দিলীপ মজুমদার: শেষ পর্ষন্ত কি মাথা খারাপ হয়ে গেল পারুল কক্করের? দেখে-শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। তা না হলে হঠাৎ এ রকম কবিতা কেন? আমরা তো জানতাম পারুল এক শান্ত শিষ্ট গৃহবধূ। স্বামী ব্যাঙ্কের কর্মী। কবিতা-টবিতা লিখত পারুল। আমাদের মতো ধর্মভীরু, অধ্যাত্মবাদী। গুজরাতের বৈষ্ণবদের আরাধ্য শ্রীনাথজিকে নিয়ে সে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছে। তার ভক্তিগীতি গুজরাতে বেশ জনপ্রিয়। ইতিহাসবিদ বিষ্ণু পাণ্ডে, যাঁকে আমাদের আরাধ্য নরেন্দ্র মোদি পদ্মশ্রী দিয়েছেন, পারুল কক্করকে গুজরাতি কবিতার ভবিষ্যৎ বলে রায় দিয়েছিলেন, তিনি তো পারুলের কাণ্ড-কারখানা দেখে একেবারে হতবাক।
কি করেছে পারুল ? বাইরের দিক থেকে দেখলে তেমন কিছু নয়। একটা চোদ্দ লাইনের কবিতা লিখে ফেলেছে। আর সেটা নেট মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। নেট মাধ্যম সে রপ্ত করেছিল তার ছেলের কাছে। চোদ্দ লাইনের এই কবিতাটাই বলে দিচ্ছে পারুলের মাথা খারাপ হয়েছে। করোনা আক্রান্ত মানুষ মরে যাবার পরে যোগীরাজ্যে তাদের পবিত্র গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ মাধ্যমে সেটা প্রকাশ হতেই রে রে করে ওঠেন বিরোধীরা। ছ্যা ছ্যা ধ্বনি উঠতে থাকে দেশময়। বলুন তো, এটা এমন কি অপরাধ, যে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে?
আর তাই নিয়ে কবিতা লিখেছে পারুল কক্কর। যে পরিবারের সদস্যরা আমাদের গেরুয়া শিবিরের সমর্থক, সে পরিবারের গৃহবধূ এরকম একটা কবিতা লিখতে পারল কি করে! আগে তো সে এমন কাণ্ড করেনি। এখন করল কেন ? মাথার গণ্ডগোল ছাড়া আর ক !
কি বলছে পারুল ? বলছে ‘মহারাজের রাম রাজত্বে শববাহিনী গঙ্গা’। মহারাজ কে? কে আবার, আমাদের আরাধ্য দেবতা নরেন্দ্র মোদি। তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ ? সাহস তো কম নয়। আবার বলে, “পাড় থেকে তাও রাজা হাঁকে ‘নেই কোন আশঙ্কা।” মোদিকে কটাক্ষ করা হচ্ছে! যে মোদি জনপ্রিয়তায় বিশ্বসেরা, তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ! আবার বলা হচ্ছে, ‘ল্যাংটা রাজার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা’!
আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই ‘উলঙ্গ রাজা’র কথা। যেখানে একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে বলেছিল, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় কোন বিশেষ শাসকের প্রতি ইঙ্গিত ছিল না। তাই তাঁর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভের পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাই তাঁর একদা বন্ধু নীরেন্দ্রনাথের প্রতি বক্রোক্তি করেছিলেন। কিন্তু পারুলের কবিতায় তো বিশেষ শাসকের দিকে ইঙ্গিত আছে, সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ আছে। গঙ্গায় শব ভেসে যাওয়ার ঘটনাটা অতি সাম্প্রতিক।
ভক্তিমতী, গেরুয়া শিবিরের সমর্থক এক নারীর এ কি রকম পরিবর্তন ?
আমাদের বিরোধী শিবির কি গোপনে গোপনে পারুলকে তাতিয়েছে? এ সব নিয়ে চর্চা চলছে। আমরা ভাবছি অনুসন্ধানের ভারটা আমাদের রাজ্যপালের হাতে ছেড়ে দেব। তাঁর মতো অনুসন্ধিৎসু মানুষ বিরল। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করার দুর্লভ ক্ষমতা তাঁর আছে।
এর মধ্যে পারুলের কবিতাটা পাঁচ-ছটা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। লক্ষাধিক শেয়ার হয়েছে। তাই আমরাও আমাদের ট্রোলবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছি। ২৮ হাজার কুমন্তব্যে ভরি্য়ে দিয়েছি। পারুলকে দেশদ্রোহী বলতে দ্বিধা করি নি। আরে মশাই, যে আমাদের বিরুদ্ধে বলবে, সেই তো দেশদ্রোহী। অমর্ত্য সেনের মতো লোককেও আমরা ছাড়ি নি। ইতিহাস ভূগোল সংবিধান সব কিছু আমরা পাল্টে দেব। রামরাজত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে পারুল। আসলে তার চোখে ন্যাবা হয়েছে, তাই ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। রামরাজ্য নির্মাণের কাজ বিপুলবেগে অগ্রসর হচ্ছে। এক দেশ, এক ধর্ম, এক দল, এক নেতার কাজও শেষ হল বলে। মাঝখানে মমতাদিদি একটু রগড়ে দিয়েছিলেন। তা, আমরা রামদেবের বিশেষ মলম ব্যবহার করে আরোগ্য লাভ করেছি। অযোধ্যায় রাম মন্দির আর দিল্লিতে সেন্ট্রাল ভিস্টার কাজ শেষ হলে দেখবেন রাম রাজত্ব কাকে বলে!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct