সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৩ কিস্তি ৪
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
সুমনের কথা শুনে গত সপ্তাহে ‘নাট্যভারতী’র সভায় তুমি যে আলোচনা করেছিলে, তা নতুন করে মনে পড়ল। সেদিন বলেছিলে, সামনে আরেকটা স্বাধীনতা যুদ্ধ, আমরা সকলে সেই যুদ্ধের সৈনিক। আজ দীপ আর সুমনের আক্ষেপ শুনে বুঝতে পারছি, তুমি সেদিন কত বড়ো নিষ্ঠুর সত্যি প্রকাশ করতে পেরেছিলে। অথচ আমি মনে মনে তোমার আলোচনাকে এতটুকু গ্রহণ করতে পারি নি। সেজন্যে এখন ক্ষমা চাচ্ছি।।
পল্লব একটু হাসল। বুঝল, নিজে ঠকতে ঠকতে যা শিখতে পেরেছে, দীপের পক্ষে তা সম্ভব হয় নি। চলার পথে জীবনের কঠোর ঝুঁকি একেবারে গায়ের উপর এসে না পড়লে কেউ নতুন বোধ লাভ করতে পারে না। দীপও পারে নি। সেজন্যে তার পক্ষে এভাবে দুঃখ প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।
পল্লবকে নিয়ে দীপের উপলব্ধি মেঘ ঠেলে বের হওয়া সূর্যের উপস্থিতির মতো। সকালের সূর্য শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের বুকে সাত রঙ ঢেলে দিয়ে নিজের স্বপ্নকে কঠোর বাস্তবে নামিয়ে আনে। পল্লবের কথায় দীপের মধ্যে তেমন এক স্বপ্ন তৈরি হল। সে চাচ্ছে নিজেকে কঠোর বাস্তব করে তুলতে। পল্লবের কৌতুহল বাড়ছে দ্রুত গতিতে। পাশে বসেছিল সুমন। তাকে বলল, তুই তো এম.এ. পাশ করা ছেলে, পারবি প্রসঙ্গটা ব্যাখ্যা করতে?
সুমন গত বছর সমাজবিদ্যা নিয়ে এম.এ. পাশ করেছে। সেটাই তার পুঁথিগত বিদ্যে। পল্লবের প্রশ্নের ঠিক কী উত্তর হবে তা ভেবে পেল না। মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলে দাও পল্লবদা।
ইংরেজরা আমাদের দেশে যে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল, তা ছিল অনেকখানি প্রত্যক্ষ। চোখের সামনে দেখা যেত, তারা কী করছে। সেই উপলব্ধি সরাসরি ঢুকত আমাদের মধ্যে। ভালো করছে, না খারাপ করছে, তা বুঝতে পারতুম। লড়াইটাও ছিল অনেক সহজ। শত্রুকে চিনতে পারা গিয়েছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। সেই লড়াই-এর ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৪৭ সালে ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা লাভ করেছি। সেই স্বাধীন ভারতবর্ষে আমরা এখন বসবাস করছি। তাই মনে হয়, কোনো বিপদ নেই আমাদের সামনে। সরলভাবে ভাবলে, এমন ভাবার অবকাশও রয়েছে। আমাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী রয়েছে, তারা ভীষণ শক্তিশালী। তাদের হাতে রয়েছে রকেট, মিসাইল, প্রয়োজন হলে পারমাণবিক অস্ত্রও প্রয়োগ করতে পারে। ভারতের চারপাশে যে সব ছোটো ছোটো রাষ্ট্র রয়েছে, তাদের ক্ষমতা নেই ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
তাহলে আমাদের সামনে তো কোনো বিপদ নেই পল্লবদা।
এখনকার সব বিপদ ছদ্মবেশী শত্রুতা নিয়ে। নতুন যুগে শত্রুতার স্বরূপ পাল্টে গেছে রে। সন্ধে-সকালে বোকা বাক্সের সামনে বসে মানুষ এখন জীবনের অমূল্য সময় ব্যয় করছে কিন্তু জানতে পারছে না, বিশুদ্ধ বিনোদনের মাধ্যমে আমরা কীভাবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি নে, বোকা বাক্স ঘুন পোকা হয়ে কীভাবে রোজ রোজ আমাদের মগজ ধোলাই করছে। তুই তো স্বপ্নকে চিনিস, আমার ছোটো ভাই-এর বন্ধু। সরকারী চাকুরে। কলকাতায় অফিস। যাতায়াতে দিনের সময় শেষ হয়ে যায়। ব্যস্ততাই তার জীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তার একমাত্র ছেলের নাম বিপ্লব, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পরশু আমাকে কী বলল জানিস? হাতের ব্যাট আগিয়ে দিয়ে বলল, কাকু, এর উপরে ভালো করে ফোর স্কোয়ারের লোগোটা এঁকে দাও। এর মানে কী হয় জানিস? বড়ো সাংঘাতিক। বিদেশের এক বিখ্যাত মদ কোম্পানি বিপ্লবের উপর যে প্রভাব বিস্তার করল, তার ভিতরে রয়েছে বিষের মতো প্রতিক্রিয়া। বিজ্ঞাপনে জনপ্রিয় নায়ক ফররুখ খানের ছবি দেখে ছেলেটা শুধু আকর্ষণ বোধ করে নি, সেই সঙ্গে শিখেছে, ফোর স্কোয়ার স্রেফ পানীয়। কিন্তু তা যে নয়, সেই সত্যিটুকু শিখতে পারে নি। এখানেই থেমে থাকলে ছদ্মবেশী শত্রুতা নিয়ে মুখ খুলতুম না। এর বাইরেও আরও কিছু রয়েছে, যা ভয়ানক ক্ষতির কারণ। ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাতেই অনেকখানি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
এ সব কী বলছ পল্লবদা?
আগে সবটুকু শুনে নে, তারপর দেখবি, আর প্রশ্ন করতে সাহস পাবি নে, বরং থ হয়ে চেয়ে থাকবি আমার দিকে। বিস্ময়ে মাথা হেঁট হয়ে যাবে তোর। বিপ্লব শুধু ফোর স্কোয়ারের ছবি এঁকে দিতে বলে নি, রঙিন নেশায় মত্ত হয়ে ফররুখের একমাত্র ইংরেজ সঙ্গী কীভাবে শরীর দুলিয়ে মাটিতে পড়ে গেল, তা অভিনয় করে দেখাল আমাকে। মন্তব্য করল, ইংরেজ বলেই এমন করে শরীর দোলাতে পারল। প্রকারান্তরে ছেলেটা ইংরেজদের দুশো বছরের নিপীড়ন ভুলে গিয়ে নতুন করে শিখল, আজও ইংরেজরা আমাদের খাঁটি বন্ধু হয়ে আছে। ইতিহাস ভুলে একজন মানুষ কিংবা একটা জাতি কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ছেলেটাও আগামি দিনে পারবে না। বিজ্ঞাপনটাই তো তাকে ভুলিয়ে রেখে ভিতরের দেওয়ালে এমনি নতুন ছবি এঁকে দিল। বড়ো হয়ে এই ছেলেটা স্বাভাবিকভাবে বলবে, স্কোয়ারের প্রচলন তো আগে থেকেই ছিল। এভাবে গা-সোয়া মনোভাবের মধ্যে এদেশের মানুষ বিদেশী মদের কারবার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে যাবে। সেই পথে যুবকদের মেরুদন্ড রোজ রোজ দুর্বল হবে। দেশপ্রেম লুকিয়ে রাখার এ বিরল দৃষ্টান্তকে শত্রুতা বলেই তো ভাবতে হবে। যে বস্তুগুলোর প্রতি তাদের বিরাগ থাকার কথা, সেগুলোকে জীবনের ধাপে ধাপে পছন্দের মধ্যে নিতে শুরু করলে টিভি-সংস্কৃতির শেষতম শত্রুতা জেনেও হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না।
দেবু শুনতে শুনতে হতবাক না হয়ে পারল না। একেবারে অভিনব ব্যাখ্যা। দুচোখে দেখেও পিছনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যে ভাবনা মাথায় ঢোকাতে পারে নি, পল্লবের ব্যাখ্যায় তা সূচ হয়ে ঢুকল তার বিবেকে। স্থির চোখে চেয়ে থাকল পল্লবের দিকে। অস্ফুটে বলল, এত গভীর করে ভাবতে পার তুমি?
এতো নাট্য আন্দোলনের ভাবনা, জীবনের পলে পলে নানা বাধার আদলে এমনি ভাবনার জন্ম হয় মানুষের মধ্যে। ফলে কাহিনী সূত্রে এ ভাবনা যখন নাটকে প্রকাশ পায়, তখন মানুষ তালি না দিয়ে পারে না। এটাকে তুই সামাজিক বিপ্লবের প্রস্তাবনা হিসেবেও গ্রহণ করতে পারিস।
তাহলে এসব কী দেশীয় উপনিবেশের উদাহরণ?
ঠিক তাই।
আরেকটা দৃষ্টান্ত দাও পল্লবদা।
কেমন তামাশা চলছে দ্যাখ। সিগারেটের রঙিন বিজ্ঞাপনের নীচে বড়ো বড়ো করে লিখে দেওয়া হচ্ছে, তামাক ক্যানসারের কারণ। এগুলো মানুষ পড়ছে। কিন্তু মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারছে কী? বরং বিজ্ঞাপনে ফিল্মস্টারদের উপস্থিতি প্রমাণ করছে, এ নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই। বিখ্যাত নায়ক ফররুখ খান কিংবা স্বনামধন্য ক্রিকেটার গৌরব গাঙ্গুলী যখন বিজ্ঞাপনে থাকেন তখন আম-মানুষ ভাবতে পারে না বাড়তি বিপদ নিয়ে। বরং ভাবতে বাধ্য হয়, বিপদ থাকলে অত বড়ো মানুষরা এসবের সাথে যুক্ত হতে পারত না। বড়ো বড়ো বিখ্যাত ইমেজের আড়ালে ক্যানসারের আশু বিপদ সম্পর্কে ভুলিয়ে রাখার অভিনব কৌশল ভারতীয় চাষীদের উপর সেই জালবিস্তার অন্য অর্থে কত বেশি গভীর হয়ে উঠছে, তা ভাবতে পারবি নে তুই।
কী রকম? ব্যাখ্যা করে বললে আরেকটু বেশি জানতে পারতুম।
এখন থেকে বীজধান আসবে বিদেশ থেকে। রেডিও টিভি এবং বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে আগের তুলনায় ফসলের পরিমাণ অনেক বেশি হবে। শুনলে ভিতরে নতুন আশা জাগে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবে অন্য চিত্র দেখতে পাবি। উৎপন্ন ধান পরের বছর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে হল ফি বছর বীজধান কিনতে হবে বিদেশের কাছ থেকে। এর পিছনে একটা করুণ পরিণতি লুকিয়ে রয়েছে, যা নিয়ে তাৎক্ষণিক সাময়িক আনন্দের উচ্ছ্বাসে কেউ ভাবতে পারছে না। দশ বারো বছর পরে এ দেশ থেকে দেশীয় ধানের বীজ উঠে যাবে। নতুন বছর শুরু হলে আমরা বীজধানের জন্য বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে বাধ্য হব। শুরুতে যে সরল অঙ্ক ছিল, তখন তা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠবে। বিদেশ থেকে বীজধান এলে তবেই এ দেশের মাঠে মাঠে সোনার ফসল ফলবে।
ভিতরের অবস্থান এত বেশি দুর্বিসহ?
তোকে মনোযোগ দিয়ে আরেকটু বেশি শুনতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানি ইতিমধ্যে ভারতে ঢুকে পড়েছে নতুন ফুলফলের বীজ নিয়ে। তারাই শেখাবে চাষ, তারাই কিনে নেবে আমাদের উৎপন্ন ফসল। শুনলে স্বপ্নের মতো লাগে। মনে হবে, মাথার উপর নতুন অভিভাবক পেয়ে গিয়েছি। নতুন আশায় বুক ভরে উঠবে। কিন্তু এর পরিণতি কত বেশি ভয়ানক হতে পারে, তা ভাবলে আঁৎকে উঠবি তুই। বিদেশীরা এসব করছে কেবল বেশি লাভের আশায়। ঠিক নীলচাষের মতো। গা-সোয়া করিয়ে নিয়ে হঠাৎ করে উৎপন্ন ফসলের দাম কমিয়ে দেবে। তখন লাভের অঙ্ক লোকসানে বইতে শুরু করবে। এ ধাক্কা সামলানো চাষীদের পক্ষে সম্ভব হবে না। লোকসান মাথায় নিয়ে চাষীরা উৎপন্ন ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে। ঘরে ঘরে শুরু হবে আত্মহত্যার পালা। স্বাধীন দেশে নিজস্ব সৈন্যবাহিনী কী পারবে সেই আত্মহত্যা রুখে দিতে? আমাদের দেশের প্রযুক্তি কী পারবে সেই লোকসান ঘুচিয়ে নতুন পথ বের করে আনতে যাতে চাষীরা আবার রুখে দাঁড়াতে পারে। ভারত দখলের নতুন সংস্করণ এভাবেই তলে তলে শুরু হয়ে গেছে। আমরা নামে স্বাধীন হয়ে থাকব কিন্তু কিছুতেই অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাব না।
দেবু এবং বাকিরা থম মেরে বসে থাকল। কোনো উত্তর দিতে পারল না কেউ। সকলের মনের আকাশে কালো মেঘের বিস্তার শুরু হয়ে গেছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে পল্লবের ভাবনা ঢুকছে বাঁধভাঙা জলের মতো। আশু বিপদের ছদ্মবেশী সূত্রপাতে তারা ভীষণ মর্মাহত। আরও ভাবল, পল্লবদা শুধু নাটক নিয়ে ভাবে না, নাটকীয় ভাবনার সাথে দেশের ভাবনাকে দারুণ মিলিয়ে দিতে পারে। বুঝল রহমানকাকুর জীবনাদর্শ অনুসরণ করতে করতে পল্লবদার ভাবনা এভাবেই গভীর হয়ে উঠেছে। কেন পল্লব নাটকের আলোচনার সময় বার বার রহমানকাকুর কথা উল্লেখ করে, সেই সত্যের কঠোর বাস্তবতা সকলের মাথার উপরে ভর করল মুহূর্তে। যেদিন দেবু নতুন স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা শুনেছিল, সেদিন নিছক গল্পবাজি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে নি। সেই দেবু সময়ের টানে বুঝতে পারল, কেন পল্লবদা নতুন বিপ্লব নিয়ে তাকে ও অন্যকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিল। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আসছি পল্লবদা।
যা, ভাবতে ভাবতে যা, দেখবি তুই নিজেও প্রতিরোধের পথ পেয়ে গিয়েছিস। কাল এসে বলবি, তাতে আমিও আরেকটু শিখতে পারব। প্রতিরোধ কখনো একার নয় রে। দেশ সকলের, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সকলের মিলিত প্রয়াসে।
দেবু ধীর পায়ে সোপান নাট্যসংস্থার বারান্দা পার হয়ে রাস্তায় নামল। আলো-আঁধারের প্রহেলিকা পেরিয়ে থিকথিকে অন্ধকার ঠেলে সামনে এগিয়ে চলেছে। পল্লবের স্বাধীনতা যুদ্ধের তথ্য ও তত্ত্ব তার মনের ইজেলে পল্লবিত হয়ে উঠছে। দ্রুত সামনে চলতে চলতে অস্ফুটে বলল, ঠিক তাই। নাটক মানে বিপ্লব। সমাজ পাল্টানোর আন্দোলন। নতুন সমাজ গড়ার কাজে লেগে পড়া। নাটক মানে জীবনের সেই মন্ত্র, যা মেনে চললে রাষ্ট্র সমাজ ও ব্যক্তিজীবন আরও সমুন্নতি লাভ করতে পারি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct