ফৈয়াজ আহমেদ: যেন সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সাক্ষী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ছোট্ট এই শহরে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য রবীন্দ্রঅনুরাগী পর্যটকেরা ছুটে আসেন। শান্তিনিকেতনের পূর্ব নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শহরে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন শান্তিনিকেতন। প্রায় ৪০ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে এখানে একটি পাঠভবন প্রতিষ্ঠা করেন। যা তৎকালীন সময়ে শিক্ষা চর্চার ধারাকে অমূল পরিবর্তন করে ফেলে। ১৯১৩ সালের পরবর্তী সময়ে এই পাঠভবনটি বিশ্বভারতী মহা বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
বর্তমানে শান্তিনিকেতনকে আরো সমৃদ্ধ করেছে পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব, জয়দেব কেঁদুলির মেলা, ছাতিমতলা, রবীন্দ্র মিউজিয়াম, বল্লভপুর ওয়াইল্ডলাইফ পার্ক, নন্দন আর্ট গ্যালারি, সোনাঝুরি এবং আমারকুটির। শান্তিনিকেতন প্রকৃতি, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির সৌন্দর্য্যে জ্ঞান এবং ভ্রমণপ্রেমীদের হৃদয় তৃপ্ত করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে।
কী দেখবেন শান্তিনিকেতনে
(১) উত্তরায়ণ – রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের আবাস, কয়েকটি ভবনের সমষ্টি। ‘বিচিত্রা’য় দেখুন রবীন্দ্র মিউজিয়াম। কবির ব্যবহৃত অস্টিন গাড়িটিও প্রদর্শিত হয়েছে। পাশেই রবীন্দ্র ভবন। আর রয়েছে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য ‘উদয়ন’, ‘কোনার্ক’, ‘শ্যামলী’, ‘পুনশ্চ’ ও ‘উদীচী’ গৃহ। কবির স্বহস্তে রোপিত মালতীলতা। ‘উদীচী’র ডাইনে গোলাপ বাগিচা।
(২) ছাতিমতলা – উত্তরায়ণের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধনবেদি ছাতিমতলা। শ্বেতপাথরের বেদিতে বসে এখানেই মহর্ষি লাভ করেছিলেন ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’, এই কথাটি লেখা আছে দক্ষিণের গেটে।
(৩) উপাসনাগৃহ – ছাতিমতলার পেছনেই বর্ণময় কাচের তৈরি উপাসনাগৃহ। ১৮৯২ সালে এই উপাসনাগৃহের উদ্বোধন হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত এই উপাসনাগৃহে আজও প্রতি বুধবার প্রত্যুষে উপাসনা হয়।
(৪) শান্তিনিকেতন গৃহ – অদূরেই শান্তিনিকেতন ভবন। আশ্রমের সব চেয়ে পুরোনো বাড়ি, ১৮৬৩-৬৪ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৈরি। বালক রবীন্দ্রনাথের প্রথম শান্তিনিকেতন বাস এই গৃহেই। সুদীর্ঘকাল এই গৃহই ছিল শান্তিনিকেতনের অতিথিনিবাস। এই গৃহের অদূরে টিলার আকারে একটি মাটির ঢিবি আছে। মহর্ষি এখানে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতেন।
(৫) দেহলি – স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে এখানে বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে এখানে শিশুদের বিদ্যালয় ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’র সূচনা হয়।
(৬) তালধ্বজ – উত্তরায়ণ পেরোতেই ত্রিমুখী বাঁকের মুখে তালধ্বজ। একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে তৈরি গোলাকৃতি এই মটির বাড়ি। তালগাছের পাতাগুলি ধ্বজার মতো বাড়িটির উপরে শোভা পায় বলে বাড়িটির নাম তালধ্বজ।
(৭) আম্রকুঞ্জ – বর্ধমানের মহারাজ মহতাব চাঁদ তাঁর মালি রামদাসকে পাঠিয়ে এই বাগানের পত্তন ঘটান। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে এখানেই সংবর্ধিত করা হয়। পাঠভবনের নিয়মিত ক্লাস হয় এখানে।
কলাভবন, সংগীতভবন, তিনপাহাড়, শালবীথি, সন্তোষালয়, ঘণ্টাতলা, শমীন্দ্র পাঠাগার, গৌরপ্রাঙ্গণ, সিংহসদন, পূর্ব ও পশ্চিম তোরণ, চৈত্য, দিনান্তিকা, দ্বিজবিরাম, কালোবাড়ি ইত্যাদি।
শান্তিনিকেতনের গোটা এলাকা জুড়ে রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নানা শিল্পকর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে সবও দেখার এবং বোঝার।
আরও দ্রষ্টব্য
(১) সৃজনী শিল্পগ্রাম – উত্তরায়ণ ক্যাম্পাসের অদূরে শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে সৃজনী শিল্পগ্রাম। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি শিল্পগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এখানে দেখা যাবে পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্প নিদর্শন। এক একটি কুটির এক এক রাজ্যের প্রতীক। সারা চত্বরে ছড়ানো ছেটানো নানা মূর্তি-ভাস্কর্য। দেখতে দেখতে একেবারে শেষে পৌঁছে যাবেন বাঁশের তৈরি লাইটহাউসে।
(২) শ্রীনিকেতন – ৩ কিমি দূরে, বিশ্বভারতীর পল্লি শিল্পকেন্দ্র বিভাগ। হস্তশিল্পের বিপুল সম্ভার, দেখা ও কেনার জন্য।
(৩) গীতাঞ্জলি রেল মিউজিয়াম – কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতীয় রেল বোলপুর স্টেশনের পাশে এই মিউজিয়ামটি চালু করে ২০১২ সালে। এর অন্যতম আকর্ষণ হল ‘সেলুন কার’ – যে ‘সেলুন কার’-এ চড়ে কবিগুরু শেষ বারের মতো শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলেন। এখানে আরও অনেক কিছুর মধ্যে প্রদর্শিত হয়েছে কবিগুরুর ৩৫টি দুষ্প্রাপ্য ছবিও।
(৪) বল্লভপুর ডিয়ার পার্ক – শাল, পিয়াল, শিশু, জাম, মহুয়া, কাজু, হরীতকী, আমলকী, বহেরা, শিরীষ, সোনাঝুরি আর আকাশমণিতে ছাওয়া ৭০০ একর এলাকা জুড়ে চিতল হরিণ, বার্কিং ডিয়ার, কৃষ্ণসার, ময়ূর, খরগোশ, শিয়াল আর সাপের বাস।
কখন যাবেন
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস শান্তিনিকেতনে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। গ্রীষ্মকালে শান্তিনিকেতন ভ্রমণে না যাওয়াই ভাল হবে, শীতের সময় অনায়াসে শান্তিনিকেতনে ঘুরে বেড়ানো যায়।
কিভাবে যাবেন
কলকাতার হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে ১২৩৩৭ শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, ১৩০১৭ গণদেবতা এক্সপ্রেস, ১২৩৪৭ রামপুরহাট এক্সপ্রেস, ১৩০১১ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, ১৩১৮৭ শিয়ালদা-রামপুরহাট এক্সপ্রেস কিংবা ১৫৬৫৭ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে বোলাপুর চলে আসুন। বোলাপুর রেল স্টেশন থেকে রিকশা বা ব্যাটারি চালিত অটোয় চড়ে সহজেই শান্তিনিকেতন যেতে পারবেন। বোলপুর থেকে রিকশায় শান্তি নিকেতন যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে।
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য বোলপুরে অসংখ্য লজ এবং হোটেল রয়েছে। এখানে এক থেকে তিন হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের রুম পাবেন।
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজে এসি, নন-এসি রুমের ব্যবস্থা আছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct