সেখ মহম্মদ ইমরান: শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া জাতি অচল। সমাজে শিক্ষার হার কমলে কুসংস্কার বাড়ে। সমাজের মান নীচে নেমে যায়। মারামারি হানাহানি হিংসা বেড়ে যায়। মানুষ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। মানুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগে মুহূর্ত পর্যন্ত শেখে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে করোনা নামক এক অতিমারী। থমকে হয়ে যায় বিশ্ব। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বদলে যায়। মানুষ হয়ে যায় ঘরবন্দি। করোনাকালীন সময়ে অর্থনীতি, উৎপাদন-বিপণন, স্বাস্থ্য, গবেষণা-শিল্প-সাহিত্য-প্রকাশনা এসবের সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। করোনা অতিমারীর কারণে যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে নতুন প্রজন্মের আগামীর স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। করোনা অতিমারীর কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস যাবৎ শিক্ষাঙ্গন বন্ধ। পড়াশোনা শিকেয় উঠে গেছে। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অবস্থা তথৈব। সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল টেলিভিশনের মাধ্যমে পড়াশোনা করানোর কিন্তু সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের অনলাইনে পড়াশোনার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ট্যাব কেনার টাকা দেওয়া হল। ছাত্র ছাত্রীরা যথারীতি ট্যাব ও কিনল। ফলাও করে ছাপা হল সংবাদপত্রে। কিন্তু কতটা পড়াশুনার কাজে ব্যবহার হয়েছে সেটা প্রশ্ন চিহ্ন (?) রয়েছে। ওই ছাত্র ছাত্রীরা ট্যাবকে পড়াশোনার কাজে ব্যবহার না করে ফ্রি ফায়ার, পাবজি, ক্যারাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অনলাইন গেম খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাবা মায়েরা তাদেরকে পড়াশুনার কথা বললে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এমন একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ কিছু দিন আগে পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর থানার সুলতানপুরের চন্দ্রকান্ত মন্ডল মোবাইলে ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে খুবই ভালবাসত। কিন্তু নেশা এতটাই বেড়ে যায়, যে তা নিয়ে বাড়িতে শুরু হয় অশান্তি৷ সারাক্ষণ মোবাইলে ব্যস্ত থাকা চন্দ্রকান্তকে বাধা দেয় ও বকাবকি করে দাদা ও মা। তাতেই মাথা গরম হয় তার৷ রাগের বশে কুপিয়ে খুন করে নিজের দাদাকে। একইসঙ্গে মাকেও নৃশংস ভাবে খুনের চেষ্টার করে সে৷ পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিষ খেয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে ওই যুবক! পরে তার মৃত্যুও হয়। আবার করোনা কালে অনলাইনে পড়াশুনা করানোর আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা হলেও পড়ুয়াদের অনলাইনে পড়াশুনাতে অনীহা।
অনলাইন পদ্ধতিতে ক্লাস, পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, ওয়েবিনার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একেবারেই নতুন সংযোজন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম আনন্দের সঙ্গে কতটা গ্রহণ করছে সেটাও মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ অনেক সময় দেখা গেছে শিক্ষক মহাশয় ক্লাস করাচ্ছেন, অপরদিকে ছাত্র/ছাত্রী সাউন্ড মিউট করে হয় ঘুমাচ্ছে, না হলে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে চ্যাটিং করছে বা মোবাইলে অন্য কিছু দেখছে বা ঘাটছে।
অনেক বেসরকারি স্কুলে অনলাইনে পড়াশুনা হলেও সরকারী স্কুলে কতটা পড়াশুনা হয় সেটা বোঝায় যাচ্ছে।উঁচু ক্লাস অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণী বা কলেজে অনলাইনে টুকটাক পড়াশুনা হলেও নিচু ক্লাস গুলো একবারে কিছুই হয় নি। সরকার থেকে উদ্যোগ নিয়ে মিড ডে মিল খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার সময় এক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া হচ্ছে অভিভাবক অভিভাবিকাদের হাতে। কিন্তু ওই এক্টিভিটি টাস্ক গুলো ছাত্র ছাত্রীরা নিজেরা না করে প্রাইভেট শিক্ষক অথবা তাদের বাবা মায়েরা উত্তর করে দিচ্ছেন আবার অনেক ইউটিউবার তাদের ইউটিউব চ্যানেলে উত্তর করে দিচ্ছেন। ফলে কিছু না বুঝেই টাস্ক খাতা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। রাজ্য সরকারের উদ্যোগ মহৎ হলেও এতে করে কোনো ছাত্র ছাত্রীর যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
আবার অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাবা-মায়েদের অনেকের পড়াশুনা নেই, আবার থাকলেও লকডাউন থাকায় আর্থিক অনটন দূর করার জন্য সকাল হলেই বাবা মা একসাথে বেরিয়ে পড়ছে রোজগারের জন্য। তার ছেলে মেয়েরা বই নিয়ে বসছে নাকি সেটা দেখারও তাদের সময় নেই। তাদের কাছে পড়াশোনার থেকেও পেটের টানটা বেশি। আবার বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে ছেলেরা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকম খারাপ কাজে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার সংসার চালানোর দায়ে সাইকেলে করে ফেরি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। দিন শেষে যেটুকু উপার্জন হয় সেটাই তাদের লাভ।
শহরাঞ্চলে অনলাইনে টুকটাক পড়াশুনা হলেও গ্রামের দিকে খুবই কম। গ্রামে নেটওয়ার্ক এর সমস্যা। ক্লাস করার সময় লাইন কেটে যাওয়া ফলে ছাত্র ছাত্রীরা অধৈর্য হয়ে যাই, আবার কোথায় কোথায় একেবারেই নেটওয়ার্ক নেই। গ্রামের দিকে মাটির বাড়ি, ফলে বাড়ির ভেতরে নেটওয়ার্ক সমস্যা। ক্লাস করতে গেলে বাড়ির বাইরে গিয়ে ক্লাস করতে হয় যেখানে নেটওয়ার্ক ভালো। এতে করে অনলাইনে পড়াশুনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে।
টিনএজাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতীয় কলেজের শিক্ষার্থীরা দিনে গড়ে প্রায় ১৫০বার তাদের ফোনগুলি চেক করে এবং তাদের স্মার্টফোনে দিনে ৪-৭ ঘণ্টা ব্যয় করে। পড়ুয়ারা অনলাইন গেম ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পর্ন সাইটে ঢুকে পড়ছে। ফলে কম বয়সেই যৌনতায় মগ্ন হয়ে পড়ছে।
পড়ুয়ারা সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপে বিভিন্ন ভাবে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ছে।
কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে পালিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই বিরুদ্ধে সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এই কুফল তুলে ধরতে হবে সমাজের কাছে। সেমিনার, পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার যে কোনো ভাবেই হোক এই কম বয়সে বিয়ে দেওয়া আটকাতে হবে। তাদের বাবা মায়েদের বেশি বেশি বোঝাতে হবে।
প্ৰত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার হার এমনিতেই কম। যার ওপর দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ। একটা প্রচার চলছে স্কুল কি আর খুলবে? পড়াশোনা যা হওয়ার হয়ে গেছে। এর থেকে ভালো পাত্র পেয়ে গেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব। এই ভাবে স্কুল ছুট ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে।
করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সমস্ত রকম কোভিড স্বাস্থ্য বিধি মেনে সপ্তাহে একদিন একটা শ্রেণীকে স্কুলে আসার নির্দেশ দিতে হবে। সেই শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদেরকে কয়েকটা কক্ষে বিভক্ত করে বসাতে হবে। এর ফলে সোশ্যাল ও ফিজিক্যাল উভয় ডিস্টান্স বজায় থাকবে।
সেই সঙ্গে শিক্ষক মহাশয়দের রোস্টার সিস্টেম করে বিদ্যালয় আসার নির্দেশ দিতে হবে। এতে একদিকে যেমন জমায়েত কম হবে আবার পড়ুয়ারা যে দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে না এসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেটা ধীরে ধীরে কাটবে। পড়াশোনার প্রতি আসতে আসতে আগ্রহ বাড়বে। স্কুল ছুট কমবে। সেই সঙ্গে তখন মিড ডে মিল চালু থাকলে যারা একেবারেই যেতে চাইছিল না তাদেরও আগ্রহ বাড়বে স্কুল যাওয়ার প্রতি। শিক্ষার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমাদের সমাজ এগিয়ে যাবে দ্রুতগতিতে। (লেখক শিক্ষক ও সমাজকর্মী)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct