা শান্তির ধর্ম)। তাহলে ‘রফিকুল ইসলাম’ - এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ইসলাম বা শান্তির বন্ধু’। ‘আবদ ্’ (দাস/চাকর) - ‘উল’ (র/এর) - ‘হক’ (সত্য)। সুতরাং, ‘আব্দুল হক’ অর্থে ‘সত্যের দাস/ চাকর’ বোঝানো হয়।
বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এমন “সত্যদাস” বা “ভগবানদাস “ প্রায়শঃ দেখা যায়। ‘মূনীর’ (দীপ/ প্রদীপ) - ‘উদ’ ( র/এর) - ‘দ্বীন’ ( ন্যায়-ধর্ম)- ‘আহমেদ/ আহম্মদ’ (নবী হজরত মহম্মদের অপর নাম)। সব শব্দগুলিকে সন্ধি ও সমাসবদ্ধ করে এখানে পূর্ণ নাম ‘মূনীরুদ্দীন আহমেদ’ -এর অর্থ হয় ‘হজরত মহম্মদের ধর্মের প্রদীপ/দীপ’। একইভাবে ‘জান্নাত’ (স্বর্গ) -’উন’ (র/এর) - ‘খাতুন’ (নেত্রী)। অর্থাৎ ‘জান্নাতুন খাতুন’ মানে ‘স্বর্গের নেত্রী’। উল্লেখ্য যে বাংলা র/এর (ইংরেজি of) - এই সম্বন্ধসূচক শব্দটি আরবি রীতিতে পূর্বপদ অনুযায়ী ‘উল’, ‘উদ’ ‘উন’ ইত্যাদি নানা রূপ পরিগ্রহ করে।
(ক্রমশ...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct