ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।
______________________________
নারী জাগরণের অগ্রদূত ‘বেগম রোকেয়া’
______________________
আব্দুল মাতিন: “সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায়,/ আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমা”। মুক্তির এমন আকুতি একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের কালে বসেও অনেকের মনকে হয়তো শিহরিত করবে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ শতকের তিন দশক ছিল এই মানবের (বেগম রোকেয়ার) বিচরণ ক্ষেত্র। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামটি হল সার্বিক জীবনদৃষ্টিভঙ্গীর সমগ্রতা। বহুমুখী ছিল তার জীবন চর্চা। এটা ঠিক যে, নারীদের শিক্ষার আঙিনায় এনে, তাদের আত্মার জাগরণ ঘটিয়ে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল তার মূখ্য উদ্দেশ্য। তবে সেই উদ্দেশ্য সাধনে তাকে হাটতে হয়েছে নানা পথে। নারীর সার্বিক উন্নতি বিষয়ক ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তার প্রতিষ্ঠান স্থাপন তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপে পরিচিতি দিয়েছে। আর সেই ভাবনাকে বৃহৎ ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তার লেখনী তাকে দিয়েছে সাহিত্যিক খ্যাতি। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার দ্বারা বহু বিধবা নারী, বহু দরিদ্র নারীর বিবাহ খরচ ও বহু দরিদ্র মেয়ের শিক্ষা লাভের পথ সুগম হয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজ সেবক। পরাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ড, অসহজোগ ও খিলাফত আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রভৃতিতে স্বশরীরে অংশগ্রহন করতে না পরলেও তিনি এসব বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। স্বদেশিকতা বোধের সাক্ষর রেখেছেন ‘চাষার দুঃখ’ ও ‘এণ্ডিশিল্প’ নামক প্রবন্ধে। প্রথম রচনাটিতে চাষিদের দুরবস্থা ও দেশের শিল্প অবলুপ্তির কারণ সম্পর্কে তার উপলদ্ধি “আবার সেই ‘মরাই ভরা ধান, ঢাকা মসলিন’ ইত্যাদি লাভ করিবার একমাত্র উপায় দেশি শিল্প- বিশেষতঃ নরীশিল্প সমূহের পুনরুদ্ধার। জেলায় জেলায় পাটের চাষ কম করিয়া তৎপরিবর্তে কর্পাসের চাষ প্রচুর পরিমাণে হওয়া চাই এবং চরকা ও এণ্ডি সুতোর প্রচলন বহু পরিমাণে হওয়া বাঞ্ছনীয়। .... পল্লীগ্রামে সুশিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা হওয়া চাই। গ্রামে গ্রামে পাঠশালা আর ঘরে ঘরে চরকা ও টেকো হইলে চাষার দারিদ্র ঘুচবে”।
নারীসমাজের কল্যাণ সাধিকা রোকেয়ার কলম ঝলসে ওঠে “যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জর্জ – সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে এদেশের সমস্ত নারীকে রানী করিয়া ফেলিব! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব” –এমন জোরালো ও আত্মবিশ্বাসী লেখনীতে। তিনি মনে করতেন নারীদের আপন মনে জাগিয়ে তুলতে হবে আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস থেকেই আসবে আত্মজাগরণ। যা নারী মনের দাসত্ব মোচনের সহায়ক হবে। আর এই জন্য আবশ্যক নারী শিক্ষা। তাই তার জোরালো ঘোষণা “কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জ্জন করুক”।
আবার মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার ব্যাপারে কঠোর রক্ষণশীলতাকেও তিনি বিদ্ধ করতে পিছপা হন নি। সে ব্যাপারে তার নির্ভিক বলিষ্ঠ উচ্চারণ “মূর্খতার অন্ধকার যুগে কন্যাবধ করিত, যদিও ইসলাম ধর্ম কন্যাদের শারীরিক হত্যা নিবারণ করিয়াছে তথাপি মুসলমানগণ অম্লানবদনে কন্যাদের মন, মস্তিস্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি অদ্যাপি অবাধে বধ করিতেছেন.... তেরশত বৎসর পূর্বেই আমাদের জন্য শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক আইন করা হয়ে গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করে নাই....”। শিক্ষা ব্যতিত মুসলিম নারী, তথা সমগ্র নারী সমাজ এবং সমাজের সার্বিক উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়, একথা তিনি তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গভীর অনুভূতির দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নারী মুক্তির জন্য নারী শিক্ষার আকুতি তার কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হয়েছে। কেননা তার অর্জিত আভিজ্ঞতা “মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রী শিক্ষার ঔদাস্য”। তাই তিনি শিক্ষার দ্বারা মুসলিম সমাজের নানামহলের আড়ষ্টতা ভাঙিয়ে সেখানে জাগরণের মুক্ত হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি কেবল “পাশ করা শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষা বলে মনে করতেন না”। তার কাছে শিক্ষার অর্থ আরো গভীর। তার ঘোষণা “আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে”। ভাবা যায়! নাগরিক অধিকার লাভের কথা ধ্বনিত হচ্ছে রোকেয়ার কন্ঠে, সেই সময়ে। যা চলমান কালের জনপ্রিয় শব্দ। যার জন্য গোটা দেশ তোলপাড়। অথচ এমন এক মানব আজও আমাদের কাছে প্রায় অপরিচিত থেকে গেল। আর পরিচিতি যেটুকু পেয়েছে সেটা কেবল নারীবাদী, এই বিশেষ এক অভিধায় ভূষিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও যেন মনে হয় তিনি নারীবাদী নন। তিনি যুক্তিবাদী, তিনি মানবতাবাদী, তাকে কোনো একটি বা দুটি বিশেষণে বিশেষিত করলে তার বৃহৎ কর্মযজ্ঞকে বোঝা কঠিন হয়ে যায়। মানুষের কাছে তার পরিচয়ের ব্যাপ্তিটাও হয়ে যায় সংক্ষিপ্ত। ‘সুগৃহিনী’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “নারী ও নর উভয়ে একই বস্তুর অঙ্গ বিশেষ। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পুর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না”। “সমাজের অর্ধ অঙ্গ বিকলঙ্গ রাখিয়া উন্নতি লাভ করা অসম্ভব”। একবিংশ শতকে বসে আমরা এই বুলিই আওড়ে যাচ্ছি। আমরা এখন বসে যা ভাবছি বিশশতকের গোড়াতে বসে রোকেয়া তা ভেবেছেন। তার চিন্তা চেতনার জগৎ ছিল এমনই প্রগতিশীল। আর আমরাও এখন প্রগতিশীল, তার বুলি আওড়াতে, আদর্শ বাস্তবায়নে নয়।
নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদী রোকেয়ার ধর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা “ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নহে।.... আরো দেখ যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ সতীদাহ, যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল সেখানে রমণী অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অর্থাৎ পুরুষের সমতুল্য। এ স্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধানকে বুঝাইতেছি”। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনস্তত্ত্বকে অনুধাবনের কী সাংঘাতিক মনের তীক্ষ্নতা।
তিনি সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত এঁকেছেন তার ‘পদ্নরাগ’ নামক উপন্যাসের মধ্যে। সমকালে বিপন্ন সময়ে বসেও তিনি কী অনায়াসে তার ‘তারিণী -ভবন’ নির্মান করতে পারেন, “মুসলমান, হিন্দু, ব্রাহ্মণ, খ্রীষ্টান সকলে যেন এক মতৃগর্ভজাতা সহোদরার ন্যায় মিলিয়া মিশিয়া কার্য্য করিতেছেন”। সর্বধর্মের মানুষের এমন সহাবস্থানের দ্বারা। উপন্যাসের চরিত্র আদম শরীফের কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়, “আপ বইঠিয়ে, মাইজী আবি পূজাপাট করতা হায়। পূজা হো জানে সে মাইজী আবি আয়েগা”। আর যখন তিনি রাফিয়া ও কোরেশাকে সেই তারিণীর শতরঞ্জির উপর নামাজ পড়ান, তখন তার তারিণী ভবন হয়ে ওঠে একখণ্ড ভারতবর্ষ। আমরা কি আজও পেরেছি এমন সমাজ গড়ে তুলতে? সবই তো আজও আমাদের অধরা। কোনো কোনো মুসলিম সমাজে ইসলাম ধর্মের আবেগকে কাজে লাগিয়ে চলে নরীর শোষণ ও শাসন। জন্মসুত্রে মুসলিম হওয়ার সুবাদে এবিষয়ে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু নিজে কোরাণ শরীফ পড়ার ও সেটাকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা ছিল বলেই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে লিখতে পেরেছিলেন “কোরাণ শরীফের সার্ব্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানাপ্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে”। এই শিক্ষা আমরা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে আজও ব্যর্থ। অথচ বিপরীত কাজটা কত অনায়াসে করে ফেলেছি।
চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে, নারীজাগরণে তাথা বাংলার নবজাগরণে তার ভূমিকা দ্বিতীয়রহিত। আধ্যাত্মিকতার স্থলে নৈতিকতা, গড্ডলের স্থলে ব্যাক্তিকতা, ভাবালুতার স্থলে ভাবুকতা, আবেগের স্থলে যুক্তিশীলতা, প্রশ্নহীন সমর্থনের স্থলে জিজ্ঞাসু বিবেচনা- পুনর্বিবেচনা, বিমুর্ত কল্পনার স্থলে মনস্বিতা ও তার সকর্মক প্রয়োগ – বেগম রোকেয়া রেনেসাঁসের এইসব চরিত্র লক্ষণে অসম্ভব উজ্জীবিত। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়- সব ধরণের প্রতিকূলতাকে অস্বীকার করে রোকেয়া কিন্তু তার প্রতিবাদকে কেবলমাত্র সাহিত্যের ভাষাতে সীমাবদ্ধ না রেখে গঠনমূলক কাজের মধ্য দিয়ে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। অথচ এমন এক ব্যক্তিত্ব আজও পেলো না তার প্রাপ্য যথার্থ সম্মান। আজও আমরা পারলাম না তাকে ও তার আদর্শকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct