নাজিম আক্তার, হরিশ্চন্দ্রপুর: গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে গিয়ে মঙ্গলবার সকাল সকাল মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লক অফিসে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকার দৌলতনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের শাসক দলেরই ১২ জন বিক্ষুব্ধ সদস্য। কিন্তু অনাস্থার কাগজপত্র পেশ করার আগেই ব্লক অফিস থেকেই অপহরণ হয়ে গেলেন শাসক দলেরই ১১ জন পঞ্চায়েত সদস্য। অনাস্থার বিক্ষুব্ধ মেম্বারদের অপহরণ, তার সঙ্গে পাল্টা প্রধান অপহরণের জেরে উত্তেজনা ছড়াল হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকা জুড়ে। এদিন হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লক এলাকার দৌলত নগর গ্রাম পঞ্চায়েতের হাইকোর্টের নির্দেশে প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা নিয়ে আসার প্রস্তুতি হিসেবে মঙ্গলবার ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের ১২ জন বিক্ষুব্ধ সদস্য সিগনেচার ভেরিফিকেশন এর জন্য মঙ্গলবার বিডিও অফিসে আসে। সেখানে সদ্ভাব মন্ডপের দোতালায় এই ১২ জন মেম্বার অনাস্থা নিয়ে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অভিযোগ এমনই সময় হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জুবেদা বিবির স্বামী তথা এলাকার যুব তৃণমূল নেতা আশরাফুল হকের নেতৃত্বে প্রায় ৫০-৬০ জনের একটি সশস্ত্র দল ব্লক চত্বরে এসে বিক্ষুব্ধ ওই ১২ জন পঞ্চায়েত সদস্য কে অপহরণ করে। এরমধ্যে বিক্ষুব্ধ সদস্য ও আশরাফুল বাহিনীর মধ্যে ব্লক চত্বরেই হাতাহাতি বেধে যায়। ভাঙচুর চালানো হয় ব্লকের সদ্ভাব মন্ডপের চেয়ার টেবিল দরজা জানলা। গ্রাম পঞ্চায়েতের অনাস্থা কে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয় হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লক এলাকা ঘিরে। এরমধ্যে ওই বিক্ষুব্ধ ১২ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জনকে অপহরণ করে আশরাফুল বাহিনী বলে অভিযোগ। একজন কোনক্রমে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার পরপরই বিক্ষুব্ধ মেম্বারদের সঙ্গে আসা তৃণমূল সমর্থকরা ব্লক চত্বর থেকে ফিরে গিয়ে পায়খানা মোড়ে লোহা ব্রিজে অবরোধ চালায়। পুলিশের গাড়ি আটকে চলে বিক্ষোভ,এমনকি এই ঘটনায় পুলিশের সামনে চলে দুই পক্ষের বিরোধ। পুলিশের সঙ্গে ধস্তা-ধস্তি শুরু হয়ে যায়, পরে হরিশ্চন্দ্রপুর থানা আইসি সঞ্জয় কুমার দাসের নেতৃত্বে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিশাল পুলিশবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পুরো বিষয়টি নিয়ে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দৌলতনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ২০টি আসন রয়েছে। তৃণমূল পরিচালিত দৌলতনগর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে দলেরই আরেক সদস্য পিন্টু কুমার যাদব সহ ১২ জন অনাস্থা আনার জন্য ব্লক প্রশাসনকে স্বাক্ষর সমূহ অভিযোগ জানায়। মঙ্গলবার ছিল ওই ১২ জন সদস্যের স্বাক্ষরের ভেরিফিকেশন। এই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চরম গোলমাল বেঁধে যাওয়ায় চরম উত্তেজনা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এলাকায় বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয়েছে রেপিড অ্যাকশন ফোর্স। থমথমে হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকা।
অন্যদিকে অপহৃত হয়ে বিক্ষুব্ধ মেম্বারের শাসকদলের সমর্থক সদস্যরা ফিরে গিয়ে তেল চাননা সুইচ গেট সংলগ্ন প্রধানের ব্যক্তিগত অফিসে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ। এদিকে প্রধান নাজিবুর রহমান গোষ্ঠীর, পাল্টা অভিযোগ প্রধান কেও নাকি অপহরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আবার হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তবে প্রকাশ্য দিবালোকে তৃণমূলের শাসকদলের যুব নেতার হাতে তৃণমূলেরই পঞ্চায়েত সদস্য অপহরণের ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটেছে হরিশ্চন্দ্রপুরের তৃণমূল নেতারা। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। যদিও এই ঘটনাকে ঘিরে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিরোধীরা। শুরু রাজনৈতিক চাপানউতোর।
হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লকের বিডিও বিজয় গিরি বলেন, দৌলত নগর পঞ্চায়েতের প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে হাই কোর্ট রায় দেয়। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ভেরিফিকেশনের জন্য আজ সদস্যদের ডাকা হয়। ১২ জন সদস্যদের মধ্যে ১১ জন কে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্লক চত্বর থেকে। কে বা কারা তুলেছে সেটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বোঝা যাবে।
বিক্ষোভকারী তৃণমূল কর্মী তাজমুল হক বলেন, অনাস্থা নিয়ে ভেরিফিকেশনের জন্য সদস্যরা এসেছিল। প্রধানের গুন্ডারা তাদের তুলে নিয়ে যায়। বিক্ষোভকারী হরিশ্চন্দ্রপুর ২ নম্বর ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সামান বলেন, আজ অনাস্থা প্রসঙ্গে ভেরিফিকেশনের জন্য ১২ জন সদস্যকে ব্লকে ডাকা হয়। কিন্তু ব্লক চত্বর থেকে তাদেরকে মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আশরাফুল এবং তার সঙ্গে প্রায় ৫০ জন ছিল। প্রধানের মধ্যে এসব হয়েছে। আমরা আমাদের সদস্যদের অতিসত্বর ফেরত চাই।
জেলা তৃণমূল কো-অর্ডিনেটর দুলাল সরকার বলেন,” মমতা ব্যানার্জীর উন্নয়নের জন্য অনেক সদস্য প্রধান হতে চাইছে। তাই বিভিন্ন জায়গায় এইরকম অনাস্থা ডাকা হচ্ছে। সব জায়গায় যে সঠিক কারণে অনাস্থা ডাকা হচ্ছে তা নয়। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।”
বিজেপির জেলা সভাপতি গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল বলেন,” তৃণমূলের প্রধানের বিরুদ্ধে তৃণমূলের সদস্যরা অনাস্থা এনেছিল। সেই অনাস্থা নিয়ে আজ ব্লকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু যে সদস্যরা অনাস্থা তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তৃণমূলের নিজের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এটা। যদিও মালদা জেলায় এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। মানুষের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত।
এই ঘটনা নিয়ে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়েছে এলাকায়। অনাস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক তরজা ছিল চরমে। জল গড়িয়ে ছিল হাইকোর্ট পর্যন্ত। হাই কোর্ট রায় দেয় প্রশাসনকে অনাস্থা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার ব্লকে ডেকে পাঠানো হয় সদস্যদের। তারপর সদস্যদের অপহরণের ঘটনা। সমগ্র ঘটনা নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে শাসক দল। তীব্র হয়ে উঠেছে গোষ্ঠী কোন্দল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct