আপনজন ডেস্ক: হাওড়া, হুগলি ও পশ্চিম মেদিনীপরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যাকবলিত হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা পরিদর্শনে যান বুধবার। আকাশপথে পরিদর্শনের কথা থাকলেও আবহাওয়ার কারণে তিনি সড়ক পথে বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করার জন্য বের হন। কিন্তু সড়ক পথে বেশি দূর এগোতে পারেননি। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে দিয়ে তাকে থামতে হয়। সেখানে তিনি স্থানীয় মানষুজনের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তিনি বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেন। এদিনই তিনি বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে বুঝতে পারেন, কেন্দ্রীয় সংস্থা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা ডিভিসির অতিরিক্ত জল ছাড়ার জন্য এই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ডিভিসি রাজ্যকে না জানিয়েই জল ছেড়েছে। তার উপর প্রবল বর্ষণের জন্যই রাজ্যে কার্যত বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে মমতা জানান, তিনি বন্যা পরিস্থিতি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে বেরিয়ে প্রাথমিক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, হাওড়া এবং হুগলির বন্যা কবলিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে দেখে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার পর্যালোচনা করব। বন্যা পরিস্থিতির সামগ্রিক রিপোর্ট তাকে পাঠাবেন বলেও জানান।
এরপর নবান্নে ফিরে এসে মুখ্যমন্ত্রী কড়া চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীকে। চিঠিতে লেখেন, বিপুল পরিমাণ জল ছাড়া হচ্ছে পাঞ্চেত, মাইথন ও তেনুঘাট ব্যারেজ থেকে। ইতিমধ্যেই ২ লাখ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। ফলে রাজ্যে যে বন্যা হয়েছে তা এক কথায় ম্যান মেড। প্লাবিত হয়েছে, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, বীরভূমের একটি বড় অংশ। প্লাবিত হওয়ার ফলে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমি জলের তলায়। বহু ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট জলমগ্ন। এ সবের পিছনে যে ডিভিসির জল ছাড়া সেটা বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তার সপক্ষে যুক্তি দিয়ে মমতা অভিযোগ করেন, বছরের পর বছর ধরে ডিভিসি জল ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ২০১৫ সালের পর ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২১ সালে ডিভিসির জল ছাড়ার ফলে রাজ্যে এইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সংস্কার না হওয়ার কারণে সাামন্য কারণেই জল ছেড়ে দিচ্ছে ডিভিসি। এভাবেই তিনি বন্যা পরিস্থিতির জন্য ডিভিসিকে দায়ী করে ম্যান মেড বন্যা বলে অভিহিত করেন।
দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির জন্য বুধবার ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে অভিযোগ
চিঠিতে মমতা আরও লেখেন, নিম্নচাপের কারণে গত কয়েকদিন ধরে বাংলা ও ঝাড়খণ্ডে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। তখন মাইথন, পাঞ্চেত ও তেনুঘাট জলাধার থেকে প্রায় ২ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে ডিভিসি। যার ফলে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজ্যে। প্রায় তিন লক্ষের বেশি মানুষ ঘরছাড়া। তাঁদের ঠিকানা এখন আশ্রয় শিবির।
এর আগেও ডিভিসির ভূমিকা নিয়েও যে অবগত করেছিলেন তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় চিঠিতে। ২০১৫ সালের বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে ডিভিসির সংস্কার, পলি পরিষ্কার এবং ডিভিসির জলধারণ ক্ষমতা ১.২ লক্ষ একর ফুট বাড়ানোর যে আর্জি জানিয়েছিলেন, বিশেষ করে পাঞ্চেত জলাধারের ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে ১০ কোটি কিউবিক মিটার এবং মাইথন বাঁধে গোলাকৃতি জলাধার বানিয়ে ধারণ ক্ষমতা ১২ কোটি কিউবিক মিটার পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছিলেন সেই বিষয়গুলি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
চিঠিতে ডিভিসির জলাধারে দীর্ঘদিন ধরে পলি পড়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতির অভিযোগ করেছেন মমতা। সেই কারণেই বারবার রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর। ভবিষ্যতে বনা পরিস্থিতি আটকাতে দীর্ঘমেয়াদী সুরাহার আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার চিঠিতে কাজ হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্যুইট করে রাজ্যের প্রতি সহমর্মিতা জানান। সেই সঙ্গে আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন পশ্চিমবাংলায় বন্যায় মৃতদের পরিবারপিছু ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি, আহতেরা ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র জানিয়েছেন, বুধবারও পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকে ৪০ হাজার কিউসেক বেগে জল ছাড়া হয়েছে। জল ছাড়া বন্ধ না করলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও। মুখ্যমন্ত্রী ও সেচমন্ত্রীর অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি ডিভিসি কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর ডিভিসির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সিভিল সত্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, দামোদর উপত্যকা বাঁধ নিয়ামক কমিটিতে ডিভিসির পাশাপাশি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড সরকারের প্রতিনিধিও। জল ছাড়ার আগে এই কমিটির প্রতিটি সদস্যের লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়। এবারও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। সম্প্রতি নিম্নচাপের জেরে বৃষ্টিতে বাঁধগুলি জলধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় দিনে ৩৫ হাজার কিউসেক করে জল ছাড়ছিল ডিভিস। পরে বৃষ্টিপাত বাড়ায় জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct