দিলীপ মজুমদার: তখন আমি বিমল ধরের অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্সে সম্পাদনার কাজ করতাম। বিমলবাবু একদিন আমাকে একটি পাণ্ডুলিপি দিলেন দেখার জন্য। লেখক সংবাদিক তাপস গাঙ্গুলি। বইটির নাম চমকপ্রদ। ‘ভদ্রলোক চোর’। ভদ্রলোক মানে যাঁরা ভদ্র জামা-কাপড় পরেন, শিক্ষা-দীক্ষা আছে; যাঁদের দেখে চোর বলে মনেই হবে না। তাঁরা মানুষকে ঠকান। তাপসবাবু বলেছিলেন তাঁর সংবাদিক জীবনে এ রকম ভদ্রলোক চোর তিনি অনেক দেখেছেন। এদের জীবন-যাপন, কথাবার্তার ধরন দেখে সাধারণ মানুষ কোন সন্দেহ করেন না। টাকা-পয়সা তুলে দেন এবং সেগুলি লোপাট হয়। ছিটফান্ডের কথাও তিনি বলেছিলেন। তখন অবশ্য সারদা, রোজভ্যালি ছিল না।
মনে আছে নটবরলালের কথা? বিহারের সিওয়ান জেলার বঙ্গারা গ্রামের নটবরলাল? যাঁর আসল নাম মিথিলেশকুমার শ্রীবাস্তব? আইনজীবী নটবর বহু মানুষকে ঠকিয়েছিলেন। বাদ যান নি মিত্তল, আম্বানি, টাটাও। প্রতারক হলেও প্রতিভা ছিল মানুষটির। সার্থক প্রতারক হতে গেলে প্রতিভার প্রয়োজন। শাস্ত্রেও তো চুরিবিদ্যাকে ‘বড় বিদ্যা’ বলা হয়েছে, অবশ্য ধরা না পড়া পর্যন্ত। নটবারলাল নাকি নানা ভি আই পির সই নকল করতে পারতেন। ভেকবদলে ওস্তাদ ছিলেন। বার বার গ্রেপ্তার হয়েও জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। একবার তো জেলখানায় পুলিশ অফিসারের পোশাক চুরি করে, সেই পোশাক পরে তিনি জেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নটবরলাল তাজমহল, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবনও নাকি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
আমাদের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী এক ভুয়ো টিকাকেন্দ্র থেকে করোনার টিকা নিয়েছিলেন। তত্ত্বতল্লাশ করতে বেরিয়ে পড়ল আর এক নটবরলাল। দেবাঞ্জন দেব। ২৮ বছরের এই ছোকরাটির কাণ্ডকারখানা দেখে আমার মতো অনেকের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। নকল আই এ এস সেজে গাড়িতে নীল বাতি লাগিয়ে কলকাতা শহরে সে ঘুরে বেড়িয়েছে দেদার, ঢুকে পড়েছে সরকারি অফিসে, মাত্র ৬ বছরে ১০ টি ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়েছে ২ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা। প্রকাশ্য দিবালোকে এ সব কাজ। বুক কাঁপে নি, সংকোচ ছিল না, কথায় তোতলামি আসেনি। প্রতিভা নয়?
দেবাঞ্জনের ঘটনার যখন ক্লাইম্যাক্স, তখন আর একজন নটবারলালের হদিশ মিলল। আসলে এ রকম হয়। একটা কোন বাড়িতে আগুন লাগলে, দেখবেন পর পর আগুন লাগার ঘটনা। একটা কোন বাড়ি ভেঙে পড়লে, দেখবেন পর পর বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনা। আমাদের এই নতুন নটবরলালের নাম সনাতন রায় চৌধুরী। ইনি নাকি পেশায় আইনজীবী। দেবাঞ্জনের মতো ইনি ছোকরা নন। এঁর গতিবিধিও বিরাট পরিসরে। ইনি কখনও সি বি আইএর কৌঁসুলি, কখনও সরকারি কূটনীতিক, কখনও রাজ্য সরকারের স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের সদস্য। গড়িয়াহাটের বিপুল টাকার সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে ইনি ধরা পড়েছেন। এঁর কীর্তির সবটা এখনও প্রকাশ পায় নি, ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
দুই নটবারলালকে নিয়ে এখন শাসক ও বিরোধীর বচসা শুরু হয়েছে; সংবাদপত্রে, বিশেষ করে টিভি চ্যানেলে চলছে রোমাঞ্চকর আলোচনা। আমার বিশ্বাস, এই দুই ভদ্রলোক চোরকে নিয়ে সাধারণ মানুষের বিশেষ কোন মাথাব্যথার কারণ নেই। চুরি, প্রতারণা, দুর্নীতি আজ ডালভাত। আমাদের জননেতারাই সেই ডালভাত আমাদের সামনে তুলে ধরেন মাঝে মাঝে। এঁদের জন্য কালোটাকার রমরমা। ভারতের কালোটাকা ইংল্যান্ড, ইউক্রেন ও চিনের দ্বিগুণ। রাজনীতি জগতের সেই ভদ্রলোক চোরেদের তালিকার সীমা নেই; তার মধ্যে কয়েকটি নাম : রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক, বি এস ইয়েদুরাপ্পা, বেলেরির রেড্ডিরা, শিবরাজ সিং চৌহান, হিমন্তবিশ্ব শর্মা, নারায়ণ রানে, লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়েম সিং যাদব...। কে কি করতে পরেছে এঁদের ? নটবর বা দেবাঞ্জন বা সনাতনতো এঁদের কাছে শিশু। দুর্নীতির, প্রতারণার গুণগত ও পরিমাণগত দিক থেকে। আইনও এঁদের কিছু করতে পারে না। কারণ আমাদের আইনি ব্যবস্থায় ফাঁকফোকর আছে অনেক, তাই তো তাকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলেছিলেন আইভর জেনিংস।
নটবর- দেবাঞ্জন-সনাতনের মতো আমাদের ভদ্রলোক রাজনীতিবিদেরাও ‘চুরিবিদ্যাকে বড় বিদ্যা ’ প্রমাণ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দেখতে দেখতে যাতে এই চুরি ব্যাপারটা মানুষের ধাতে সয়ে যায়, সে ব্যবস্থাও করেছেন। তাই কলাটা, মুলোটা চুরি হলে আমরা উত্তেজিত হই, পুকুর চুরিতে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকি। আর কখনও নিজেদের সান্ত্বনা দেবার জন্য বলি : যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct