বৃদ্ধাশ্রম খুবই গ্রহণযোগ্য আবাসস্থল? বিশ্বজুড়ে এর কদর বাড়ছে। ধীরে ধীরে এই আবাসনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তীব্র গতিতে। বর্ণ-গোত্র জাতি গোষ্ঠী নির্বিশেষে বৃদ্ধাশ্রমের ইদানীং বিশেষ প্রয়োজন। ফলে নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেও আষাঢ়ে কদম ফুলের মতো দিকে দিকে গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। এ সকল বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন সমাজের বৃদ্ধ মানুষ। আজকের এই বৃদ্ধরাই একসময় ছিলেন সমাজের ভবিষ্যৎ ও কর্ণধার। অথচ কালের বিবর্তনে কিছু সংখ্যক হয়েছেন অকর্মণ্য, নিজের ঘরে পরগাছা, সন্তানের চক্ষুশূল এবং পরিবার ও সমাজের বোঝাস্বরূপ। তা নিয়ে লিখেছেন আবদুল মুকিত মুখতার।
বৃদ্ধাশ্রম খুবই গ্রহণযোগ্য আবাসস্থল? বিশ্বজুড়ে এর কদর বাড়ছে। ধীরে ধীরে এই আবাসনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তীব্র গতিতে। বর্ণ-গোত্র জাতি গোষ্ঠী নির্বিশেষে বৃদ্ধাশ্রমের ইদানীং বিশেষ প্রয়োজন। ফলে নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেও আষাঢ়ে কদম ফুলের মতো দিকে দিকে গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। এ সকল বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন সমাজের বৃদ্ধ মানুষ। অনেক বৃদ্ধ পিতা-মাতা।
কেন এই বৃদ্ধাশ্রম?
বৃদ্ধ মাতাপিতা এক সময় ছিলেন নিজের ঘর-পরিবারের নির্মাতা, সংসার সমাজের প্রতিষ্ঠাতা। অথচ কালের বিবর্তনে কিছু সংখ্যক হয়েছেন অকর্মণ্য, নিজের ঘরে পরগাছা, সন্তানের চক্ষুশূল এবং পরিবার ও সমাজের বোঝাস্বরূপ। তারা নিজেরা যেমন অলস অকেজো হয়ে পড়েছেন, তেমনি তাদের সন্তানরাও পড়েছে মহা বিপদে।
বৃদ্ধ মানুষদের ভরণ-পোষণের কারণে জীবিকা নির্বাহে যেমন বাধা সৃষ্টি হয়, তেমনি বৃদ্ধরাও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা পান না। অথৈ জলে ভাসমান কচুরিপানার মতো দুর্বিষহ অবস্থা বহে চলে তাদের উপর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের হাতে গড়া পরিবার বা সংসারে হয়ে পড়েন এক প্রকার বন্দি আবর্জনাস্বরূপ।
বর্তমান সমাজ-সংসারে দেখা গেছে, বৃদ্ধগণের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ছেলে-সন্তানদের ঘর-সংসারে লেগে থাকে ভুল বোঝাবুঝি ও ঝগড়া-বিবাদ। ছেলের বউ তার শ্বশুর-শাশুড়িকে গ্রহণ করতে পারে না নিজের মা-বাবার মতো। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও হাঁপিয়ে ওঠে নিজেদের জীবিকার কর্মব্যস্ততায়। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণ করতেই বেচারা ছেলের দিনরাত একাকার। উপরন্তু বৃদ্ধ পিতা-মাতার পরিচর্যা আরেকটি বাড়তি ঝামেলা।
মেয়ে-সন্তানেরা বৃদ্ধ পিতা-মাতার দায়-দায়িত্ব বহন করতে পারে না বিভিন্ন কারণে। একে তো নিজের সন্তানের লালন-পালন, স্বামীর সংসারের কর্মব্যস্ততা এবং সমাজ-সংস্কৃতিতে কিছুটা বেমানান ইত্যাদি কারণে অধিকাংশ বৃদ্ধ পিতা-মাতা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
কোনো কোনো পরিবারে বৃদ্ধ মানুষের জন্য দিন-রজনির সিংহভাগ সময় ব্যয় করতে হয়, যার পুরোটাই প-শ্রমতুল্য। অতএব বৃদ্ধগণের জন্য বৃদ্ধাশ্রম যুগোপযোগী ব্যবস্থা (?)।
যুগে যুগে বৃদ্ধাশ্রম
বৃদ্ধাশ্রম একটি সংযুক্ত বাংলা শব্দ। অর্থাৎ বৃদ্ধ+আশ্রম=বৃদ্ধাশ্রম। এখানে বৃদ্ধ শব্দের অর্থটা মোটামুটি স্পষ্ট এবং সবার জন্য সহজবোধ্য। তবে বাংলা অভিধানে আশ্রম শব্দের কয়েকটি অর্থ রয়েছে। যেমন ১. সংসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসীদের বাসস্থান। ২. সাধনা বা শাস্ত্রচর্চার জন্য নির্দিষ্ট স্থান মঠ, আস্তানা। ৩. তপোবন (মুনির আশ্রম)। ৪. আশ্রয়, স্থান; গৃহ (অনাথাশ্রম)। ৫. শাস্ত্রোক্ত হিন্দু জীবনযাত্রার চতুর্বিধ অবস্থা। ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস।
উত্তরাধুনিক যুগের বাঙালি মুসলিম সমাজে বৃদ্ধাশ্রম শব্দের চতুর্থ নম্বর অর্থটাই সম্ভবত ধরে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আশ্রয় বা অনাথাশ্রম। অবশ্য মুসলিম সমাজের বৃদ্ধ মানুষেরা কখনো সংসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো নয়। কেউ এটা করেও না। যে কারণে বাঙালি মুসলিম সমাজের সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধাশ্রম বা এল্ডারলি বৃদ্ধাশ্রম।
এদিকে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে ‘সংসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসীদের বাসস্থানকেও বৃদ্ধাশ্রম বলা হয়ে থাকে। তবে তা অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্য অনাথাশ্রম নয়। বরং তা হিন্দু ধর্মযাজক বা সাধু-সন্ন্যাসীদের ধর্মানুষ্ঠানের বিধিবদ্ধ আশ্রয়স্থল বা আশ্রম।
হিন্দু ধর্মে মানবজীবন চারটি স্তরবিশেষে প্রতিষ্ঠিত, যথা ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। জন্মের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত বিদ্যা-শিক্ষা গ্রহণের সময়কে ব্রহ্মচর্য বলা হয়।
বিবাহ, সন্তান-উৎপাদন, পরিজন পোষণ ইত্যাদি গার্হস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত। বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গৃহীর কর্ম সমাপন ও পৌত্রমুখ দর্শনের পর স্ত্রীকে পুত্রের কাছে রেখে কিংবা সঙ্গে নিয়ে বনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করার নাম বানপ্রস্থ। বয়স সত্তরে পৌঁছলে ঘর সংসার সবকিছু ত্যাগ করার নাম সন্ন্যাস।
উল্লেখ্য যে, মানবজীবনের চারটি স্তরকে চতুরাশ্রমও বলা হয়, এবং একমাত্র ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষই উক্ত চারটি আশ্রম পালনের অধিকারী। সুতরাং আধুনিক বিশ্ব মানবতায় প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রম হিন্দু ধর্মীয় আবাসনের অন্তর্ভুক্ত নয়।
উত্তরাধুুনিক যুগের শহরকেন্দ্রিক হিন্দু সমাজের কিছুসংখ্যক লোক বার্ধক্যে উপনীত পিতা-মাতাকে মোটেই গ্রহণ করতে রাজি নয়। কারণগুলো যথাক্রমে-
১. বর্তমান সমাজের জীবন-যাপন পদ্ধতি অনেকাংশে পরিচ্ছন্ন। কিন্তু বৃদ্ধ মানুষেরা বয়সের ভারে ও রোগে শোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারেন না। ফলে ঘর-সংসারে তাদেরকে আবর্জনাস্বরূপ বাড়তি ঝামেলা হিসেবে গণ্য করা হয়।
২. অতি সম্প্রতি সংসার জীবনে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে পরিবার পরিচালনার ব্যয়ভার। বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক প্রত্যেকটি মানুষকেই কাজ করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কিন্তু বুড়োরা যেমন উপার্জন করতে পারেন না, তেমনি নিজের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কাজগুলোও করতে সক্ষম নন।
৩. বৃদ্ধ মানুষের ব্যয়ভার সবচে বেশি, যেমন চিকিৎসা, ওষুধ-পথ্য, নিয়মিত পরিচর্যা ও উপস্থিতি ইত্যাদিসহ সর্বোপরি বুড়োদের ভরণ-পোষণের খরচ জলে ঢালা পণ্যের মতো। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যার ন্যূনতম অংশও ফেরত পাবার কোনো আশা নেই।
৪. উল্লিখিত কারণে ভারত উপমহাদেশীয় একান্নবর্তী পরিবারের বৃদ্ধ মানুষেরা বিরাট বাধাস্বরূপ। প্রথমেই তারা কিছুসংখ্যক ছেলের বউয়ের ঈর্ষা-দ্বেষের শিকার হন।
৫. ঘর-পরিবারে বুড়ো পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের ব্যয়ভারকে রীতিমতো তছরুপ বলে গণ্য করা হয়।
৬. এক পর্যায়ে নিজের ছেলেমেয়েরাও অতিবৃদ্ধ পিতা-মাতার পরিচর্যায় বিরক্ত হয়ে তাদের থেকে পরিত্রাণের পথ খোঁজে।
৭. আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজিবাদী জীবন-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ সন্তানেরা আঠারো বছর অতিক্রম করলেই পিতা-মাতার বাধ্যবাধকতামুক্ত জীবন-যাপন করতে পারে। তাই পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ কিংবা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখাও সন্তানের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
৮. আজকের পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা প্রত্যাখ্যাত। ফলে পিতা-মাতার সাথে সনাতন নীতিনৈতিকতাবোধ অনেকাংশে অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে সন্তান উৎপাদনকারী যন্ত্রের মতো মনে করা হয়। যে কারণে সন্তানেরা বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয় এবং নেয়ও না। তাই রাষ্ট্র সরকার সে দায়িত্ব বহন করে থাকে।
৯. পশ্চিমবঙ্গ নাান জয়াগায় গড়ে উঠেছে অনেক রকম বৃদ্ধাশ্রম। কিছুসংখ্যক এমনও আছে যারা ছেলে-সন্তানের পক্ষ থেকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে পিতা-মাতার পরিচর্যা করেন। আর এই রকম বৃদ্ধাশ্রম বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে ঐ সকল সন্তানদের কাছে, যারা দেশ-বিদেশে চাকুরি করে দিনরাত। কোনো কোনো সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরিরত। সুতরাং ঘরে থাকা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পরিচর্যা করার সময় ও সুযোগ থাকে না সন্তানদের হাতে।
ইত্যাদি কারণগুলো উপলক্ষ্য করে অধিকাংশ বৃদ্ধ পিতামাতা সন্তানদের পরিচর্যা ও ভরণ-পোষণ থেকে বঞ্চিত ও প্রত্যাখ্যাত। ফলে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। অর্থাৎ বয়স্ক পরিচর্যা কেন্দ্র।
ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা উন্নতবিশ্বে প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রম বা বয়স্ক পরিচর্যা কেন্দ্র হচ্ছে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। যেগুলি রীতিমতো সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রিত এবং বয়স্কদের অর্থের বিনিময়ে পরিচর্যা করা হয়। আর এভাবেই বর্তমান সমাজে প্রচলিত বৃদ্ধাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বৃদ্ধ মানুষ
বৃদ্ধ মানুষ মানে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা। এরা সকল সমাজেই এক প্রকার পুঁজি বিশেষ। যেহেতু বিশ্ব সমাজব্যবস্থা পুঁজিতান্ত্রিক, তাই আজকের বৃদ্ধ পিতা-মাতা জেনেবুঝে মুনাফাবিহীন বা অলাভজনক পুঁজি। অর্থাৎ এদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার থেকে প্রাত্যহিক জীবনে নগদ লাভ কিংবা প্রফিট হয় না। সহজ ভাষায় বৃদ্ধ পিতা-মাতা পরিবারের বোঝাস্বরূপ।
এরা নিজেরা যেমন অচল-অকর্মণ্য, অসুখে-বিসুখে জর্জরিত, তেমনি তাদেরকে সুস্থ-সবল রাখা, নিয়মিত পরিচর্যা করা বিরাট ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। তারা নিজেরা যেমন নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন না, তেমনি নিজের বিছানাপত্র ও ঘর বাড়িকে আবর্জনার স্তূপ পরিণত করেন। তাদের জন্য রাখতে হয় প্রাত্যহিক ডাক্তার ও চিকিৎসা পরামর্শ ব্যবস্থা। ফলে তাদের নিয়মিত পরিচর্যার জন্য ব্যয়বহুল প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ পরিবার ও ছেলে-সন্তানেরা তা বহন করতে পারে না, করতেও চায় না।
একটা শ্লোগান ইদানীং রাজনৈতিক মাঠে-ময়দানে খুব জোরেসোরে শোনা যায় যে, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। কিন্তু এই কথা কেউ স্পষ্ট করে কিংবা জোর দিয়ে বলে না যে, ‘আজকের প্রতিষ্ঠা কেবল গতকালের কষ্টের ফসল’। অর্থাৎ গতকাল যারা কষ্টেসৃষ্টে দিন-রাত পরিশ্রম করে সমাজকে ‘আজ’কে পৌঁছে দিয়েছে, তারা হলেন পিতা-মাতা। আজকের সমাজের বৃদ্ধ মানুষেরা। আজকের এই বৃদ্ধরাই একসময় ছিলেন সমাজের ভবিষ্যৎ ও কর্ণধার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct