সোনিয়া তাসনিম খান: মুক্ত আকাশের ক্যানভাসে উড়ে চলা স্বাধীন শ্বেত শুভ্র পায়রার চঞ্চলতার সাথে একরাশ কৃষ্ণ বারদ স্তরে ঢেকে নেওয়া এক শোকের আলেখ্য, এই দুই বৈপরীত্যে বিশেষিত ছিল গতকালের উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনার অবারিত মঞ্চ। রঙিন আনন্দ ফোয়ারার পিচকিরির সঙ্গে বিরহ অশ্রুর মিশেল ঘটেছিল পুরোদস্তুর। অসীম এক প্রাপ্তির সুখ কবিতার পাশেই হারিয়ে ফেলার নীল বেদনার গল্পের মিশেলে একাকার হয়ে উঠেছিল গত ১৬ অগাষ্টের সন্ধ্যাবেলা। অনুরাগের সপ্ত রাগে সিক্ত হয়ে ওঠা ভারতের ৭৫ তম সোনালি স্বাধীনতা দিবসের হর্ষধ্বনির সাথে মিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের সেই কুখ্যাত ভয়াল ১৫ অগাষ্টের শোকগাঁথা। যেদিন বাংলাদেশ হারিয়েছিল তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এক কলঙ্ক অধ্যায়ের হয়েছিল সূচনা। সম্ভাবনার সূর্যদয়ের কিরণচ্ছটা নিমজ্জিত হয়েছিল অতল অন্ধকারে। গতকাল তাই আনন্দলোকে যেমন মঙ্গলের জোয়ার জেগেছিল, তেমনি বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল কোটি হৃদয়ে জমে থাকা অবরুদ্ধ বাষ্পের ভারে।
প্রতি সপ্তাহের মত এবারেও অনুষ্ঠানটির দক্ষ কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রোকেয়া ইসলাম। শুরুতেই তিনি ভারতবাসীকে মহান স্বাধীনতা দিবসের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এবং একই সঙ্গে বিউগলে জাগিয়ে তুলেন শোকাবহ অগাস্টের করুণ সুর। স্বরচিত গান গেয়ে শোনান নাহার আহমেদ। তার রচিত পংক্তিতে সূক্ষ ভাবে ফুটে উঠেছিল ১৫ অগাষ্টের ঘটে যাওয়া সেই বেদনাবিধূর ভয়াবহ কাহিনী। পশ্চিম বঙ্গের জনপ্রিয় কবি ও লেখক, রেখা রায় তার সাবলীল বর্ণনায় ব্যাখা করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ওপর দেশি বিদেশি নানা তথ্যবিবরণীর কথা। বাংলাদেশ থেকে উপস্থিত ছিলেন লেখক ও ঔপন্যাসিক সোনিয়া তাসনিম খান। তার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তিনি বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্ত্বার ইতিবৃত্তকে তুলে ধরেন। জাতির জনকের রচিত ও প্রকাশিত তিনটি বই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', ' কারাগারের রোজামনচা', ' আমার দেখা নয়াচীন' এই তিনটি রচনার ওপর আলোকপাত করেন সোনিয়া। তথ্যবহুল বক্তব্যে ফুটে ওঠে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের খোলসের আড়ালে থাকা বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী লেখক সত্ত্বার জানা-অজানা রূপকথা। বাংলাদেশ থেকে আরও বক্তব্য রাখেন, কবি কামরুল বাহার আরিফ। তার সমৃদ্ধ আলোচনায় বঙ্গবন্ধু যেন বাস্তবে মূর্তমান হয়ে উঠেছিলেন সকলের সম্মুখে। কবি জানান, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই মহান নেতা একজন রাষ্ট্রনায়ক হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সংস্কৃতি ও দর্শনকে ধারণ করে অগ্রসর হয়েছেন এবং পরম যত্নে তিনি মনে প্রাণে লালন করেছেন। আর এটাই তাঁকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের লালনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, পাকিস্তান আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতা হিসেবে বিবেচিত দূরদর্শী নেতা শেখ মুজিব, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মাত্র এক বছরের মাথাতেই বুঝতে পেরেছিলেন এই নব গঠিত রাষ্ট্র মূলতঃ আমাদের স্বপ্ন রাষ্ট্র নয়। তাই তিনি নিজেকেও তৈরী করেছিলেন ভবিষ্যতের সেই যোগ্য কান্ডারী হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রারাম্ভেই তিনি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত প্রকৃত স্বাধীনতা আনয়ন কখনই সম্ভব নয়। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ লক্ষ্য করলে দেখা য়ায়, তিনি সেখানে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেছেন। এটির গুরুত্ব আরও স্পষ্ট বুঝা যায়, তাঁর রচিত "আমার দেখা নয়া চীনের পাতা" য় ডুব দিলে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতেন ও এগিয়ে নিতেন একটা সুসংগঠিত ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে। তাইতো, এক সময়কার "মুসলিম লীগের" উত্তোরন ঘটিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন আম জনতার দল "আওয়ামী লীগ"৷ এই অসাম্প্রদায়িকতার বীজ বুননের জন্য তিনি মাঠ পর্যায়ে নেমে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং পেয়েছেন জনগনের অকুন্ঠ সমর্থন। পরবর্তীতে, অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়নের হেতু তিনি বাকশাল কায়েম করতে উদ্যোগী হন। তাঁর এই উদ্যোগ মূলতঃ তার জীবনের গতিকে থামিয়ে দেবার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্রাজ্যবাদী স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রের কাছে নির্মম ভাবে প্রান দিতে হয় তাঁকে ও তাঁর গোটা পরিবারকে। কবি কামরুল বাহারের সাবলীল বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমন আরও অনেক জানা অজানা তথ্য উঠে আসে সকলের সামনে।
বক্তব্য রাখেন, নওগাঁ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক জনাব ড. মুহাম্মদ শামসুল আলম। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্বের ওপর তিনি অত্যন্ত চমৎকার আলোকপাত করেন। এই ভাষণটিকে UNESCO কতৃক সম্মানিত করবার নেপথ্য কারণসমূহ তিনি তাঁর আলোচনায় তুলে ধরেন৷
বিশিষ্ট কবি, লেখক ও প্রশিকার চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয়া রোকেয়া ইসলাম ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের সেই কালো রাতে ঘটে যাওয়া তার ব্যক্তি জীবনের ভয়াল অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন। স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান, কবি কামরুল বাহার আরিফ ও নাহার আহমেদ।
সর্বশেষে পশ্চিমবঙ্গের "উদার আকাশ" পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশনের কর্ণধার ফারুক আহমেদ ভারতের স্বাধীনতার ওপর সংক্ষিপ্ত পরিসরে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। ইতিহাসের আলোকে তিনি বলেন, মূলতঃ জিন্না সাহেব প্রস্তাবিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, হিন্দু এবং মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। তাই দুটি আলাদা দেশ হওয়া প্রয়োজন৷ হিন্দু মহাসভার নেতা সাভাকরও একই নীতিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভারতের সংবিধান প্রণেতারা জিন্নাহ বা সাভাকরের পথ নেননি। তারা ভারতবাসীকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। তবে অসাম্প্রদায়িকতার যেই বীজকে তারা সেদিন নিজেদের মাঝে লালন করে নিয়েছিলেন সেটার সঠিক পরিষ্ফুটন হয়নি আজও৷ নানা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা আর সংস্কৃতির মিশেল দেশ এই ভারত। যে মহান ব্রত নিয়ে একদিন বিপ্লবীরা এই স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্ম দিয়েছিল দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, সেই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেড়িয়ে গেলেও প্রকৃত অর্থে দেশটি এখনও সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে সমর্থ হয়নি। ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি এবার আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করবার প্রথম শর্ত হলো, সাম্প্রদায়িকতার চিন্তা চেতনাকে বিনষ্ট করে দেওয়া। একে সমূলে উৎপাটন করে নেওয়া। আর এটা করতে গেলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক তথা ধর্মীয় চেতনায় সাম্যবাদ আনয়ন করা একান্ত জরুরী। সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য মানসিকতাকে পিছে ফেলে দিয়ে ভবিষ্যতে তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একত্রে মিলে এগিয়ে চলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। পরিশেষে ভারতের অক্ষুন্নতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। উল্লেখ্য, জনাব ফারুক আহমেদ, তার বলিষ্ঠ বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকেও স্মরণ করেন বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং তাঁর স্মৃতি বিজরিত সেই বেকার হোস্টেল নিয়ে নানা তথ্য উপস্থাপন করেন যা কিনা সত্যি সকলকে ভাবুক করে তোলে। অনুষ্ঠানে দুই বাংলার শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক চর্চা ও এর উন্নয়ণ বিষয়ক আলোচনাও প্রাধাণ্য পায়। এই নিয়ে মতবিনিময় করেন উপস্থিত সকলেই।
এমনি সব প্রাঞ্জল আলোচনা শেষে রোকেয়া ইসলামের অনবদ্য উপস্থাপন শৈলীতে ভর করে প্রায় দুই ঘন্টা ব্যাপী দীর্ঘায়িত এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানটির সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct