আপনজন ডেস্ক: দক্ষিণ কেরলের এক স্বশিক্ষিত স্থাপত্যকার গোবিন্দন গোপালকৃষ্ণান নজির সৃষ্টি করেছেন অন্য ধর্মের প্রার্থনালয়ের নকশা তৈরি করে। তিনি ইতিমধ্যে ১১০ টি মসজিদ, ৪টি গির্জার নকশা তৈরি করে অনুপম স্থাপত্য শিল্পের দৃষ্টান্ত করেছেন। তবে তিনি একটি মন্দিরেরও নকশা তৈরি করেছেন। এতসবের মধ্যে শাতধিক মসজিদ নির্মাণের নকশা তৈরি করে যে স্থাপত্য শিল্পের দৃষ্টান্ত রেখেছেন তার দৌলতে তিনি ‘মসজিদ ম্যান’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তিনি নিজে ইসলাম ধর্মের অনুসারী না হলেও প্রতিটি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি তুলে ধরেছেন ইসলামি শিল্পকলা। মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে তার পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে দক্ষিণ কেরলে যে দিকে তাকাবেন মসজিদের গম্বুজ বা মিনার দেখতে পেলে বুঝবেন সেটি গোবিন্দন গোপালকৃষ্ণনের হাতে গড়া।
উপকূলবর্তী শহর তিরুবনন্তপুরমতে বীমাপলি মসজিদ থেকে শুরু করে করুণাগাপ্পালীতে তাজমহলের মতো নকশাধারী শেখ মসজিদ তৈরি করেছেন ৮৫ বছর বয়সী স্ব-শিক্ষিত এই স্থপতি, যেখানে তিনি ধর্মীয় গণ্ডিী পেরিয়ে এসেছন। প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ১১০ টি মসজিদ, ৪ টি গীর্জা, একটি মন্দির এবং বেশ কয়েকটি অট্টালিকা তৈরি করে ‘মসজিদ ম্যান’ হিসেব খ্যাতি অর্জন করেছেন।
জানা গেছে, আর্কিটেকচারের সঙ্গে তার হাতে খড়ি ১৯৪০ এর দশকে। পিতার হাতেই তার হাতেখড়ি যখন তিনি শিশু ছিলেন।
তার বাবা কে গোবিন্দর ডিনি কন্ট্রাক্টর ছিলেন তার বিল্ডিংয়ের ব্লু প্রিন্টের ট্রেসিংগুলো নিয়ে নারকেল তেল মিশিয়ে সাদা শিটে ফেলতেন।
গোপালকৃষ্ণান জানান, ছুটির দিনে বাবার কাজের সাইটগুলিতে গিয়ে দেখতাম কীভাবে মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে। তবে প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন এল এ সালদানহা নামে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ড্রাফটম্যানের কাছ থেকে। তার কাছ থেকে ছবি আঁকার মূল বিষয়গুলি শিখেছি। তবে, তিনি ইচ্ছা মতো ইঞ্জিনিয়ারিং বা আর্কিটেকচার পড়াশুনা করতে পারলাম না। যদিও আমি পরে এএমআইই কোর্সে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু তা শেষ করতে পারিনি। সেই সময়ে, পূর্ত দফতরের বিল্ডিং বিভাগে বিনা বেতনে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করেছি, স্যাট হাসপাতাল বিল্ডিং প্রকল্পে কাজ করেছি, যা আমাকে নৈপুণ্য এবং কৌশল শিখতে সহায়তা করেছিল।
তবে তার ‘মসজিদ ম্যান’ হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল তিরুবনন্তপুরমের পলয়াম থেকে।ি সেখানে মন্দির, মসজিদ ও গির্জা পামাপাশি থেকে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি করেছিল।
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে পলায়েম মসজিদ কমিটি মসজিদটি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলে তার বাবা নির্মাণকাজের বরাত পেয়েছিলেন। কেরলের প্রথম প্রধান ইঞ্জিনিয়ান টিপি কুট্টিয়ামু ডিজাইনটি সম্পন্ন করতে কাজ তার বাবাকে সহায়তা করেছিলেন।
গোপালকৃষ্ণান অতীত স্মরণ করে বলেন, সেসময় ঠিকাদাররা অগ্রিম টাকা পেত না। নির্মাণের সময় নিজেদের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়েছিল। কিন্তু, আমাদের সামর্থ্য ছিল না। তাই পি.পি.চুম্মারের সাহায্য চেয়েছিলাম, যিনি বাড়ি নির্মাণ করতেন। তিনি তাড়াতাড়ি রাজি হন। সুতরাং, হিন্দু স্থপতিদের দ্বারা পলায়েম মসজিদটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল একজন খ্রিস্টানের আর্থিক সহায়তায়। তার কাছ থেকে সম্প্রীতির পাঠ শিখেছি। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন মসজিদটির উদ্বোধন করেছিলেন।
তিনি জানান, সেসময় বেশিরভাগ মসজিদে ছিল কেরলের ঢঙে টাইলস ছাদ। দিল্লির সাফদারজং সমাধি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি গম্বুজ ও মিনারগুলির সাহায্যে পলায়েম মসজিদটির নকশা মসজিদ কমিটিগুলির কাছেও উত্থাপন করেছিল। ১৯৬৭ সালে, বিমাপালি মসজিদ কমিটি তার পুনর্নির্মাণের জন্য তাকেই ডিজাইনের দায়িত্ব দেয়।
শিহরিত কণ্ঠে গোপালকৃষ্ণান জানান, তখন মাত্র ৩১ বছর বয়স। বাড়িতে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। পেরসি ব্রাউন এর ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার (ইসলামিক পিরিয়ড) থেকে ইন্দো-সারেসনিক আর্কিটেকচারের বেসিকগুলি শেখার পরে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কনটি শেষ করেছি, একটি লণ্ঠনের নিচে দিনরাত কাজ করেছিলাম। নির্মাণটি করতে দীর্ঘ ১৭ বছর সময় নিয়েছিলাম, কারণ এটি সমস্ত কিছু অনুদানের উপর নির্ভর করে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তার বাড়ির অভ্যন্তরেও। স্ত্রী খ্রিস্টান এন. জায়া এবং তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে দু’জনই অন্য ধর্ম বা বর্ণের লোকদের সাথে বিবাহিত হন। ২০০২ সালে, তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রচারের জন্য একটি সামাজিক সংস্থা ‘মানব মৈত্রী’ শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তিনি কয়েক বছর ধরে কুরআন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে তাঁর বই ‘নানজান কান্ডা কোরআন’ (কুরআন আমি দেখেছি) এর প্রথম অংশটি শেষ করেছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct