জাফিরা হক: স্বাধীনতা দিবস, সেও যেন আজ ঘরবন্দি। না, সেই ব্যস্ততা আজ আর নেই। সেই হই হই করে পতাকা উত্তোলন, মিষ্টি বিতরণ, সবই যেন আজ বোকা বাক্সে বন্দি নয়তো বা মুঠোফোনে বন্দি। সে এক সুন্দর দিন ছিল ছোটবেলার স্বাধীনতা দিবস।
শুধু একটা দিন নয় পুরো আগস্ট মাসটাই ছিল স্বাধীনতার মাস। ১লা আগস্ট থেকেই শুরু হয়ে যেত প্রস্তুতি। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে টাকা জমানো আর না হয় বড়দের কাছে আবদার করে কিছু টাকা জোগাড় করার চেষ্টা চলত। কারণ নেতাজি, গান্ধীজি,মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই সমস্ত মনীষীদের ছবি কিনতে লাগতো বেশ কিছু টাকা। তার সাথে ছিল পতাকা কেনা, মিষ্টি কেনা সে কি এক ব্যাস্ততা। এই কদিনে সবাই মিলে সব কিছু জোগাড় করে ফেলতে হবে যে। একান্নবর্তী পরিবারে সবাই মিলে স্বাধীনতা দিবস পালনের এক আলাদা আনন্দ ছিল যা আজকাল কার দিনে একাকী পরিবারে পাওয়া দুষ্কর।আর সবার মতো আমরা স্কুলে গিয়ে স্বাধীনতা দিবস পালনে তেমন একটা অভ্যস্ত ছিলাম না। বড় হয়ে হোস্টেল আমি প্রথমবার স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন করি কিন্তু সেই ছোটো বেলার আনন্দ তাতে বিন্দুমাত্রও পাওয়া যেত না।
১৫ই আগস্ট খুব ভোরে বেলা আমরা সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। কারণ ফুল পাড়তে যেতে হবে যে।পাড়ার বিভিন্ন কাকা, চাচা, চাচিদের সকাল সকাল হানা দিতাম ফুল তোলার জন্য। না, ১৫ই আগস্টে কেউ বকাবকি করত না, তার গাছ থেকে ফুল পাড়ার জন্য। বরং সবাই চাইত তার গাছের ফুল দিয়েই যেন পতাকা উত্তোলন হয়। কোনও কোনও দাদিদের (ঠাকুমা)আবার কড়া নির্দেশ থাকতো তার নাতি,নাতনিরা যেন বাদ না পড়ে চড়ুইভাতিতে।
আমরা ছোটরা আলপনা করতে পারতাম না। তাই কোনও বড় দিদি বা দাদাদের কাছে হাজির হতাম আমাদের আবদার নিয়ে, সাজিয়ে দিতে হবে পতাকা উত্তোলনের জায়গা। নিয়ম ছিল বাড়ির সবচেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্যই উত্তোলন করবে পতাকা। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে জোরে জোরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সেই যে আনন্দ, সে আজ কোথায়। নাহ তখন এই চারিদিকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তারস্বরে বক্সে গান বাজানোর সংস্কৃতি ছিল না। যেটুকু ছিল তা ছিল রেডিওতে দেশাত্মবোধক গান শোনা। আর না হয় বড়দের কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গল্প শোনা। কি গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনতাম আমরা শহীদ ক্ষুদিরামের কথা, নেতাজির লড়াই এর গল্প, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা তৈরির কাহিনী, গান্ধীজির অনশন ত্যাগ র গল্প।আরো কতো মহান সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা যারা আজ ও সমান ভাবে আমাদের কাছে আদর্শ ব্যক্তিত্ব হয়ে আছে। স্বাধীনতা দিবসের সেই মিষ্টির যে স্বাদ সেই স্বাদ আজকের দিনের এই কেকের যুগে কোথায়? স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজকাল কার যুগের এই কেক কাটা সংস্কৃতি কেমন যেন স্বাদহীন।
বাবা বলত কলকাতার রেড রোডে অনেক বড় করে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল দেখার সরাসরি না দেখলেও বড় হয়ে প্রতি বছর টিভির পর্দায় দেখতে বেশ, মন্দ লাগে না। ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবস এ সারাদিন আমাদের মুখে মুখে চলতো গান ‘চল রে চল সবে ভারতও সন্তান, মাতৃভূমি করে আহব্বান’। আজও খুব পছন্দ এই গান। আর চলত সারাদিন ছোটাছুটি, খেলাধুলা হইহুল্লোড়। অনেক চেঁচামেচি করলেও কেউ বকাবকি করত না। ভুল করলেও ছাড় পেয়ে যেতাম। শুধু এই স্বাধীনতা দিবসের দৌলতে।
সে সব দিন আজকের দিনের শিশুরা কতটা পায় তা সন্দেহ। আর এই মহামারী কালে স্বাধীনতা দিবস যেন আরো সংকুচিত হয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ-এর স্ট্যাটাসে বন্দি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা দিবসের সব আবেগের প্রকাশ যেন ওই জোরে জোরে বক্সে গান চালানোর মধ্যে আর না হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছা বার্তাতেই এসে থেমে গেছে। যদিও এই মহামারী কালেও এখনো কিছু বাড়ির ছাদে পতাকা উত্তোলন দেখা যায়, সেটাই একটু আনন্দ এনে দেয় মনে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ছোটবেলার স্মৃতিতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct